৭ মাস ধরে কমছে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি
বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি কমছেই। টানা সাত মাস ধরে কমছে দেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক। দুই বছরের করোনা মহামারির ধকল কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিল বাংলাদেশের অর্থনীতি।
স্বপ্নের পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু কর্ণফুলী টানেল ও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোকে ঘিরে দেশে বিনিয়োগের একটি আবহ তৈরি হয়েছিল। যার প্রভাব পড়েছিল বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধিতে; বাড়তে বাড়তে গত বছরের আগস্টে ১৪ শতাংশ ছাড়িয়ে এই প্রবৃদ্ধি ১৪ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশে উঠেছিল।
এর পর থেকে কমছেই। সর্বশেষ মার্চ মাসে ১১ দশমিক ২৮ শতাংশে নেমে এসেছে। আগের মাস ফেব্রুয়ারিতে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ দশমিক ১৪ শতাংশ।
করোনার ধাক্কা কাটতে না কাটতেই এক বছরের বেশি সময় ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিকেও বেশ চাপের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। আমদানি খরচ অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ কমতে কমতে ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে ৩০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।
বৃহস্পতিবার দিন শেষে রিজার্ভ ছিল ২৯ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার।
সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা পদক্ষেপে আমদানি ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরা গেছে ঠিকই। কিন্তু দেশে নতুন বিনিয়োগের অন্যতম নির্দেশক মূলধনি যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারি) আমদানি এক ধাক্কায় তলানিতে নেমে এসেছে। শিল্পের কাঁচামাল আমদানিও কমেছে।
অন্যদিকে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় নতুন শিল্প স্থাপনের খরচ অনেক বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ী-শিল্পদ্যোক্তারা ‘ওয়েট অ্যান্ড সি (অপেক্ষা করো এবং দেখো)’ পলিসি নিয়েছেন। এসব কারণেই বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার ও ব্যবসায়ী নেতারা।
বাংলাদেশ ব্যাংক বৃহস্পতিবার অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, ধারাবাহিকভাবে কমতে কমতে মার্চ মাসে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি ১১ দশমিক ২৮ শতাংশে নেমে এসেছে। এর অর্থ হলো- ২০২২ সালের মার্চের তুলনায় চলতি বছরের মার্চে বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা ব্যাংক খাত থেকে ১১দশমিক ২৮ শতাংশ বেশি ঋণ নিয়েছেন।
জানুয়ারিতে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১২ দশমিক ৬২ শতাংশ। ডিসেম্বরে ছিল ১২ দশমিক ৮৯ শতাংশ। নভেম্বরে ছিল ১৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ। অক্টোবর, সেপ্টেম্বর ও আগস্টে ছিল যথাক্রমে ১৩ দশমিক ৯১ শতাংশ, ১৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ ও ১৪ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ।
গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “কয়েক মাস ধরেই বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমছে। অথচ করোনার মধ্যেও এই ঋণ প্রবৃদ্ধি বাড়ছিল। করোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকার যে প্রণোদণা ঘোষণা করেছিল, তাতে এর অবদান ছিল। এ ছাড়া করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় দেশে বিনিয়োগের একটি অনুকূল পরিবেশও দেখা দিয়েছিল।
“পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু কর্ণফুলী টানেলসহ কয়েকটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলকে ঘিরে উদ্যোক্তারা নতুন পরিকল্পনা সাজিয়ে বিনিয়োগে নেমেছিলেন। ব্যাংকগুলোও তাতে বিনিয়োগ করছিল। সব মিলিয়ে বেসরকারি খাতের ঋণের একটি গতি এসেছিল। কিন্তু এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিয়েছে। ডলারের অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধির কারণে আমদানিকারকদের এলসি খুলতে বেশি টাকা লাগছে। তাতে ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেছে।’
হিসাব দিয়ে তিনি বলেন, “বিদায়ী অর্থবছরের শেষ মাস জুনে প্রকৃত ঋণ প্রবৃদ্ধি আরও কিছুটা কম হবে। কারণ বিশ্ববাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম এবং ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধিতে বেসরকারি খাতের ঋণের বড় অংশ চলে যাচ্ছে আমদানি খাতে। অর্থাৎ বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধির মূল কারণ অর্থনীতির বহিঃস্থ খাতের অস্থিরতা। ফলে আগামী দিনে উৎপাদন এবং কর্মসংস্থানে বড় নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।”
‘তবে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঠিক কাজটিই করছে’ মন্তব্য করে আহসান মনসুর বলেন, “আমদানি ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরাটা খুবই দরকার ছিল। সেটা সফল হওয়া গেছে বলে আমি মনে করি। এই কৃচ্ছ্রসাধন আরও কিছুদিন চালাতে হবে। বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) প্রবৃদ্ধির দিকে না তাকিয়ে মূল্যস্ফীতি সহনীয় রাখার দিকেই সবচেয়ে বেশি নজর দিতে হবে।
“সে ক্ষেত্রে আগামী কয়েক মাস যদি বেসরকারি খাত ঋণ কমও পায়, তাতেও খুব একটা সমস্যা হবে না। এখন আমাদের সংকট বা চাপ থেকে বের হয়ে আসার সময়। এ অবস্থায় যদি জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশও হয়, তাও আমি যথেষ্ট বলে মনে করি। কিন্তু মূল্যস্ফীতি যাতে কোনো অবস্থাতেই দুই অঙ্কের ঘর (ডাবল ডিজিট) অতিক্রম না করে, সেটার দিকে সজাগ থাকতে হবে।’
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে এপ্রিল মাসে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ। আগের মাস মার্চে এই হার ছিল ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ।
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরেছে ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে যা ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ ছিল। তবে অর্জিত হয় ১৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ। ২০২০-২১ অর্থবছর একই প্রাক্কলন থাকলেও ঋণ প্রবৃদ্ধি হয় ৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ। করোনা মহামারির কারণে চাহিদা হ্রাসের কারণে ঋণপ্রবাহে গতি কমে যায়।
২০২১ সালের আগস্ট থেকে দেশে আমদানি ব্যয় বাড়তে থাকে। বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়ে যায়। টাকার বিপরীতে ডলারের দর অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকে। ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমদানি ব্যয় কমিয়ে আনতে একটার পর একটা পদক্ষেপ নিতে শুরু করে। যার সুফল জুন থেকে পড়া শুরু করে। এখনো পাওয়া যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) ৫৮ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশ কম। এই নয় মাসে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে ৫৫ শতাংশেল বেশি। শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমেছে ৩০ শতাংশ। মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি কমেছে ৩০ দশমিক ৩২ শতাংশ। তবে জ্বালানি তেল আমদানিতে খরচ বেড়েছে ২৪ দশমিক ৫১ শতাংশ।
অন্যদিকে গত এক বছরে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে প্রায় ২৫ শতাংশ। বৃহস্পতিবার আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলারের জন্য ১০৮ টাকা খরচ করতে হয়েছে। এক বছর আগে ২০২২ সালের ৩১ মে লেগেছিল ৮৯ টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, টানা আট মাস ধরে বাড়তে বাড়তে ২০২২ সালের প্রথম মাস জানুয়ারিতে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি ১১ শতাংশ ছাড়িয়ে ১১ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশে উঠে যায়। তবে ফেব্রুয়ারিতে এই প্রবৃদ্ধি কমে ১০ দশমিক ৭২ শতাংশে নেমে আসে।
মার্চে তা দশমিক ৫৭ শতাংশ পয়েন্ট বেড়ে ১১ দশমিক ২৯ শতাংশে ওঠে। এপ্রিল মাসে তা ১২ শতাংশ ছাড়িয়ে ১২ দশমিক ৪৮ শতাংশে ওঠে। মে মাসে তা আরও বেড়ে ১২ দশমিক ৯৪ শতাংশ ওঠে। জুন মাসে ১৩ শতাংশ ছাড়িয়ে ১৩ দশমিক ৬৬ শতাংশে ওঠে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে তা আরও বেড়ে ১৩ দশমিক ৯৫ শতাংশে উঠেছিল। পরের মাস আগস্টে ১৪ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়।
কমেন্ট