সংসদে বিল: ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে বাংলাদেশ ব্যাংক
ফাইল ছবি
ব্যাংকে এক পরিবারের তিনজনের বেশি পরিচালক হতে পারবেন না, এমন বিধানের পাশাপাশি ব্যাংক খাতে পাহাড়সম খেলাপি ঋণের বোঝা কমাতে ‘ইচ্ছাকৃত’ ঋণ খেলাপিদের বিষয়ে কঠোর হওয়ার বিধান রেখে আনা ‘ব্যাংক কোম্পানি সংশোধন বিল’ সংসদে উঠেছে।
বিলে বলা হয়েছে, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।
সেইসঙ্গে আয়কর ব্যবস্থাপনা সহজ করতে এবং অর্থনীতি ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা আনতে আয়কর বিল-২০২৩ সংসদে উত্থাপিত হয়েছে।
বৃহস্পতিবার স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদের অধিবেশন শুরু হয়; পরে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বিল দুটি সংসদে তোলেন।
ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন বিলের উদ্দেশ্য ও কারণ সম্বলিত এক বিবৃতিতে অর্থমন্ত্রী বলেন, “আধুনিক ও সময়োপযোগী ‘ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১- এ কিছু সংশোধনের লক্ষ্যে বিলটি তোলা হয়েছে।”
বিলটি পরীক্ষার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়েছে। এজন্য সময় দেওয়া হয়েছে এক সপ্তাহ।
এর আগে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম বিলটি উত্থাপনে আপত্তি জানান, তখন স্পিকার ভোটে দিলে তার প্রস্তাব কণ্ঠ ভোটে নাকচ হয়।
ফখরুল ইমামের অভিযোগ, আইএমএফের শর্ত মেনে এই সংশোধনী আনা হচ্ছে। সংসদে কোনো কিছু গোপন করা উচিত না।
পাঁচ বছর আগে সংসদের ভেতরে ও বাইরে সমালোচনার মধ্যেই ২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারি ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে কোনো ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে একসঙ্গে এক পরিবারের চার সদস্য থাকার সুযোগ দেওয়া হয়; এর আগে যা ছিল দুজন।
এরপর ব্যাংক খাতের অনিয়ম দুর্নীতি নিয়ে ধারাবাহিক সমালোচনা এবং সুশাসন ফেরাতে বিভিন্ন মহলের দাবির প্রেক্ষাপটে আইনটি আবার সংশোধনের উদ্যোগ নেয় সরকার। ২০২১ সালের ১৭ মে এজন্য সংশোধনের খসড়ায় নীতিগত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা।
এবার পরিচালক সংখ্যা কমিয়ে আনা এবং ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থার বিধান করা হচ্ছে।
ফখরুল ইমামের বক্তব্যের জবাবে অর্থমন্ত্রী সংসদে বলেন, “কারও পরামর্শে এই সংশোধনী আনা হচ্ছে না। আধুনিক ও সময়োপযোগী ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কিছু সংশোধন আনা হচ্ছে।”
সংশোধিত বিলে বলা হয়েছে, কোনো ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে একটি একক পরিবারের সদস্যের বাইরে তার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বা নিয়ন্ত্রণাধীন সর্বোচ্চ দুটি প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির পক্ষে প্রতিনিধি পরিচালক থাকতে পারবে।
তবে কোনো ব্যাংকের পর্ষদে কোনো প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির পক্ষে একজনের বেশি ব্যক্তি প্রতিনিধি পরিচালক নিযুক্ত হতে পারবে না।
কোনো ব্যাংকের পর্ষদে প্রাকৃতিক ব্যক্তিস্বত্বা বিশিষ্ট ব্যক্তি শেয়ারহোল্ডারের পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি প্রতিনিধি পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত হতে পারবে না। অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি ব্যাংকের শেয়ারের মালিক হলে তার প্রতিনিধি হিসেবে অন্য কোনো ব্যক্তিকে পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যাবে না।
বিলে বলা হয়েছে, ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতা শনাক্ত করা ও চূড়ান্ত করার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুটি পৃথক কমিটি গঠন করবে।
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সময়ে সময়ে ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপির তালিকা বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠাবে।
তালিকা চূড়ান্ত হওয়ার পর ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান চাইলে ৩০ দিনের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকে আপিল করতে পারবে এবং এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবশেষ তথ্যে দেখা যায়, গত মার্চ মাস শেষে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা।
যদিও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবে এই পরিমাণ প্রায় তিন লাখ কোটি টাকা। কারণ সন্দেহজনক ঋণ, আদালতের আদেশে খেলাপি স্থগিতাদেশ থাকা ঋণ, রাইট অফ বা অবলোপন, পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন করা ঋণকেও তারা খেলাপি হিসেবে দেখাতে বলেছে।
বর্তমানে দেশের আদালতগুলোতেই খেলাপি ঋণের প্রায় পৌনে এক লাখ মামলা ঝুলে রয়েছে, যাতে এক লাখ ৬৬ হাজার কোটি টাকা আটকে রয়েছে।
আয়কর বিল উত্থাপন
সেইসঙ্গে আয়কর ব্যবস্থাপনা সহজ করতে এবং অর্থনীতি ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা আনার লক্ষ্যে সংসদে আয়কর বিল-২০২৩ উত্থাপিত হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বিলটি সংসদে তোলেন। বিলটি পরীক্ষা করে ৫ দিনের মধ্যে সংসদে প্রতিবেদন দিতে অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়েছে।
প্রস্তাবিত আইনে করবর্ষের শেষ তারিখে ৪০ লাখ টাকার বেশি সম্পদ থাকলে, বছরের কোনো সময়ে চিকিৎসা বা ধর্মীয় উদ্দেশ্য ব্যতিত ব্যক্তিগতভাবে বিদেশ ভ্রমণ করলে সম্পদ ও দায়ের বিবরণী জমা দেওয়া (রিটার্ন) বাধ্যতামূলক করার কথা বলা হয়েছে।
বিলটি উত্থাপনের বিরোধিতা করেন জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম। তবে তার বিরোধিতা কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়।
অর্থমন্ত্রী বলেন, “আয়কর ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে এই বিলটি আনা হয়েছে। বিলটি নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা হয়েছে। এরপরও সংসদীয় কমিটি ও সংসদে আলোচনার সুযোগ রয়েছে। বিলটি পাসের আগে সংযোজন ও বিয়োজনের মাধ্যমে যুগোপযোগী করা যাবে।”
কমেন্ট