সেই একই পথে সরকার, ব্যাংক থেকে দেদার ঋণ
প্রতিবারের মতো এবারও অর্থবছরের শেষ দিকে এসে প্রয়োজনীয় খরচ মেটাতে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে দেদার ঋণ নিচ্ছে সরকার। গত মে মাসেই ১৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে।
২০২২-২৩ অর্থবছর শেষ হবে ৩০ জুন। এই সময়ের মধ্যে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডসহ অন্য সব খরচের বকেয়া পরিশোধ করতে হয়। সে কারণে বাড়তি টাকার প্রয়োজন হয়। বাজেটে ধরা লক্ষ্যের চেয়ে রাজস্ব আদায় অনেক কম। সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে যাওয়ায় এ খাত থেকেও ঋণ নিতে পারছে না।
তাই সরকারের প্রয়োজনীয় খরচ মেটাতে এবং বকেয়া পরিশোধ করতে বাধ্য হয়ে সরকারকে ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নিতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন অর্তনীতিবিদরা।
তবে মে মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আগে নেওয়া ঋণের ২ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে করেছে সরকার।
সব মিলিয়ে বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১১ মাসে অর্থাৎ ২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের মে পর্যন্ত সরকার ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে মোট ৯২ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। যা বাজেটে লক্ষ্যমাত্রার ৮২ দশমিক ৬৮ শতাংশ। এরমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেই নিয়েছে ৭১ হাজার ৬১০ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল মাত্র ২ হাজার ১৪৬ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সরকার ২০ হাজার ৬৭৮ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে এই ঋণের অঙ্ক ছিল ৩০ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা।
বিদায়ী অর্থবছরের মূল বাজেটে ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ধরা হয়েছিল। সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে ১ লাখ ১৫ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা করা হয়েছে।
গত ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ৩২ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মত বাংলাদেশের অর্থনীতিও বেশ চাপের মধ্যে পড়েছে। বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ কমছেই। টাকার বিপরীতে ডলারের দর বেড়েই চলেছে। নানা চেষ্টা করেও ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না বাংলাদেশ ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত এক বছরের টাকার বিপরীতে ডলারের দর বেড়েছে ১৮ শতাংশের বেশি। রোববার আন্ত:ব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার ১০৮ টাকা ৫১ পয়সায় লেনদেন হয়েছে। এক বছরের আগে গত বছরের ৭ জুন এই দর ছিল ৯১ টাকা ৯৫ পয়সা।
ডলারের এই দর বাড়ায় পণ্য আমদানির খরচ অনেক বেড়ে গেছে। যার ফলে মূল্যস্ফীতির পারদও চড়ছে। এ অবস্থায় বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে বেশি ঋণ নেওয়ার কারণে পরিস্থিতি আরও খারাপ দিকে যাচ্ছে বলে সতর্ক করেছেন অর্থনীতিবিদরা।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “এটা সেই পুরনো সমস্যা। অর্থবছরের শেষ দিকে এসে তাড়াতাড়ি প্রকল্প শেষ করার তাগাদা থাকে। সে কারণে এ সব প্রকল্পে দ্রুত অর্থ ছাড় করতে হয়। অন্যদিকে আগে শেষ হওয়া প্রকল্পের কাজের পুরো বিল অর্থবছরের মধ্যেই ঠিকাদারদের শোধ করতে হয়। সে কারণে সরকারের খচর হঠাৎ করে বেড়ে যায়। সেই ব্যয় মেটাতেই ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হয় সরকারকে।”
তিনি বলেন, ‘অন্যান্যবারের চেয়ে এবার অর্থবছরের শেষ দিকে এসে ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নিতে হচ্ছে; কারণ সুদের হার কমানোয় ও নানা কড়াকড়ি আরোপের কারণে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে গেছে। সেখান থেকে কোনো ঋণ পাচ্ছে না সরকার; পুরোপুরি নির্ভর করতে হচ্ছে ব্যাংক ব্যবস্থার উপর।”
আরেক অর্থনীতিবিদ বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “বাজেট ঘাটতি মেটাতে বাধ্য হয়েই সরকারকে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে। রাজস্ব আদায় লক্ষ্যের চেয়ে অনেক কম। সঞ্চয়পত্র থেকে এক টাকাও ঋণ পাচ্ছে সরকার। এখন তো কিছু করার নেই। দেশ পরিচালনা করতে গেলে তো টাকা লাগবেই। তাই ব্যাংকের দারস্ত হয়েছে সরকার।”
“কপাল ভালো যে, সংকটের এই সময়ে ব্যাংকগুলোর ঋণের চাহিদা নেই। সে কারণে ব্যাংক থেকে ঋণ পাচ্ছে সরকার। ব্যাংকগুলোও কিছু সুদ পাচ্ছে।”
তিনি বলেন, “সরকার এতদিন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নিচ্ছিল। এটা মোটেও ভালো সিদ্ধান্ত ছিল না। কেননা, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নিলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। এখন অবশ্য সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণের চেয়ে তফসিলি ব্যাংক থেকে ঋণের পরিমাণ বাড়িয়েছে। এটা একটা ভালো সিদ্ধান্ত বলে আমি মনে করি।”
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “গত কয়েক মাসে ব্যাংকগুলোর আমানতের পরিমাণ বেড়েছে। সে কারণে সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া বাড়িয়েছে। এছাড়া বেসরকারি খাতের ঋণের চাহিদা কমে যাওয়ায় ব্যাংকগুলো সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ করছে।”
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, গত মে মাসে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি বা মাসভিত্তিক) মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০ শতাংশ, ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ। আর ১২ মাসের গড় হিসাবে (২০২২ সালের জুন থেকে ২০২৩ সালের মে) সূচক দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ।
অন্যদিকে বিদায়ী অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) রাজস্ব আদায়ে ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও বাজেটে ধরা লক্ষ্যের চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা আছে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। ১০ মাসে আদায় হয়েছে ২ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা। যা লক্ষ্যমাত্রার ৬৭ শতাংশ।
সুদের হার হ্রাস এবং নানা কড়াকড়ি আরোপের কারণে সঞ্চয়পত্র থেকে কোনো ঋণ নিতে পারছে না সরকার। উল্টো কোষাগার থেকে অথবা ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের টাকা দিয়ে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধ করতে হচ্ছে।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি ছিল ৩ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা ঋণাত্মক (-)। অর্থাৎ এই অর্থ সরকারের কোষাগার থেকে গ্রাহকদের পরিশোধ করতে হয়েছে।
অথচ গত ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে ১৭৫১৯ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল সরকার।
বিদায়ী বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ধরেছিল সরকার।
কমেন্ট