আইএমএফের শর্ত পূরণের মুদ্রানীতি আসছে রোববার

আইএমএফের শর্ত পূরণের মুদ্রানীতি আসছে রোববার

১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হবে ১৮ জুন রোববার। এই মুদ্রানীতি হবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত পূরণের মুদ্রানীতি।

৪৭০ কোটি (৪.৭ বিলিয়ন) ডলার ঋণের বিপরীতে ঋণদাতা সংস্থাটি যে সব সংস্কারের শর্ত দিয়েছিল, সেগুলো বাস্তবায়ন করা হবে নতুন এই মুদ্রানীতির মাধ্যমে।

এটি হবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের দ্বিতীয় মুদ্রানীতি। দায়িত্ব নেওয়ার পর জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে ৩০ জুন শেষ হতে যাওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছিলেন তিনি। যার মাধ্যমে আবারও বছরে দুবার মুদ্রানীতি ঘোষণার পুরোনো পথে ফিরে আসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এবার অর্থবছর শুরু হওয়ার দুই সপ্তাহ আগেই মুদ্রানীতি ঘোষণা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যতোদিন অর্থবছরে (জুলাই-জুন) একটি মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছে, অর্থবছর শুরু হওয়ার পর জুলাই মাসের শেষের দিকে ঘোষণা করা হয়েছে।

শুধুমাত্র একবার সাবেক গভর্নর ফজলে কবির তার বিদায়ের আগে ২০২২ সালের ৩০ জুন ২০২২-২৩ অর্থবছর শুরু হওয়ার আগের দিন মুদ্রাননীতি ঘোষণা করেছিলেন। গভর্নর হিসেবে ফজলে কবিরের মেয়াদ ৩ জুলাই শেষ হয়। বিদায়ের তিন দিন আগে তিনি ওই মুদ্রানীতি দিয়ে গিয়েছিলেন।

আর যখন এক অর্থবছরে দুটি মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হতো, তখন অর্থবছর শুরু হওয়ার পর জুলাই মাসের শেষের দিকে (জুলাই-ডিসেম্বর) মেয়াদের মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হতো। আর দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হতো জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে।

এবার ভিন্ন পেক্ষাপটে মুদ্রানীতি ঘোষণা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অনেক আলোচনার পর গত ৩০ জানুয়ারি বহুল প্রতিক্ষিত ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে রাজি হয় আইএমএফ। তিন দিনের মাথায় ২ ফেব্রুয়ারি সেই ঋণের প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার ছাড় করে সংস্থাটি।

ঋণের বাকি অর্থ পাওয়া যাবে তিন বছরে অর্থাৎ ছয়টি সমান কিস্তিতে ৩৬ মাসে। দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়া যাবে এ বছরের ডিসেম্বরে আর শেষ কিস্তি পাওয়া যাবে ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে। এসব কিস্তির পরিমাণ ৭০ কোটি ৪০ লাখ ডলার করে।

৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ পেতে আইএমএফের ৩০টি শর্তে রাজি হয়েছে বাংলাদেশ। শর্তগুলো ৩টি বিভাগের অধীনে-গুণগত মান উন্নয়ন সংক্রান্ত শর্ত (কিউপিসি), অবকাঠামোগত মান উন্নয়ন সংক্রান্ত শর্ত (এসপিসি) এবং সাধারণ প্রতিশ্রুতি।

ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ওয়াশিংটন-ভিত্তিক ঋণদাতা সংস্থাটি ৩টি বাধ্যতামূলক শর্ত দিয়েছে। সেই শর্তগুলো হলো-নেট আন্তর্জাতিক রিজার্ভ ও অভ্যন্তরীণ রাজস্ব সংগ্রহের একটি ন্যূনতম স্তর নির্ধারণ এবং সরকারের বাজেট ঘাটতির ঊর্ধ্বসীমা নির্ধারণ।

আইএমএফ বিভিন্ন কিস্তিতে অর্থ দেওয়ার আগে সরকারকে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট কিউপিসির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হবে। কিউপিসির ৩টি লক্ষ্যমাত্রা প্রতিটি কিস্তির সঙ্গে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাবে।

আইএমএফের দেওয়া শর্তগুলোর মধ্যে আরও রয়েছে— ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করা, আদায়ের অযোগ্য ঋণ বিষয়ে আলাদা কোম্পানি গঠন করা, জ্বালানির মূল্য নির্ধারণে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী ফর্মুলা কার্যকর করা, আয়কর আইন সংসদে পাস করা, করছাড়ের ওপর বিস্তারিত নিরীক্ষা করা, বাজেটের নির্দিষ্ট অংশ সামাজিক ব্যয়ের (শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষা কমূর্সচি) জন্য রাখা এবং ক্রমান্বয়ে তা বাড়ানো।

এ সব শর্তের কয়েকটি ইতোমধ্যেই বাস্তবায়ন শুরু করে দিয়েছে সরকার। ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন বিল ও নতুন আয়কর আইন সংসদে উঠেছে। রিজার্ভের নিট হিসাব জুলাই থেকে প্রকাশ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়া প্রতি মাসে গ্যাস-বিদুতের দাম সমন্বয় শুরু করা হয়েছে। তিন মাস পর জিডিপি প্রবৃদ্ধির হিসাব প্রকাশসহ আরও কিছু শর্ত পূরণের কাজও দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে।

সরকার চাচ্ছে, এই সংকটের সময়ে কোনো অবস্থাতেই যাতে আইএমএফের বাকি ছয় কিস্তি আটকে না যায়। সে কারণে সরকারের নির্দেশনার আলোকে আইএমএফের শর্তের বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়েই রোববার নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এ প্রসঙ্গে অর্থনীতির গবেষক বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “আমাদের একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, আইএমএফ যে সসব শর্ত বা সংস্কারের কথা বলছে, সেগুলো কিন্তু আমাদের নিজেরে স্বার্থে অনেক আগেই বাস্তবায়ন করা উচিৎ ছিল। তাদের এ সব শর্ত একটাও নতুন নয়। এ সব সংস্কারের কথা আমরা দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছি। এখন যদি আইএমএফের কথামতো এগুলো বাস্তবায়ন করি, তাহলে আমাদের জন্যই মঙ্গল হবে বলে আমি মনে কির।”

চলমান ঋণেও বাড়বে সুদহার

নতুন মুদ্রানীতিতে ব্যাংক ঋণে বিদ্যমান ৯ শতাংশ সুদহারের সীমা তুলে দিয়ে নতুন ব্যবস্থা চালু করা হবে। এর ফলে সুদহার কিছুটা বাড়বে। নতুন সুদহার শুধু নতুন ঋণে কার্যকর হবে তেমন নয়, চলমান ঋণেও গুনতে হবে বাড়তি সুদ।

এবার মুদ্রানীতির কাঠামোতে বেশ পরিবর্তন আনা হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি কমাতে ঋণ সংকোচনমূলক নীতির দিকে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ঋণ প্রবাহে বাড়তি সতর্কতা থাকবে এবং সুদহার বাড়ানোর কৌশল থাকবে নতুন মুদ্রানীতিতে।

মুদ্রানীতি প্রণয়ণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, নতুন সুদহার ব্যবস্থা হলো ‘স্মার্ট’ তথা শর্ট টার্ম মুভিং এভারেজ রেট। ১৮২ দিন মেয়াদি সরকারি ট্রেজারি বিলের ৬ মাসের গড় সুদের সঙ্গে আপাতত সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ করিডোর বা সীমা দেওয়া থাকবে।

বর্তমানে ট্রেজারি বিলের গড় সুদহার ৭ শতাংশের নিচে রয়েছে। এর মানে গ্রাহক পর্যায়ে ঋণের সুদহার হবে ১০ শতাংশের মতো। আর ট্রেজারি বিলের সুদহার বাড়লেই গ্রাহক পর্যায়ে সুদ বেড়ে যাবে তেমন না। আবার কমলেই কমবে না। কেননা আপাতত ৩ শতাংশ করিডোর দেওয়া হলেও এটা বাড়বে বা কমবে। জানা গেছে, সুদহার ১০ শতাংশের আশপাশে রাখতে চায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ঋণের সুদহার পুরোপুরি বাজারভিত্তিক হচ্ছে না। একটা নতুন পদ্ধতি চালু হচ্ছে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় সুদহার পুরো বাজারভিত্তিক করলে তার সম্ভাব্য চাপের বিষয়টি আইএমএফকে বলা হয়েছে।

আইএমএফের ঋণের অন্যতম শর্ত সুদহার বাজারভিত্তিক করতে হবে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেবে না। আবার এখনকার মতো নির্দিষ্ট সীমা রাখবে না। কেননা কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে, পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করলে সুদ অনেক বাড়বে। এর ফলে মূল্যস্ফীতির ওপর আরও চাপ তৈরি হতে পারে।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “আমানতের সুদহার বাড়লেও ৯ শতাংশ সীমার কারণে ঋণের সুদ বাড়ানো যাচ্ছে না। যে কারণে ব্যাংক খাতের ঋণ-আমানতের মধ্যকার সুদহারের ব্যবধান ৩ শতাংশের নিচে নেমেছে। এর মধ্যে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বাড়ছে। ব্যাংকের নিট সুদ আয় টেকসই করতে নতুন ব্যবস্থা ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।”

জানা গেছে, ছয় মাস মেয়াদি ট্রেজারি বিলের গড় সুদহার প্রতি মাসের ১ তারিখে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেট ম্যানেজমেন্ট বিভাগ ওয়েবসাইটে ঘোষণা দেবে। আবার করিডোর রেটে কোনো পরিবর্তন এলে তাও ওয়েবসাইটে দেওয়া হবে। এর আলোকে ব্যাংকগুলো গ্রাহক পর্যায়ে সর্বোচ্চ সুদহার নির্ধারণ করতে পারবে।

অবশ্য সুদহারের সর্বোচ্চ সীমা বাড়লে সবার ঋণের খরচ নাও বাড়তে পারে। কেননা কোনো ব্যাংক ওই সীমা অতিক্রম করতে পারবে না। তবে চাইলে নিচে থাকতে পারবে। সাধারণভাবে বড় গ্রাহকরা সর্বোচ্চ সীমার অনেক কমে ঋণ পান। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ছোটদের জন্য সর্বোচ্চ সীমা প্রযোজ্য হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা এআরএইচ ডটকমকে বলেন, ২০২০ সালে সুদহারে সর্বোচ্চ সীমা ৯ শতাংশ নির্ধারণের সময় বিদ্যমান ঋণেও তা কার্যকর করতে বলা হয়েছিল। এবারও বিদ্যমান ঋণসহ সব ক্ষেত্রে নতুন সুদহার ব্যবস্থা কার্যকর হবে।

উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, কোনো গ্রাহক ৫ বছর মেয়াদি একটি ঋণ নিয়েছেন। গত তিন বছর ধরে তিনি হয়তো ৯ শতাংশ হারে কিস্তি দিয়ে আসছেন। এখন দুই বছরের কিস্তি নতুন সুদহার অনুযায়ী দিতে হবে। এর ফলে সুদহার সামান্য বাড়বে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার আলোকে ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে  নিয়ন্ত্রিত সুদহার ব্যবস্থা চালু হয়। এর আগে অনেক দিন ধরে রপ্তানি ও কৃষি খাত ছাড়া অন্য ক্ষেত্রে সুদহার ছিল বাজারভিত্তিক। আইএমএফের পরামর্শে মুক্তবাজার অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ১৯৮৯ সাল সুদহার নির্ধারণের ক্ষমতা ব্যাংকগুলোর হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়।

তবে বৈশ্বিক মন্দা-পরবর্তী ২০০৯ সালে সুদহারের সীমা আরোপ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মন্দা-পরবর্তী ২০১১ সালের মার্চে আংশিক সীমা প্রত্যাহার হয়। ২০১২ সালে প্রি-শিপমেন্ট রপ্তানি ও কৃষি ছাড়া অন্য সব ঋণে সুদহারের ঊর্ধ্বসীমা তুলে দেওয়া হয়।

তারল্য সংকটের কারণে ২০২০ সালে শিল্প খাতেই সুদহার উঠে যায় ১৫ শতাংশ। এর পর বিভিন্ন উপায়ে সুদহার কমানোর চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত সার্কুলারের মাধ্যমে ৯ শতাংশ ঊর্ধ্বসীমা দেওয়া হয়।

আন্তঃব্যাংক লেনদেনেও করিডোর

নতুন মুদ্রানীতিতে আন্তঃব্যাংক লেনদেনে সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ সীমা বা করিডোর দেওয়া হবে। নির্ধারিত করিডোরের বাইরে এক ব্যাংক আরেক ব্যাংক থেকে ধার নিতে পারবে না। আবার কোনো ব্যাংক সর্বনিম্ন সুদহারের নিচে নামতে পারবে না। সর্বনিম্ন রেটেও বাজারে ধার নেওয়ার মতো কোনো ব্যাংক না থাকলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নেবে।

 

 

সিমেন্ট: ক্লিংকারের আমদানি শুল্ক ২০০ টাকা করার দাবি পরবর্তী

সিমেন্ট: ক্লিংকারের আমদানি শুল্ক ২০০ টাকা করার দাবি

কমেন্ট