মোবাইলে প্রতিদিন ৪১৬৫ কোটি টাকার লেনদেন
ফাইল ছবি
২০১৮ সালের ডিসেম্বরে মোবাইলের মাধ্যমে ৩২ হাজার ১১৬ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছিল। দৈনিক গড়ে লেনদেনের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৭০ কোটি টাকা। এর পর থেকে বেড়েই চলেছে ব্যাংকিং সেবায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা মোবাইলে টাকা লেনদেনের অঙ্ক।
আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গত এপ্রিল মাসে সেই লেনদেন ১ লাখ ২৪ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকায় উঠেছে। প্রতিদিন গড়ে লেনদেন হয়েছে ৪ হাজার ১৬৫ কোটি টাকা।
এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, গত সাড়ে চার বছরে মোবাইলে আর্থিক সেবা বা এমএফএসের মাধ্যমে লেনদেন প্রায় বেড়েছে প্রায় চার গুণ। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে গ্রাহকও।
সাড়ে চার বছর আগে এমএফএসে গ্রাহক হিসাব ছিল ৬ কোটি ৭৬ লাখ ৭০ হাজার ৪৬৮। এপ্রিলে সেই গ্রাহক সংখ্যা বেড়ে ২০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বৃহস্পতিবার মোবাইলের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেনের হালনাগাদ এই তথ্য প্রকাশ করেছে।
এই তথ্যই বলছে, দেশের অর্থনীতিতে কতটা অবদান রাখছে মোবাইল আর্থিক সেবা-এমএফএস। সরকারের নীতিনির্ধারক, অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার, ছোট-বড় ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে একজন রিকশাচালকও অকপটে স্বীকার করবেন ‘এমএফএস ছাড়া আমার চলেই না!’
এক কথায় বলা যায়, ব্যাংকিং সেবায় বৈপ্লবিক এক পরিবর্তন এনেছে মোবাইল ব্যাংকিং। সব লেনদেন এখন নিমিষেই।
কেবল টাকা পাঠানোই নয়, দেশের অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করেছে মোবাইল ব্যাংকিং। বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানির বিল অর্থাৎ সেবামূল্য পরিশোধ, বেতন-ভাতা প্রদান, বিদেশ থেকে টাকা পাঠানো অর্থাৎ প্রবাসী-আয় বা রেমিটেন্স পাঠানোর ক্ষেত্রে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা এখন অন্যতম পছন্দের মাধ্যম।
এই সেবার কারণে বেড়েছে নতুন কর্মসংস্থান। সবকিছু চলে এসেছে হাতের মুঠোয়। সময় বেঁচেছে এবং ঝুঁকিও কমেছে। মোবাইল ব্যাংকিং এখন শুধু টাকা-পয়সা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পাঠানোর কাজেই সীমাবদ্ধ নেই। গ্রাহকদের জন্য প্রতিনিয়তই নতুন নতুন সেবা নিয়ে আসছে তারা।
এখন পর্যন্ত এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে মোবাইল ফোনের এয়ার টাইম, ইন্স্যুরেন্সের টাকা, বিভিন্ন ধরনের বিল এবং পাওনা পরিশোধ করা যাচ্ছে।
বাংলাদেশে মোবাইলের মাধ্যমে আর্থিক সেবার যাত্রা শুরু হয় ২০১১ সালের ৩১ মার্চ। বেসরকারি খাতের ডাচ্-বাংলা ব্যাংক প্রথম এ সেবা চালু করে। পরে এটির নাম বদলে হয় রকেট। এরপর ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে এমএফএস সেবা চালু করে বিকাশ।
পরবর্তী সময়ে আরও অনেক ব্যাংক এ সেবায় এসেছে। তবে খুব সুবিধা করতে পারেনি। বর্তমানে বিকাশ, রকেটের পাশাপাশি মাই ক্যাশ, এম ক্যাশ, উপায়, শিওর ক্যাশসহ ১৫টি ব্যাংক এ সেবা দিচ্ছে। এর বাইরে ডাক বিভাগের সেবা নগদও দিচ্ছে এই সেবা।
দেশের জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ এখন এসব সেবার গ্রাহক। সারা দেশে এসব সেবায় নিবন্ধন হয়েছে ২০ কোটি বেশি। যদিও সক্রিয় ব্যবহারকারীর হিসাব সাড়ে ৭ কোটির মতো। ১২ কোটি প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের দেশে এই সংখ্যা নেহাত কম নয়।
এখন মোবাইল ব্যাংকিং শুধু টাকা পাঠানোর মাধ্যম না। এর ব্যবহার হচ্ছে সব ধরনের লেনদেনে। বিশেষ করে পরিষেবা বিল পরিশোধ, স্কুলের বেতন, কেনাকাটা, সরকারি ভাতা, টিকিট ক্রয়, বিমার প্রিমিয়াম পরিশোধ, মোবাইল রিচার্জ ও অনুদান প্রদানের অন্যতম মাধ্যম।
আর মোবাইল ব্যাংকিংয়ে টাকা জমা করতে এখন আর এজেন্টদের কাছেও যেতে হচ্ছে না। ব্যাংক বা কার্ড থেকে সহজেই টাকা আনা যাচ্ছে এসব হিসাবে। আবার এসব হিসাব থেকে ব্যাংকেও টাকা জমা শুরু হয়েছে, ক্রেডিট কার্ড বা সঞ্চয়ী আমানতের কিস্তিও জমা দেয়া যাচ্ছে। এর ফলে একটি মুঠোফোনই যেন একেকজনের কাছে নিজের ব্যাংক হয়ে উঠেছে।
এমএফএস লেনদেন বাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে দেশের সবচেয়ে বড় মোবাইল আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ‘বিকাশ’-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কামাল কাদীর এআরএইচ ডটকমকে বলেন, ‘সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে এবং আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী মোবাইল আর্থিক সেবা দেশের মানুষের দৈনন্দিন আর্থিক লেনদেনকে প্রযুক্তিনির্ভর করে সহজ, নিরাপদ এবং তাৎক্ষণিক করেছে।”
“সামগ্রিক অর্থনীতি ও জীবনযাত্রার মানের ওপর যার ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে। আগামীর স্মার্ট বাংলাদেশে ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল ইকোসিস্টেম শক্তিশালী করার মাধ্যমে ক্যাশলেস সমাজ নির্মাণেও এই খাত ভূমিকা রাখবে,” বলেন বিকাশ প্রধান।
লেনদেনের পাশাপাশি গ্রাহকও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে মোবাইলের মাধ্যমে ৩৪ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছিল। তখন গ্রাহক সংখ্যা ছিল ৬ কোটি ৭৬ লাখ ১৩ হাজার ৬৮৭। এরপর থেকে লেনদেনের অঙ্ক ও গ্রাহক সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
২০২০ সালের জানুয়ারিতে লেনদেন হয় ৪৫ হাজার ৬ কোটি টাকা; গ্রাহক সংখ্যা বেড়ে হয় ৯ কোটি ৯ লাখ ২৩ হাজার ৫৪২।
২০২১ সালের জানুয়ারিতে লেনদেন বেড়ে হয় ৬২ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা; গ্রাহক সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১২ কোটি ৫১ লাখ ১৬ হাজার ২২৩।
২০২২ সালের জানুয়ারিতে লেনদেন হয় ৮৪ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা; গ্রাহক সংখ্যা বেড়ে হয় ১৭ কোটি ৩২ লাখ ৬৭ হাজার ৯৭২।
গত বছরের এপ্রিলে লেনদেন হয়েছিল ১ লাখ ৭ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা। একক মাসের হিসাবে যা ছিল এতোদিন তৃতীয় সর্বোচ্চ লেনদেন; ওই মাসে গ্রাহক সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৭ কোটি ২৯ লাখ ৩৭ হাজার ২৯৪।
এর পরের মাসগুলোতে অবশ্য লেনদেন কমে আসে; তবে হিসাব বা গ্রাহক সংখ্যা বেড়েই চলেছে। মে মাসে লেনদেন হয় ৭৬ হাজার ৩১২ কোটি টাকা। জুনে তা বেড়ে ৯৪ হাজার ২৯৩ কোটি টাকায় উঠে। জুলাইয়ে লেনদেন হয় ৮৯ হাজার ১৬৯ কোটি টাকা। আগস্টে হয় ৮৭ হাজার ৪৪৬ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বরে লেনদেন হয় যথাক্রমে ৮৭ হাজার ৬৩৫, ৯৩ হাজার ১৩, ৯২ হাজার ১২৫ এবং ৯৬ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে মোবাইল আর্থিক সেবার মাধ্যমে ১ লাখ ৫৯৩ কোটি টাকা লেনদেন হয়; গ্রাহক সংখ্যা বেড়ে হয় ১৯ কোটি ৪১ লাখ ২৫ হাজার ১৩৭। পরের মাস ফেব্রুয়ারিতে লেনদেন কমে ৯৭ হাজার ৩০৭ কোটি টাকায় নেমে আসে। তবে গ্রাহক সংখ্যা বেড়ে হয় ১৯ কোটি ৬৭ লাখ ৫৯ হাজার ১৭১।
মার্চ মাসে লেনদেন বেড়ে ১ লাখ ৮ হাজার ৪৬৭ কোটি টাকায় উঠে; মোট হিসাব সংখ্যা বেড়ে হয় ১৯ কোটি ৮০ লাখ ৯১ হাজার ৭৮৩টি।
সবশেষ এপ্রিল মাসে লেনদেন এক লাফে বেড়ে ১ লাখ ২৪ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকায় উঠেছে।
তবে এপ্রিল মাসে গ্রাহক সংখ্যা বেড়ে কতো হয়েছে তা বৃহস্পতিবার আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাধে বৗ্যাংকের এক কর্মকর্তা এআরএইচ ডটকমকে জানিয়েছেন, গ্রাহক সংখ্যা ইতোমধ্যে ২০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি এখন এমএফএস। শহর থেকে গ্রামে বা গ্রাম থেকে শহরে তাৎক্ষণিকভাবে টাকা পাঠানোর সুবিধার কারণে এই সেবা দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সেবার ওপর মানুষের নির্ভরতা বেড়েছে। ফলে বাড়ছে গ্রাহক ও লেনদেন।
কমেন্ট