নতুন মুদ্রানীতি: মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে বাড়ছে নীতি সুদহার

নতুন মুদ্রানীতি: মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে বাড়ছে নীতি সুদহার

ফাইল ছবি

মূল্যস্ফীতির পারদ চড়ছেই; একলাফে অর্থনীতির স্পর্শকাতর এই সূচক প্রায় দুই অঙ্কের ঘরে (ডাবল ডিজিট) পৌঁছেছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মূল্যস্ফীতির সবশেষ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, মে মাসে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি বা মাসভিত্তিক) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ। আগের মাস এপ্রিলে এই হার ছিল ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ।

এর অর্থ হলো ২০২২ সালের মে মাসে দেশের মানুষ যে পণ্য বা সেবা ১০০ টাকায় পেয়েছিল, এই বছরের মার্চে তা কিনতে ১০৯ টাকা ৯৪ পয়সা খরচ করতে হয়েছে।

এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে রোববার নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) এই মুদ্রানীতিতে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রার দিকে না তাকিয়ে  অর্নের চেয়ে মূল্যস্ফীতি কমানোর দিকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলে মুদ্রানীতি প্রণয়ণের সঙ্গে জড়িত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ হাবিবুর রহমান এআরএইচ ডটকমকে বলেছেন, “মুদ্রানীতির অন্যতম প্রধান লক্ষ্য থাকে মূল্যস্ফীতি সহনীয় রাখা। বৈশ্বিক কারণে পৃথিবীর সব দেশের মত বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতিও ঊর্ধ্বমূখী। সে কারণে নতুন মুদ্রানীতিতে অবশ্যই এই বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হবে।”

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, মুদ্রানীতির কাঠামোতে পরিবর্তন আনা হচ্ছে। নতুর মুদ্রানীতির কেন্দ্রে থাকবে সুদহার। এর লক্ষ্যমাত্রা থাকবে সুদহারকেন্দ্রিক। এবারের মুদ্রানীতিতে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের চেয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ বেশি গুরুত্ব পাবে। এ জন্য নীতি সুদহার তথা রেপো ও রিভার্স রেপোর সুদ বাড়তে পারে। এ ছাড়া গ্রাহক পর্যায়ে ৯ শতাংশ সুদহারের সীমা তুলে নতুন ব্যবস্থার ঘোষণা আসছে।

রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকের সভাকক্ষে জুলাই-ডিসেম্বর মেয়াদের এই মুদ্রানীতি ঘোষণা করবেন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।

এটি হবে বর্তমান গভর্নরের দ্বিতীয় মুদ্রানীতি। দায়িত্ব নেওয়ার পর জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে ৩০ জুন শেষ হতে যাওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছিলেন তিনি। যার মাধ্যমে আবারও বছরে দুবার মুদ্রানীতি ঘোষণার পুরোনো পথে ফিরে আসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এবার অর্থবছর শুরু হওয়ার দুই সপ্তাহ আগেই মুদ্রানীতি ঘোষণা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যতোদিন অর্থবছরে (জুলাই-জুন) একটি মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছে, অর্থবছর শুরু হওয়ার পর জুলাই মাসের শেষের দিকে ঘোষণা করা হয়েছে।

শুধুমাত্র একবার সাবেক গভর্নর ফজলে কবির তার বিদায়ের আগে ২০২২ সালের ৩০ জুন ২০২২-২৩ অর্থবছর শুরু হওয়ার আগের দিন মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছিলেন। গভর্নর হিসেবে ফজলে কবিরের মেয়াদ ৩ জুলাই শেষ হয়। বিদায়ের তিন দিন আগে তিনি ওই মুদ্রানীতি দিয়ে গিয়েছিলেন।

আর যখন এক অর্থবছরে দুটি মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হতো, তখন অর্থবছর শুরু হওয়ার পর জুলাই মাসের শেষের দিকে প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) মেয়াদের মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হতো। আর দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হতো জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে।

এবার ভিন্ন পেক্ষাপটে মুদ্রানীতি ঘোষণা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অনেক আলোচনার পর গত ৩০ জানুয়ারি বহুল প্রতিক্ষিত ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে রাজি হয় আইএমএফ। তিন দিনের মাথায় ২ ফেব্রুয়ারি সেই ঋণের প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার ছাড় করে সংস্থাটি।

আইএমএফের ঋণের শর্তের কারণেই আবার এক অর্থবছরে দুটি মুদ্রানীতিতে ফিরে গেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর এবারের মুদ্রানীতিতে যেসব পরিবর্তন আসছে তার বেশিরভাগই হচ্ছে আইএমএফের শর্ত পরিপালনের জন্য।

বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বশেষ চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি ব্যাংকগুলোর কাছে ধারের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত পুনঃক্রয় চুক্তির (রেপো) সুদহার ২৫ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়িয়ে ৬ শতাংশ নির্ধারণ করে। আর ব্যাংক থেকে টাকা তোলার ক্ষেত্রে বিপরীত পুনঃক্রয় চুক্তি (রিভার্স রেপো) সুদ বেসিস পয়েন্ট ২৫ বাড়িয়ে ৪ দশমিক ২৫ শতাংশ করে।

করোনার প্রভাব শুরুর পর রেপো ও রিভার্স রেপোর সুদহার অনেক কমানো হয়। গত বছরের মে মাসের আগ পর্যন্ত রেপোর সুদহার ছিল ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ। সেখান থেকে কয়েক দফায় বাড়ানো হয়।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বিশ্বব্যাপী চার ধরনের লক্ষ্যমাত্রাভিত্তিক মুদ্রানীতি প্রচলতি। এগুলো হলো–সুদহার, মূল্যস্ফীতি, মুদ্রা সরবরাহ এবং বিনিময় হার। বাংলাদেশ ব্যাংক এত দিন ‘মূল্যস্ফীতি টার্গেটিং’মুদ্রানীতি প্রণয়ন করে আসছিল। তবে আইএমএফের পরামর্শে এবারে ‘সুদহার টার্গেটিং’ মুদ্রানীতি ঘোষণা করতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে সরকার মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের মধ্যে আটকে রাখার লক্ষ্য ধরেছে। আর জিডিপি প্রবৃদ্ধি (অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি) ৭ দশমিক ৫ শতাংশ অর্জনের আশা করা হয়েছে।

বর্তমান বাস্তবতায় যা বাস্তবায়নযোগ্য নয় বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। বাংলাদেশ ব্যাংকও মনে করে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে না।

ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ লাখ কোটি টাকা

ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ প্রায় এক লাখ কোটি টাকায় গিয়ে পৌঁছেছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে এমনিতে মানুষের সঞ্চয় ক্ষমতা কমেছে। সঞ্চয়পত্র যে পরিমাণ বিক্রি হচ্ছে, ভাঙাচ্ছে তার চেয়ে বেশি।

আবার অব্যাহতভাবে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির কারণে বাজার থেকে প্রচুর টাকা উঠে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। এর মধ্যে সরকারের ঋণ দ্রুত বাড়ছে।

৩০ জুন শেষে হতে যাওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের গত ৬ জুন পর্যন্ত ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণেল পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৭ হাজার ৯৪ কোটি টাকা। এই ঋণের মধ্যে ৭৬ হাজার ১১৭ কোটি টাকা সরবরাহ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো দিয়েছে ২০ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা।

এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে সরকারের সর্বোচ্চ ঋণ ছিল ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা।

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর হাতে ঋণযোগ্য তহবিল কম থাকায় অভ্যন্তরীণ উৎসে সরকারের ঋণ চাহিদার বেশিরভাগই মেটাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বিদায়ী অর্থবছরের মূল বাজেটে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে এক লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। তবে সংশোধিত বাজেটে সেই লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে এক লাখ ১৫ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা করা হয়েছে।

নতুন বাজেটে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা।

নতুন ব্যবস্থায় বাড়বে সুদ

নতুন মুদ্রানীতিতে বিদ্যমান ৯ শতাংশ সুদহারের সীমা তুলে দিয়ে নতুন ব্যবস্থা চালু করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন সুদহার ব্যবস্থার নাম হবে ‘স্মার্ট’তথা ‘শর্ট টার্ম মুভিং এভারেজ রেট’।

১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের ৬ মাসের গড় সুদের সঙ্গে আপাতত সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ করিডোর যোগ হয়ে গ্রাহক পর্যায়ে সুদহার হিসাব করবে ব্যাংক। বর্তমানে ট্রেজারি বিলের গড় সুদহার ৭ শতাংশের নিচে রয়েছে। এতে গ্রাহক পর্যায়ে সুদহার হবে ১০ শতাংশের মতো।

নতুন ঋণ বিতরণের পাশাপাশি বিদ্যমান ঋণেও এ ব্যবস্থা কার্যকর হবে। সুদহার যেন অনেক না বাড়ে, সে জন্য করিডোর রেট বাড়ানো-কমানো হবে। গ্রাহকের পাশাপাশি আন্তঃব্যাংক লেনদেনেও সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ সুদের একটি করিডোর দেওয়া হবে।

ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ে সফট ব্যাংককে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক পূর্ববর্তী

ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ে সফট ব্যাংককে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক

ডিজিটাল ব্যাংক: শাখা উপশাখা বুথ থাকবে না পরবর্তী

ডিজিটাল ব্যাংক: শাখা উপশাখা বুথ থাকবে না

কমেন্ট