মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা

মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা

রাজধানীর মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্মেলন কক্ষে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার জুলাই-ডিসেম্বর মেয়াদের মুদ্রানীতি ঘোষণা করছেন। ছবি: এআরএইচ ডটকম

চড়তে থাকা মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন মুদ্রানীতিতে রেপো হার বাড়ানো হয়েছে। ব্যাংক ঋণে বেঁধে দেওয়া ৯ শতাংশ সুদহারের সীম তুলে দিয়ে বাজারের উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। অস্থির ডলারের বাজার সুস্থির করতে টাকা-ডলারের বিনিময় হারও বাজারের উপর দেয়া দেওয়া হয়েছে।

সেই সঙ্গে বাজারে টাকার প্রবাহ কমাতে নতুন মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য বেশ খানিকটা কমানো হয়েছে; নামিয়ে আনা হয়েছে ১১ দশমিক ১০ শতাংশে। জানুয়ারি-জুন মেয়াদের মুদ্রানীতিতে এই লক্ষ্য ধরা ছিল ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ। 

রোববার বিকেলে ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) মুদ্রানীতিতে এ সব ঘোষণা দেয়া হয়েছে। রাজধানীর মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্মেলন কক্ষে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার এই মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন।

গভর্নর জানান, মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে রেপো হার ৫০ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়ানো হয়েছে। এখন এই হার হবে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ। এতদিন ছিল ৬ শতাংশ। সেই সঙ্গে রিভার্স রেপো হার ২৫ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়ানো হয়েছে। ৪ দশমিক ২৫ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে তা হবে ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ।

উচ্চ মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় গত বছর থেকেই রেপো হার বাড়াতে শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে তখন থেকেই বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণের সুদহার সীমা তুলে নেওয়ার আলোচনা হচ্ছে।

নতুন মুদ্রানীতিতে গভর্নর বলেন, “নীতি সুদহার বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংক ও ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণের সুদহার সীমাও তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”

“সুদহার সীমার বদলে প্রতিযোগিতামূলক ও বাজারভিত্তিক সুদহার কার্যকর হবে, যদিও তার মার্জিন থাকবে।”

গভর্নর বলেন, “আমরা সরবরাহ সাইড ঠিক রেখে নীতি সুদহার বাড়াচ্ছি, যাতে সরকারি ঋণেও অর্থ খরচ বাড়ে। টাকার সরবরাহ কমিয়ে এনে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করাটাই উদ্দেশ্য।”

বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, এর মধ্য দিয়ে সমাজে অতিরিক্ত মুদ্রার সরবরাহে রাশ টানা হবে। মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় এই সিদ্ধান্তও কাজে আসবে বলে মুদ্রানীতিতে আশার কথা শোনানো হয়েছে।

দেশে মূল্যস্ফীতির পারদ চড়ছেই; একলাফে অর্থনীতির স্পর্শকাতর এই সূচক প্রায় দুই অঙ্কের ঘরে (ডাবল ডিজিট) পৌঁছেছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মূল্যস্ফীতির সবশেষ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, মে মাসে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি বা মাসভিত্তিক) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ। আগের মাস এপ্রিলে এই হার ছিল ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ।

এর অর্থ হলো ২০২২ সালের মে মাসে দেশের মানুষ যে পণ্য বা সেবা ১০০ টাকায় পেয়েছিল, এই বছরের মার্চে তা কিনতে ১০৯ টাকা ৯৪ পয়সা খরচ করতে হয়েছে।

এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক মুল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতেই নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে আটকে রাখার লক্ষ্য ধরেছে সরকার। সে লক্ষ্য পূরণের জন্যই বাজারে টাকার সরবরাহ কমিয়ে আনতে নতুন মুদ্রানীতিতে নানা ধরনের সংকোচনমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।

জুলাই-ডিসেম্বর মেয়াদের এই মুদ্রানীতি গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের দ্বিতীয় মুদ্রানীতি। দায়িত্ব নেওয়ার পর জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে ৩০ জুন শেষ হতে যাওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছিলেন তিনি। যার মাধ্যমে আবারও বছরে দুবার মুদ্রানীতি ঘোষণার পুরোনো পথে ফিরে আসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এবার অর্থবছর শুরু হওয়ার প্রায় দুই সপ্তাহ আগেই মুদ্রানীতি ঘোষণা করল বাংলাদেশ ব্যাংক। যতোদিন অর্থবছরে (জুলাই-জুন) একটি মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছে, অর্থবছর শুরু হওয়ার পর জুলাই মাসের শেষের দিকে ঘোষণা করা হয়েছে।

শুধুমাত্র একবার সাবেক গভর্নর ফজলে কবির তার বিদায়ের আগে ২০২২ সালের ৩০ জুন ২০২২-২৩ অর্থবছর শুরু হওয়ার আগের দিন মুদ্রাননীতি ঘোষণা করেছিলেন। গভর্নর হিসেবে ফজলে কবিরের মেয়াদ ৩ জুলাই শেষ হয়। বিদায়ের তিন দিন আগে তিনি ওই মুদ্রানীতি দিয়ে গিয়েছিলেন।

আর যখন এক অর্থবছরে দুটি মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হতো, তখন অর্থবছর শুরু হওয়ার পর জুলাই মাসের শেষের দিকে (জুলাই-ডিসেম্বর) মেয়াদের মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হতো। আর দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হতো জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে।

এবার ভিন্ন পেক্ষাপটে মুদ্রানীতি ঘোষণা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অনেক আলোচনার পর গত ৩০ জানুয়ারি বহুল প্রতিক্ষিত ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে রাজি হয় আইএমএফ। তিন দিনের মাথায় ২ ফেব্রুয়ারি সেই ঋণের প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার ছাড় করে সংস্থাটি।

ঋণের বাকি অর্থ পাওয়া যাবে তিন বছরে অর্থাৎ ছয়টি সমান কিস্তিতে ৩৬ মাসে। দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়া যাবে এ বছরের ডিসেম্বরে আর শেষ কিস্তি পাওয়া যাবে ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে। এসব কিস্তির পরিমাণ ৭০ কোটি ৪০ লাখ ডলার করে।

৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ পেতে আইএমএফের ৩০টি শর্তে রাজি হয়েছে বাংলাদেশ। শর্তগুলো ৩টি বিভাগের অধীনে-গুণগত মান উন্নয়ন সংক্রান্ত শর্ত (কিউপিসি), অবকাঠামোগত মান উন্নয়ন সংক্রান্ত শর্ত (এসপিসি) এবং সাধারণ প্রতিশ্রুতি।

এ সব শর্তের মধ্যে অন্যতম প্রধান শর্ত ছিল ব্যাংক ঋণে বেঁধে দেওয়া ৯ শতাংশ সুদহারের সীম তুলে দিয়ে বাজারের উপর ছেড়ে দিতে হবে। সেই সঙ্গে টাকা-ডলারের বিনিময় হারও বাজারের উপর ছেড়ে দিতে হবে।

বাজারে টাকার প্রবাহ কমাতে নতুন মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য বেশ খানিকটা কমানো হয়েছে; নামিয়ে আনা হয়েছে ১১ দশমিক ১০ শতাংশে। জানুয়ারি-জুন মেয়াদের মুদ্রানীতিতে এই লক্ষ্য ধরা ছিল ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায়, গত এপ্রিল মাস শেষে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ।  

তবে নতুন মুদ্রানীতিতে সরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য বেশ খানিক বাড়ানো হয়েছে। জানুয়ারি-জুন মেয়াদের মুদ্রানীতিতে এই লক্ষ্য ছিল ৩৭ দশমিক ৭০ শতাংশ। জুলাই-ডিসেম্বর মেয়াদের মুদ্রানীতিতে তা বাড়িয়ে ৪৩ দশমিক ৩০ শতাংশ করা হয়েছে।

২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের মধ্যে আটকে রাখা এবং জিডিপি প্রবৃদ্ধি (অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি) ৭ দশমিক ৫ শতাংশ অর্জনের লক্ষ্য ধরেছে সরকার।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবারের মুদ্রানীতিতে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জনের চেয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অআনতে বেশি জোর দিয়েছে।

গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, “বিশ্বব্যাপী বর্তমানে চার ধরনের লক্ষ্যমাত্রাভিত্তিক মুদ্রানীতি প্রচলিত আছে। সুদহার, মূল্যস্ফীতি, মুদ্রা সরবরাহ এবং বিনিময় হার টার্গেটিং। বাংলাদেশ ব্যাংক এতদিন ‘মূল্যস্ফীতি টার্গেটিং’মুদ্রানীতি প্রণয়ন করে আসছিল। এবার ‘সুদহার টার্গেটিং’মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হ‌য়ে‌ছে। মুদ্রানীতিতে এটা কাঠামোগত পরিবর্তন বলা যায়।”

গভর্নর ব‌লেন, “নতুন মুদ্রানীতিতে টাকার চা‌হিদা কমা‌তে নী‌তি সুদহার বাড়া‌নো হ‌য়ে‌ছে। ঋণের সুদহা‌রের যে ৯ শতাংশ ক্যাপ ছিল তাও তু‌লে দেওয়া হ‌য়ে‌ছে।”

নতুন সুদহার ব্যবস্থা হলো ‘স্মার্ট’তথা শর্ট টার্ম মুভিং এভারেজ রেট। ১৮২ দিন মেয়াদি সরকারি ট্রেজারি বিলের ৬ মাসের গড় সুদের সঙ্গে আপাতত সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ করিডোর বা সীমা দেওয়া থাকবে। বর্তমানে ট্রেজারি বিলের গড় সুদহার ৭ শতাংশের নিচে রয়েছে। এর মানে গ্রাহক পর্যায়ে ঋণের সুদহার হবে ১০ দশমিক ১০ শতাংশের আশপাশে।

মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আহমেদ জামাল, কাজী ছাইদুর রহমান, আবু ফরাহ মো. নাছের, এ কে এম সাজেদুর রহমান খান, বিএফআইইউ প্রধান মাসুদ বিশ্বাস, প্রধান অর্থনীতিবিদ হাবিবুর রহমান, নির্বাহী পরিচালক ও ভারপ্রাপ্ত মুখপাত্র আবুল বশরসহ গবেষণা বিভাগের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছি‌লেন।

 

 

 

 

 

মূল্যস্ফীতির লাগাম টানার মুদ্রানীতি ঘোষণা বিকেল ৩টায় পরবর্তী

মূল্যস্ফীতির লাগাম টানার মুদ্রানীতি ঘোষণা বিকেল ৩টায়

কমেন্ট