রিজার্ভ থেকে কম দামে ডলার বিক্রি আর নয়
বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ থেকে কম দামে আর কোনো ডলার বিক্রি করবে না বাংলাদেশ ব্যাংক। বাজার দরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে ব্যাংকগুলোকে ডলার কিনতে হবে; যা আগামী ১ জুলাই থেকে কার্যকর হবে।
রোববার ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার এ কথা বলেছেন।
তিনি বলেন, “বাণিজ্যিক ব্যাংকের চাহিদা মেটাতে রিজার্ভ থেকে চলতি অর্থবছরের এ পর্যন্ত ১৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিক্রি করা হয়েছে। রিজার্ভ কমার এটাও একটি কারণ। সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক আর ডিসকাউন্ট রেটে ডলার বিক্রি করবে না।”
গভর্নর জানান, বাজার দর অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে সবাইকে ডলার কিনতে হবে। যা আগামী ১ জুলাই থেকে কার্যকর হবে।
নতুন সিদ্ধান্তে আন্ত:ব্যাংকে ডলারের যে দর উঠবে সেই দরে বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছে ডলার বিক্রি করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত সপ্তাহে আন্তঃব্যাংকে ডলারের দর উঠেছিল সর্বোচ্চ ১০৯ টাকা। আর গত সপ্তাহে ডলারের গড় দর কখনোই ১০৮ টাকা ৫০ পয়সার নিচে নামেনি।
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বশেষ ১০৬ টাকা দরে প্রতি ডলার বিক্রি করেছে।
৩০ জুন শেষ হতে যাওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের সাড়ে ১১ মাসে (গত বছরের ১ জুলাই থেকে চলতি জুন মাসের ১৫ তারিখ) বাংলাদেশ ব্যাংক প্রায় ১৩ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে। এর সিংহভাগই রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে বিক্রি করেছে।
গত বছরের সেপ্টেম্বরের পর থেকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর কাছে রিজার্ভ থেকে কোনো ডলার বিক্রি করেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
জ্বালানি, সারসহ বিভিন্ন সরকারি কেনাকাটা ও পুরনো দায় পরিশোধে সরকার এ ডলার কিনেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকের মাধ্যমে।
বর্তমানে ডলার দর রেমিটেন্সে সর্বোচ্চ ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা, রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে ১০৭ টাকা। আমদানি পর্যায়ে ডলারের দর চলতি গত সপ্তাহে ছিল গড়ে ১০৭ টাকা ৭৪ পয়সা। এরসঙ্গে ব্যাংকগুলো আরও ২০ থেকে ৫০ পয়সা যোগ করতে পারে।
এসময় বিনিময় হার একটি একক রেটে নিয়ে আসার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে বলেও জানান গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।
আইএমএফের কথামতো রিজার্ভের হিসাব করা হবে
মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় গভর্নর বলেন, এখন থেকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কথামতো রিজার্ভের হিসাব করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর সে হিসাবে বর্তমানে রিজার্ভ ২৪ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি হবে বলে জানান তিনি।
“আইএমএফ সদস্য অন্যান্য দেশগুলো বিপিএম৬-এর ফর্মুলা কার্যকর করেছে। আমরাও সেটা কার্যকর করবো। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব হিসাবও থাকবে। বিপিএম৬-এর ফর্মুলা পালন করলে দেশের রিজার্ভ দাঁড়াবে ২৪ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি।”
গভর্নর রউফ তালুকদার বলেন, “আমরা রিজার্ভ থেকে যেসব বিনিয়োগ করেছি সেগুলো ঝুঁকিমুক্ত। আমাদের সব ঋণের গ্যারান্টার রয়েছে। সব টাকা বাংলাদেশ ব্যাংক ফেরত পাবে। শ্রীলংকার লোনও আমরা ফেরত পেতে পারি তাদের স্থানীয় মুদ্রায় সমন্বয়ের মাধ্যমে।”
স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশ ব্যাংক মোট রিজার্ভের হিসাব প্রকাশ করে আসছিল। কিন্তু বেশ কিছুদের ধরে আইএমএফ এই হিসাব নিয়ে প্রশ্ন তোলে। তাদের যুক্তি, বাংলাদেশ ব্যাংক মোট যে রিজার্ভের হিসাব দিচ্ছে, তাতে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ), শ্রীলঙ্কাতে দেওয়া ২০ কোটি ডলার ঋণসহ অন্য কয়েকটি প্রকল্পে বিনিয়োগকে অন্তর্ভুক্ত দেখানো হচ্ছে।
আইএমএফ বলছে, এটা রিজার্ভের নিট বা প্রকৃত হিসাব নয়। কেননা, এই মুহূর্তে প্রয়োজন হলে বাংলাদেশ সরকার রিজার্ভ থেকে যে অর্থ অন্য খাতে বিনিয়োগ করা হয়েছে বা ঋণ দেয়া হয়েছে, তা ব্যবহার করতে পারবে না।
আপৎকালীন সংকট মোকাবিলার জন্য রিজার্ভের যে অর্থ তাৎক্ষনিক খরচ করা যাবে সেটাকেই রিজার্ভ হিসেবে হিসাব করতে বলে আসছিল আইএমএফ।
এতদিন বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টি আমলে না নিলেও ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের শর্তের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়ায় আইএমএফের এই শর্তটি এখন বাধ্য হয়ে মেনে নিতে হচ্ছে সরকারকে।
আইএমএফের ঋণের অন্যতম শর্ত ছিল রিজার্ভের নিট হিসাব প্রকাশ করতে হবে। এক্ষেত্রে মানতে হবে ব্যালেন্স অব পেমেন্টস এবং ইনভেস্টমেন্ট পজিশন ম্যানুয়াল (বিপিএম-৬) ফর্মুলা।
বিপিএম-৬ ফর্মুলা মেনে হিসাব করলে রোববার দিনের শুরুতে বাংলাদেশের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৪ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে ছিল ২৯ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার। সেখান থেকে ইডিএফের ৪ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার এবং শ্রীলঙ্কাকে দেওয়া ২০ কোটি ডলার ও কয়েকটি প্রকল্পের ৮০ কোটি ডলারসহ মোট ৫ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার বাদ দিলে বিপিএম-৬ ফর্মুলা অনুযায়ী রিজার্ভের প্রকৃত হিসাব দাঁড়ায় ২৪ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার।
বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক হচ্ছে এখন রিজার্ভ। আমদানি ব্যয় কমার পরও রিজার্ভ ধারাবাহিক ভাবে কমছে।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুত থাকতে হয়।
গত এপ্রিলে ৫ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার আমদানি খরচ হিসাবে বর্তমানের নিট রিজার্ভ দিয়ে সাড়ে চার মাসের আমদানি খরচ মেটানো যাবে।
কমেন্ট