আমানতের সুদহার তাহলে কত হবে?
প্রতীকি ছবি
রোববার নতুন মুদ্রানীতির ঘোষণার সময়ই ব্যাংক ঋণে সুদের সর্বোচ্চ ৯ শতাংশের সীমা তুলে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। বলেছিলেন, নতুন পদ্ধতিতে নির্ধারণ করা হবে ব্যাংক ঋণের সুদহার। পদ্ধতিটির নাম দেন তিনি ‘স্মার্ট’ (সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল)। এতে সুদহার খানিকটা বাড়বে বলে জানিয়েছিলেন তিনি।
সোমবার সেই ‘স্মার্ট’ সুদহার নির্ধারণের প্রক্রিয়ার নীতিমালা প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, প্রতি মাসের প্রথম কার্যদিবসে এ হার বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে। এটির ভিত্তিতে ব্যাংকগুলো সুদহার নির্ধারণ করে নেবে; ১ জুলাই থেকে এটি কার্যকর হবে হবে ঘোষণা দেওয়া হয় তাতে।
নীতিমালা অনুযায়ী, গাড়ি কেনা, ভোক্তা, কৃষিসহ সব ধরনের ঋণের সুদের হার বাড়বে। কোন খাতে কতোটা বাড়বে, তারও একটা পরিস্কার হিসাব দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বলা হয়েছে, সুদহার নির্ধারণ হবে ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের গড় সুদের ওপর। সেই সুদ কত হবে, তা–ও জানিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।
সোমবারই এ বিষয়ক সার্কুলারে বলা হয়েছে, ‘‘বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের বাজার সুদকে ভিত্তি ধরে একটি রেফারেন্স রেট নির্ণয় করা হবে।”
এদিন বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে সবশষে ছয় মাসের স্মার্ট বা ১৮২ দিনের মেয়াদি ট্রেজারি বিলের গড় সুদহার প্রকাশ করা হয়েছে, যা ৭ দশমিক ১৩ শতাংশ।
সার্কুলারে বলা হয়েছে, এই সুদ হারের সঙ্গে সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ মার্জিন যোগ করে সুদহার নির্ধারণ করতে হবে। সে হিসাবে ব্যাংকঋণের সুদহার হবে ১০ দশমিক ১৩ শতাংশ।
আর সিএমএসএমই ও ভোক্তা ঋণের আওতাধীন ব্যক্তিগত ঋণ ও গাড়ি ক্রয় ঋণে আরও ১ শতাংশ তদারকি মাশুল যুক্ত হবে। ফলে এসব ঋণের সুদহার হবে ১১ দশমিক ১৩ শতাংশ।
তবে কৃষি ও পল্লি ঋণের সুদহার হবে ৯ দশমিক ১৩ শতাংশ। কারণ, বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, এ ধরনের ঋণের সুদহার ট্রেজারি বিলের গড় সুদের চেয়ে ২ শতাংশ বেশি হবে। আর ক্রেডিট কার্ডে সুদহার আগের মতো ২০ শতাংশ বহাল থাকবে।
বেশ জটিল হিসাবের মধ্য দিয়ে ব্যাংক ঋণের সুদহার বাড়ার বিষয়টি না হয় বোঝা গেল। কিন্তু সবার মনে প্রশ্ন আমানতের সুদহারের কী হবে? স্বাভাবিক নিয়মে ব্যাংকের সুদহার বাড়লে আমানতের সুদহারও বাড়ে।
কিন্তু মুদ্রানীতি ঘোষণার সময়ও গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার আমানতের সুদের বিষয়ে কিছু বলেননি। পরের দিন এ-সংক্রান্ত সার্কুলারেও আমানতের সুদ নিয়ে কোনো কিছু বলা হয়নি।
ব্যবসায়ীদের দাবি, ব্যাংক চেয়ারম্যানদের উদ্যোগ ও সরকারি সিদ্ধান্তে ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ব্যাংকঋণের সুদ সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ নির্দিষ্ট করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই সঙ্গে আমানতের সুদহার নির্ধারণ করে দেওয়া হয় ৬ শতাংশ। এরপর থেকে ব্যাংকিং খাতে ‘নয়-ছয়’ সুদ হারের বিষয়টি বেশ আলোচিত বিষয় হয়ে দেখা দেয়।
পরে অবশ্য মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় রেখে মেয়াদি আমানতের সুদহার বেঁধে দেওয়া হয়, যা এখন ৬ শতাংশের বেশি। তবে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় অর্থনীতিতে এখন যে চাপ তৈরি হয়েছে, তাতে নির্দিষ্ট সুদহারে আমানত সংগ্রহ ও ঋণ বিতরণ ব্যাংকগুলোর জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আমানতের সুদহার কী হবে-সেটা এখন বেশ জোরেশোরে আলোচনা হচ্ছে।
উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে এমনিতেই মানুষের সঞ্চয় ক্ষমতা কমেছে। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার বিক্রি করায় বাজার থেকে দুই বছরে উঠে এসেছে ২ লাখ কোটি টাকার বেশি। এসব কারণে ব্যাংক খাতে বর্তমানে চলছে তারল্য সংকট। আবার ৯ শতাংশ সুদহারের সীমার মধ্যেই সাম্প্রতিক সময়ে আমানত পেতে সুদ বাড়িয়েছে বেশিরভাগ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণের সুদহার বাড়ানোর বিষয়ে সোমবার সার্কুলার জারি করেছে। তবে সেখানে আমানতের সুদহার বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তারা জানান, ঋণের সুদ বাড়লে আমানতের সুদ স্বাভাবিকভাবেই বাড়ে। ব্যাংকগুলো এখন তারল্য সংকটে আছে। শিগগিরই পরিস্থিতি উন্নতির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। যে কারণে এরই মধ্যে আমানতে সুদ বাড়িয়েছে বেশিরভাগ ব্যাংক। এর পরও আটটি ব্যাংক অনেকদিন ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ন্যূনতম নগদ জমা (সিআরআর) রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। যে কারণে বড় অঙ্কের জরিমানা গুনছে তারা।
এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে স্বল্পমেয়াদি ধারের (রেপো) সুদ বেসিস পয়েন্ট ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে সাড়ে ৬ শতাংশ করা হয়েছে। আবার নতুন পদ্ধতিতে কলমানি থেকে ধারের সর্বোচ্চ সুদ হবে সাড়ে ৮ শতাংশ। মঙ্গলবার কলমানির গড় সুদ ছিল ৬ দশমিক শূন্য আট শতাংশ। সব মিলিয়ে সুদহার বাড়বে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “ঋণের সুদহার বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই আমানতের সুদ বাড়বে। ব্যাংকভেদে এই সুদ বাড়বে ১ থেকে ২ শতাংশ। কেননা ব্যাংকগুলোতে এমনিতেই এখন তারল্য সংকট। এ ছাড়া রেপোর সুদহার বাড়ানোর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে স্বল্প মেয়াদে টাকা নেওয়ার খরচ বাড়ছে। ফলে আমানতের সুদ যে বাড়বে, নিশ্চিতভাবে তা বলা যায়।”
ব্যাংক ঋণের মতো আমানতের সুদের বিষয়ে কোনো নতুন পদ্ধতিতে নির্ধারণ করে দেওয়া হবে কী না- এ প্রশ্নের উত্তরে ওই কর্মকর্তা বলেন, “এখনও এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
সঞ্চয়ের ওপর আসলে সুদ পাওয়া যাচ্ছে কী-না তার হিসাব হয় মূল্যস্ফীতির ভিত্তিতে। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় গত মে মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ। এর মানে এক বছর আগে ১০০ টাকায় যে পণ্য ও সেবা কেনা যেত, মে মাসে তা কিনতে ১০৯ টাকা ৯৪ পয়সা খরচ হয়েছে।
এক বছর আগে কেউ ব্যাংকে টাকা রেখে এর চেয়ে কম সুদ পেলে, তার প্রকৃত সুদ আয় হলো নেতিবাচক। আবার ব্যাংক যে সুদ দেয়, তার ওপর সরকারের শুল্ক, ব্যাংকের সার্ভিস চার্জ, সার্ভিস চার্জের ওপর ভ্যাট এবং আবগারি শুল্ক দিতে হয়। যে কারণে মূল্যস্ফীতির চেয়ে বেশি সুদ না পেলে আসলে সঞ্চয় ক্ষয় হয়। সে হিসাবে দেশে এখন ব্যাংকে সঞ্চয় করে প্রকৃত সুদ নেতিবাচক থাকে।
ব্যাংকাররা জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন ব্যবস্থায় ঋণের সুদ সামান্য বাড়লেও তা পুরোপুরি বাজারভিত্তিক হচ্ছে না। কেননা, ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের ছয় মাসের গড় সুদের সঙ্গে ৩ শতাংশ মার্জিন যোগ করতে পারবে ব্যাংক। সিএমএসএমই, ব্যক্তিগত ও গাড়ি কেনার ঋণে বাড়তি এক শতাংশ তদারকি ফি নিতে পারবে। এতে করে ঘুরেফিরে ব্যাংক ঋণের সুদহার ১০ শতাংশের আশপাশে থাকবে।
যদিও এখনকার মতো ৯ শতাংশে নির্ধারিত থাকবে না। ফলে ঋণের সুদ অনেক বাড়াতে না পারায় আমানতের সুদ তেমন বাড়বে না। তবে এখনকার তুলনায় আমানতের সুদ সামান্য হলেও যে বাড়বে তা বলাই যায়।
এ বিষয়ে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, “৯ শতাংশ সুদহারের সীমা তুলে নেওয়াটা ব্যাংক খাতের জন্য ইতিবাচক। নতুন নীতিমালায় ঋণের সুদহার বাড়বে। এতে করে আমানতের সুদও বাড়ানোর চাপ তৈরি হবে। তবে ঋণের সুদহার যে পুরোপুরি বাজারের ওপর ছাড়া থাকবে তেমন নয়। এ ছাড়া এরই মধ্যে আমানতের সুদ বাড়িয়েছে ব্যাংকগুলো।”
আমানতের সুদ বাড়ালেও ব্যাংকগুলো এতদিন ঋণে ৯ শতাংশের বেশি যেতে পারেনি। এতে করে সাম্প্রতিক সময়ে ঋণ আমানতের মধ্যকার সুদহারের ব্যবধান (স্প্রেড) কমেছে।
গত এপ্রিলে স্প্রেড কমে ২ দশমিক ৯১ শতাংশে নেমেছে। ওই মাসে আমানতের গড় সুদহার ছিল ৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ এবং ঋণে ৭ দশমিক ২৯ শতাংশ।
আগের মাস মার্চ শেষে আমানতের গড় সুদ ৪ দশমিক ৩৫ শতাংশ ছিল। ঋণে ছিল ৭. দশমিক শতাংশ। স্প্রেড ছিল ২ দশমিক ৯৬ শতাংশ।
এ ছাড়া গত বছরের এপ্রিল মাসে আমানতের গড় সুদ ৪ দশমিক শূন্য দুই শতাংশ ছিল। ঋণের সুদ হার ছিল ৭ দশমিক শূন্য নয় শতাংশ। স্প্রেড ছিল ৩ দশমিক শূন্য সাত শতাংশ।
এর মানে সাম্প্রতিক সময়ে ঋণ ও আমানতের গড় সুদ বাড়লেও স্প্রেড তথা ব্যাংকের আয় কমেছে। নতুন পদ্ধতিতে আগামী জুলাই থেকে ঋণের সুদ বাড়ানোর সুযোগ পাবে ব্যাংকগুলো। কিন্তু আমানতের বিষয়ে কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না।
এ বিষয়ে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাফর আলম বলেন, “কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন সিদ্ধান্ত ব্যাংকের ব্যবসার জন্য সহায়ক হবে। তবে নতুন করে আমানতের মুনাফা অনেক বাড়ানো যাবে বলে মনে হয় না। কেননা, বেশিরভাগ ব্যাংক এরই মধ্যে আমানতে মুনাফার হার বাড়িয়েছে। এমনিতেই সবকিছুর দর বৃদ্ধির কারণে ব্যাংকের পরিচালন ব্যয়সহ অন্যান্য খরচ বেড়েছে। এ সময়ে বিনিয়োগ ও আমানতের মুনাফার মধ্যে ৩ থেকে ৪ শতাংশ পার্থক্য না থাকলে সমস্যায় পড়তে হয়।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ৩০ জুন শেষ হতে যাওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে ১৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর বিপরীতে বাজার থেকে উঠে এসেছে ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকার মতো।
গত অর্থবছর ৭৬২ কোটি ডলার বিক্রির বিপরীতে উঠেছিল আরও প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা। অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারে তারল্য বাড়াতে এখন সরকারের ঋণের বেশিরভাগ সরাসরি সরবরাহ করছে। আবার কম সুদের বিভিন্ন ধরনের পুনঃঅর্থায়নের মাধ্যমে বাজারে তারল্য বাড়ানোর চেষ্টা চলছে।
কমেন্ট