আন্তঃব্যাংক লেনদেনে ডলারের দর ফের ১০৯ টাকায়
ফাইল ছবি
আন্তঃব্যাংক লেনদেনে ডলারের দর আবার ১০৯ টাকায় উঠেছে। বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনে আন্তঃব্যাংকের যে দর বাংলাদেশ ব্যাংক বুধবার প্রকাশ করেছে, তাতে ডলারের এই দর দেখা যায়।
গত ১৫ জুন অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে টাকা-ডলারের বিনিময় হার ১০৯ টাকায় উঠেছেল। এরপর গত কয়েক দিন ১০৮ টাকা ৭০ পয়সা থেকে ১০৮ টাকা ৮০ পয়সায় লেনদেন হয়। মঙ্গলবার লেনদেন দর ছিল ১০৮ টাকা ৮০ পয়সা।
এদিকে খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেটেও ডলারের দর ঊর্ধ্বমূখী। বুধবার এই বাজারে ১১২ টাকা ৫০ পয়সা দরে ডলার বিক্রি হয়েছে। সপ্তাহ দুয়েক আগে এই দর কমতে কমতে ১১০ টাকায় নেমে এসেছিল বলে জানান এক ব্যবসায়ী।
গত বছরের মার্চে দেশে মার্কিন ডলারের যে সংকট শুরু হয়েছিল, তা এখনো কাটেনি। অনেক ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, পণ্য আমদানিতে তারা চাহিদামতো ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারছেন না। অনেক বিদেশি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে সেবা দিয়ে যে আয় ও মুনাফা করেছে, তা-ও নিজ দেশে নিতে পারছে না।
বাজারে চাহিদা বাড়লেও জোগান কমছে ডলারের। আর এতে আন্তঃব্যাংক লেনদেনে এই বিদেশি মুদ্রার দাপট অব্যাহত রয়েছে। নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণার পরও অস্থির ডলারের বাজারে স্বস্তি ফিরে আসছে না।
এক বছর আগে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের বিনিময় হার বাজারের উপর ছেড়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
এর আগে গত ১৬ মে আন্তঃব্যাংকে ডলারের দর উঠেছিল ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা। এরপর সামান্য কিছু বেড়ে ১০৮ টাকা ৭০ পয়সা পর্যন্ত উঠে ফের ১০৮ টাকা ৫০ পয়সায় নেমে অবস্থান করছিল মে মাসের শেষের দিকে।
চলতি জুন মাসে দুই সপ্তাহ ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১০৮ টাকা ৮০ পয়সার মধ্যে লেনদেন হয়। ১৫ জুন ১০৯ টাকায় উঠেছিল।
এক বছর আগে গত বছরের ১৫ জুন এই দর ছিল ৯২ টাকা ৩৭ পয়সা। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এই এক বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে ১৮ শতাংশ।
ডলারের এ দরের সঙ্গে ব্যাংক গ্রাহকের কাছ থেকে কমিশন আকারে ১০ থেকে ৫০ পয়সা পর্যন্ত যোগ করে। ফলে গ্রাহক পর্যায়ে ডলারের দর আরও বাড়ে।
বেসরকারি সিটি ব্যাংক বৃহস্পতিবার ১০৯ টাকা ২৭ পয়সা দরে নগদ ডলার বিক্রি করছে বলে তাদের ওয়েবসাইটে জানিয়েছে। তবে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের ওয়েবসাইট বলছে, তারা ১০৯ টাকা দরে নগদ ডলার বিক্রি করেছে।
প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয় দেশের ডলার উপার্জনের মূল ক্ষেত্র।
গত মে মাসে দেশে রেমিটেন্স এসেছে ১৬৯ কোটি ১৬ লাখ ডলার, যা ২০২২ সালের মে মাসের চেয়ে ১৯ কোটি ৩৭ লাখ ডলার বা ১১ দশমিক ৪৫ শতাংশ কম। গত বছরের মে মাসে রেমিটেন্স এসেছিল ১৮৮ কোটি ৫৩ লাখ ডলার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ১১ মাসে গড়ে রেমিটেন্স এসেছে ১ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার। আর গত এপ্রিলে মাস শেষে চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে গড় রপ্তানি আয় ছিল ৪ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার।
অবশ্য গত মার্চ ও এপ্রিলে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি থাকা রপ্তানি আয় মে মাসে ২৬ দশমিক ৬১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি দেখা গিয়েছে।
অন্যদিকে গত এপ্রিলে মাস শেষে চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে আমদানি খরচ গড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার।
বৈদেশিক মুদ্রা আয়-ব্যয়ের এ খরচে ঘাটতি দেখা দেওয়ায় সর্বশেষ গত ১ জুন রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয়ের বিপরীতে ডলারের দর ফের বাড়ায় বিদেশি মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাংলাদেশে ফরেইন এক্সচেঞ্জ ডিলার অ্যাসোসিয়েশন-বাফেদা।
নতুন দরে রেমিটেন্সে প্রতি ডলারে পাওয়া যাবে ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা, আর রপ্তানিকারকরা প্রতি ডলারের বিপরীতে ১০৭ টাকা পাবেন।
বর্তমানে আমদানি, রপ্তানি, রেমিটেন্স ও নগদ বিক্রিতে ডলারের দর ভিন্ন ভিন্ন। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফের পরার্মশ রয়েছে, বৈদেশিক মুদ্রার একাধিক দর না রেখে একক দর রাখা।
আইএমএফের পরামর্শ মেনে আমদানি, রপ্তানি, রেমিটেন্স ও নগদ কেনাবেচায় বিদেশি মুদ্রার একাধিক বিনিময় হারকে একটিতে নামিয়ে আনার প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ১৮ জুন মুদ্র্রানীতি ঘোষণার সময় এই ইঙ্গিত দিয়েছেন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।
দীর্ঘদিন ডলারের বিনিময় হার কৃত্রিমভাবে ধরে রাখার খেসারত এখন দিতে হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।
এআরএইচ ডটকমকে তিনি বলেন, “এত দিন টাকার মান ৪০ শতাংশ অতিমূল্যায়িত ছিল। ডলার-সংকট শুরু হওয়ার পর ২৫ শতাংশের মতো টাকার অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। আরও ১৫ শতাংশ অবমূল্যায়ন করতে হবে।”
তিনি বলেন, “দেরিতে হলেও ডলারের দর বাজারভিত্তিক করার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এটা করলে একটা সমাধান হতে পারে। খোলাবাজারের সঙ্গে ব্যাংকের ডলারের দামের পার্থক্য সর্বোচ্চ ২ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। এ জন্য বৈধ পথে আয় বাড়াতে হবে। তাহলে সংকটও কমবে।”
“অন্যদিকে সংকটের এই সময়ে রপ্তানি আয় যাতে না কমে সেদিকেও বিশেষ নজর রাখতে হবে। বিশ্ব ব্যাংক-আইএমএফসহ অন্য দাতাদের কাছ থেকে কম সুদের ঋণ আনার দিকেও মনোযোগ দিতে হবে। এফডিআই (সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ) বাড়তে হবে।”
“আমাদের একটা বিষয় খুব ভালোভাবে মনে রাখতে হবে, বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক হচ্ছে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ। নানা ভুলের কারণে এই রিজার্ভ অনেক কমেছে; ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে ২৯ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে এসেছে।
“কিন্তু আর নয়, আর কমতে দেয়া যাবে না। যে করেই হোক আটকাতে হবে। তানাহলে কিন্তু আমরা বড় ধরনের বিপদে পড়বো,” বলেন দীর্ঘদিন আইএমএফে গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা আহসান মনসুর।
কমেন্ট