বৈশ্বিক অস্থিরতায় সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থ ৯৪% কমেছে
সুইস ব্যাংক
সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংক বা সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা অর্থ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে দেশটির বিভিন্ন ব্যাংকে থাকা বাংলাদেশিদের অর্থ ৮১ কোটি ৫৯ লাখ সুইস ফ্রাঁ কমেছে। শতাংশ হিসাবে যা ৯৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ।
সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের (এসএনবি) বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
বৃহস্পতিবার এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
প্রায় দেড় বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি মুদ্রা টাকার ব্যাপক দরপতনের কারণে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থ কমেছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা।
সুইস কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সাল শেষে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা হওয়া অর্থের পরিমাণ ছিল ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ। গত বছর, অর্থাৎ ২০২২ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫ কোটি ৫২ লাখ সুইস ফ্রাঁতে।
বাংলাদেশে সুইস ফ্রাঁর খুব বেশি লেনদেন হয় না। তবে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রতি সুইস ফ্রাঁর বিনিময় মূল্য প্রায় ১২১ টাকা। সেই হিসাবে ৫ কোটি ৫৩ লাখ সুইস ফ্রাঁতে দাঁড়ায় প্রায় ৬৬৯ কোটি টাকা।
তবে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের মোট আমানত কমলেও ব্যক্তি পর্যায়ের আমানতের পরিমাণ ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ বেড়েছে। ২০২১ সাল শেষে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে ব্যক্তি পর্যায়ের আমানতের পরিমাণ ছিল ২ কোটি ৬৩ লাখ সুইস ফ্রাঁ। ২০২২ সালে তা বেড়ে ৩ কোটি ৫৪ লাখ সুইস ফ্রাঁ হয়েছে।
সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে বাংলাদেশিদের যে অর্থ জমা হয়, তা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে জমা হয়। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন দেশ থেকে জমা হওয়া এসব অর্থ সে দেশের দায় হিসাবে আর্থিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে থাকে।
সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা অর্থের পরিমাণ একলাফে এক বছরে ৯৪ শতাংশ কমে যাওয়ায় তথ্যটি এমন একসময়ে এসেছে, যখন দেশে অর্থ পাচারের বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে।
হঠাৎ সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যাওয়ার জন্য দেশের চলমান ডলার–সংকট বড় কারণ বলে মনে করছেন অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর।
তিনি বলেছেন, দেশে ডলারের সংকট দেখা দেওয়ায় দেশটিতে অর্থ জমার বা বিনিয়োগের সক্ষমতা হারিয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠান। আবার অনেক প্রতিষ্ঠান সেখান থেকে অর্থ তুলে নিয়েছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশি অনেক প্রতিষ্ঠান প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অর্থ জমা রাখে। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ দেশের বাণিজ্যিক অনেক ব্যাংকও দেশটিতে অর্থ রাখে। দেশে ডলার–সংকট দেখা দেওয়ায় হয়তো এসব প্রতিষ্ঠান সেখান থেকে অর্থ তুলে নিয়েছে বা নতুন করে অর্থ জমা রাখতে পারেনি। এ ছাড়া হয়তো পাচারের কিছু অর্থ দেশটি থেকে সরিয়ে নিয়েছেন কেউ কেউ।”
“সুইজারল্যান্ডে এখন অনেক বাংলাদেশি থাকেন। তারাও বৈধভাবে সেখানকার ব্যাংকে অর্থ জমা রাখেন। যেহেতু বিশ্বজুড়ে একধরনের অর্থনৈতিক চাপ তৈরি হয়েছে, তাই হয়তো বৈধভাবে যারা সেখানে অর্থ জমা রাখতেন, তাদের সঞ্চয়ের সক্ষমতা কমে গেছে। তাই সার্বিকভাবে হয়তো বাংলাদেশিদের অর্থের পরিমাণ কমেছে দেশটিতে।”
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুবুর রহমান এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “২০২২ সালে বৈদেশিক অর্থ পরিশোধের প্রবল চাপ থাকার কারণেই সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের আমানত কমেছে। গত বছর প্রতিমাসে ৮/৯ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক অর্থ পরিশোধ করতে হয়েছে দেশের ব্যাংক ও ব্যবসায়ীদের।”
তিনি বলেন, “সাধারণত অর্থ পরিশোধের জন্যই সুইস ব্যাংকের হিসাবে আমাদের দেশের ব্যাংকের অর্থ রাখা হয়। কিন্তু গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে চরম ডলার সংকটের ফলে ব্যাংকগুলো তাদের সমস্ত উপলদ্ধ তহবিল থেকে ডলার সংগ্রহ করে। কারণ তখন সুইস ব্যাংকে আমানত রাখার চেয়ে মূল্য পরিশোধের দায় মেটানোই প্রধান বিষয় হয়ে ওঠে।”
সুইস কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে শুধু যে বাংলাদেশিদের অর্থ কমেছে, তা নয়। ভারত, পাকিস্তান, সিঙ্গাপুর, চীন, রাশিয়া, সৌদি আরব, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ জমার পরিমাণও কমেছে।
২০২১ সালে সুইস ব্যাংকে ভারতীয়দের জমা অর্থের পরিমাণ ছিল প্রায় ৩৮৩ কোটি সুইস ফ্রাঁ। গত বছর তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩৪০ কোটি সুইস ফ্রাঁতে। একইভাবে ২০২১ সালে দেশটিতে পাকিস্তানিদের জমা অর্থের পরিমাণ ছিল প্রায় ৭১ কোটি সুইস ফ্রাঁ। গত বছর তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩৯ কোটি সুইস ফ্রাঁতে।
আর সৌদি আরবের জমা অর্থের পরিমাণ অর্ধেক হয়ে গেছে এক বছরের ব্যবধানে। ২০২১ সালে সুইজারল্যান্ডে সৌদি আরবের মানুষের জমা অর্থের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৪৫ কোটি সুইস ফ্রাঁ, সেটি গত বছর কমে ৫২১ কোটিতে নেমে এসেছে।
এ ছাড়া ইউরোপের দেশ ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া রাশিয়ার অর্থও কমেছে সুইজারল্যান্ডে। তবে কমার হার সৌদি আরবের চেয়ে কম, সাড়ে ২৮ শতাংশ। ২০২১ সালে সুইজারল্যান্ডে রুশ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের জমা অর্থের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ১৩৭ কোটি সুইস ফ্রাঁ। গত বছর তা কমে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৫২৬ কোটি সুইস ফ্রাঁতে।
এসএনবির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত এই ২২ বছরে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে বাংলাদেশিদের সবচেয়ে কম অর্থ ছিল ২০০৩ সালে। ওই বছর দেশটির ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা অর্থের পরিমাণ ছিল মাত্র আড়াই কোটি সুইস ফ্রাঁ। এরপর দেশটিতে বাংলাদেশিদের সর্বোচ্চ পরিমাণ অর্থ জমা হয়েছিল ২০২১ সালে, ৮৭ কোটি সুইস ফ্রাঁর বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের যেসব অর্থ জমা রয়েছে, সেগুলো যে সব পাচারের অর্থ, তা বলা যাবে না। কারণ, সুইজারল্যান্ড ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারীরাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী বাংলাদেশিরা বৈধভাবেও দেশটিতে অর্থ জমা রাখেন। ব্যক্তির পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও অর্থ জমা রাখা হয় দেশটির বিভিন্ন ব্যাংকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত এক বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে ১৭ দশমিক ৩৩ শতাংশ। বৃহস্পতিবার আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলারের জন্য ১০৯ টাকা খরচ করতে হয়েছে। এক বছর আগে ২০২২ সালের ২১ জুন লেগেছিল ৯২ টাকা ৯০ পয়সা।
কমেন্ট