আইএমএফের শর্ত পূরণ করতে এখন ডলার কিনছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক
ফাইল ছবি
বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক বিদেশি মুদ্রান সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ বাড়াতে ব্যাংকগুলেঅর কাছ থেকে ডলার কিনতে শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বৃহস্পতিবার বেসরকারি প্রাইম ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে ৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার কিনেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রতি ডলারের জন্য ১০৬ টাকা দাম দিয়েছে।
এর মাধ্যমে ৩০ জুন শেষ হতে যাওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো ডলার কিনল বাংলাদেশ ব্যাংক।
পাশাপাশি একই দামে সরকারের আমদানি দায় মেটাতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি অব্যাহত রাখা হয়েছে; বৃহস্পতিবার বিক্রি করা হয়েছে ৬ কোটি ৫০ লাখ ডলার।
অর্থবছরের হিসাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ভালো দেখাতে ব্যাংক থেকে ডলার কেনা শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের অন্যতম প্রধান শর্ত হচ্ছে জুনের মধ্যে প্রকৃত রিজার্ভ ২ হাজার ৪৪৬ কোটি (২৪.৪৬ বিলিয়ন) ডলারে উন্নীত করতে হবে।
সেই শর্ত পূরণের জন্য বাংকগুলোর কাছ থেকে ডলার কেনা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা। আইএমএফের দ্বিতীয় কিস্তির ৬০ কোটি ৪০ লাখ ডলার ঋণ সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে ছাড়া করার কথা রয়েছে।
সেই ঋণ পেতে যাতে কোনো সমস্যা না হয়, সেজন্যই চলতি জুন মাসের মধ্যে প্রকৃত রিজার্ভ ২৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে বিভিন্ন দাতা সংস্থার কাছ থেকে ঋণের জন্য জোর পচেষ্টার পাশপাশি ব্যাংকগুলোর কাছ থেকেও ডলার কিনছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
দুই বেসরকারি ব্যাংক থেকে সাড়ে ৩ কোটি ডলার কেনার ফলে আইএমএফের বেঁধে দেওয়া লক্ষ্যের প্রায় সমান রিজার্ভ রয়েছে এখন বাংলাদেশের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে বৃহস্পতিবার দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩০ দশমিক শূন্য এক বিলিয়ন ডলার। তবে আইএমএফ ব্যালেন্স অব পেমেন্টস এবং ইনভেস্টমেন্ট পজিশন ম্যানুয়াল (বিপিএম-৬) ফর্মুলা অনুযায়ী রিজার্ভের যে হিসাব করতে বলছে, তাতে রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৪ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার।
আমদানি ব্যয় বেশ কমেছে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের গতিও ভালো। রপ্তানি আয়ও বাড়ছে। আইএমএফের পর বিশ্ব ব্যাংকের বাজেট সহায়তার ৫০ কোটি ডলারের বেশি ঋণ রিজার্ভে যোগ হয়েছে। এর পরও রিজার্ভ বাড়ছিল না।
মূলত রিজার্ভ থেকে অব্যাহতভাবে ডলার বিক্রির কারণেই রিজার্ভ কমছিল। বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরের বৃহস্পতিবার পর্যন্ত (১১ মাস ২২ দিন, ২০২২ মালের ১ জুলাই থেকে চলতি জুন মাসের ২২ তারিখ) রিজার্ভ থেকে ব্যাংকগুলোর কাছে প্রায় সাড়ে ১৩ বিলিয়ন ডলারের মতো বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
আইএমএফের শর্ত পূরণ করতে গিয়ে এখন বাধ্য হয়ে ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ডলার কিনতেও হচ্ছে।
এদিকে এখন থেকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের কথামতো দেশের রিজার্ভের হিসাব করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। ১৮ জুন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) মুদ্রানীতি ঘোষণার সময়গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, “আইএমএফ সদস্য অন্যান্য দেশগুলো বিপিএম৬-এর ফর্মুলা কার্যকর করেছে। আমরাও সেটা কার্যকর করবো। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব হিসাবও থাকবে। বিপিএম৬-এর ফর্মুলা পালন করলে দেশের রিজার্ভ দাঁড়াবে ২৪ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি।”
গভর্নর বলেন, “আমরা রিজার্ভ থেকে যেসব বিনিয়োগ করেছি সেগুলো ঝুঁকিমুক্ত। আমাদের সব ঋণের গ্যারান্টার রয়েছে। সব টাকা বাংলাদেশ ব্যাংক ফেরত পাবে। শ্রীলংকার লোনও আমরা ফেরত পেতে পারি তাদের স্থানীয় মুদ্রায় সমন্বয়ের মাধ্যমে।”
স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশ ব্যাংক মোট রিজার্ভের হিসাব প্রকাশ করে আসছিল। কিন্তু বেশ কিছুদের ধরে আইএমএফ এই হিসাব নিয়ে প্রশ্ন তোলে। তাদের যুক্তি, বাংলাদেশ ব্যাংক মোট যে রিজার্ভের হিসাব দিচ্ছে, তাতে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ), শ্রীলঙ্কাতে দেওয়া ২০ কোটি ডলার ঋণসহ অন্য কয়েকটি প্রকল্পে বিনিয়োগকে অন্তর্ভুক্ত দেখানো হচ্ছে।
আইএমএফ বলছে, এটা রিজার্ভের নিট বা প্রকৃত হিসাব নয়। কেননা, এই মুহূর্তে প্রয়োজন হলে বাংলাদেশ সরকার রিজার্ভ থেকে যে অর্থ অন্য খাতে বিনিয়োগ করা হয়েছে বা ঋণ দেয়া হয়েছে, তা ব্যবহার করতে পারবে না।
আপৎকালীন সংকট মোকাবিলার জন্য রিজার্ভের যে অর্থ তাৎক্ষনিক খরচ করা যাবে সেটাকেই রিজার্ভ হিসেবে গণনা করতে বলে আসছিল আইএমএফ।
এতদিন বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টি আমলে না নিলেও ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের শর্তের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়ায় আইএমএফের এই শর্তটি এখন বাধ্য হয়ে মেনে নিতে হচ্ছে সরকারকে।
আইএমএফের ঋণের অন্যতম শর্ত ছিল রিজার্ভের নিট হিসাব প্রকাশ করতে হবে। এক্ষেত্রে মানতে হবে ব্যালেন্স অব পেমেন্টস এবং ইনভেস্টমেন্ট পজিশন ম্যানুয়াল (বিপিএম-৬) ফর্মুলা।
আর নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার সেই কথাটিই বলেছেন।
বিপিএম-৬ ফর্মুলা মেনে হিসাব করলে বাংলাদেশ রিজার্ভ এখন ২৪ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার।
অর্থাৎ ইডিএফের ৪ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার এবং শ্রীলঙ্কার ২০ কোটি ডলার ও অন্য কয়েকটি প্রকল্পে ৮০ কোটি ডলার সব মিলিয়ে ৫ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার ৩০ দশমিক শূন্য এক বিলিয়ন ডলার থেকে বাদ দিলে আইএমএফের হিসাবে প্রকৃত রিজার্ভ ২৪ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার দাঁড়ায়।
ডলারের সংকট এখনো কাটেনি। ব্যাংকগুলো চাহিদামতো ঋণপত্র খুলতে পারছে না। আবার যেসব ঋণপত্র খোলা হয়েছে, অনেক ব্যাংক তার বিল পরিশোধ করতে পারছে না। বিদেশি ব্যাংকগুলো দেশের ব্যাংকগুলোকে যেসব ঋণ দিয়েছে, তার বেশ কয়েকটির মেয়াদ শেষ হলেও ডলার ফেরত পাচ্ছে না।
এমন পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ডলার বিক্রি করেছে বেসরকারি খাতে প্রাইম ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী মুখপাত্র সরোয়ার হোসেন এআরইচ ডটকমকে বলেন, “প্রবাসী আয় বাড়ছে। ব্যাংকগুলোর ডলার ধারণও বাড়ছে। কোনো ব্যাংক ডলার বিক্রি করতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকে কিনছে। আবার আমদানি দায় মেটাতে ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে। সংকট ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে।”
ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকেরা এ নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, অনেক ব্যাংক আমদানি দায় শোধ করতে পারছে না। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক একরকম জোর করেই ডলার কিনে নিয়েছে। কোনো ব্যাংকে ডলার উদ্বৃত্ত থাকলে অন্য সব ব্যাংক সেই ডলার কেনার জন্য প্রস্তুত আছে।
এই কর্মকর্তা বলেন, “কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে যে ডলার বিক্রি করছে, তা কিন্তু বেসরকারি কোনো ব্যাংক পাচ্ছে না। শুধুমাত্র সরকারের প্রয়োজনীয় কেনাকাটা জন্য যে ডলার প্রয়োজন হয়, সেগুলোই রাষ্ট্রায়ত্ত কয়েকটি ব্যাংকের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে।
“এ অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি বেসরকারি ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ডলার কেনা অব্যাহত রাখে থাকলে কিন্তু ডলারের সংকট আরও বেড়ে যাবে।”
একই কথা বলেছেন অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।
এআর এইচ ডটকমকে তিনি বলেন, “ডলার-সংকটের উন্নতি হয়নি, কবে হবে, তা-ও কেউ বলতে পারছে না। বিদেশি কত দায় যে অনিষ্পন্ন হয়ে আছে, তা বের করা জরুরি। আইএমএফের শর্ত পূরণ করার জন্য ডলার কিনছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকের কাছে ডলার নেই, এমন সময়ে ডলার কিনতে নিশ্চয়ই পেশাদারত্ব দেখানো হয়নি। এভাবে রিজার্ভ বাড়ানো কোনো দীর্ঘমেয়াদি সমাধান নয়।”
আমদানি কমায় অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২০২১ সালের আগস্টে রিজার্ভ ৪৮ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলারে উঠে গিয়েছিল; এক বছর আগে গত বছরের ২১ জুন রিজার্ভ ছিল ৪১ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলার।
এর পর থেকে ধারাবাহিকভাবে কমতে কমতে ৩০ বিলিয়ন ডলারের নেমে এসেছে।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুত থাকতে হয়। গত এপ্রিলে ৫ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার আমদানি খরচ হিসাবে বর্তমানের নিট রিজার্ভ দিয়ে সাড়ে চার মাসের আমদানি খরচ মেটানো যাবে।
কমেন্ট