প্রথম দিন রুপিতে ২ কোটি ৮০ লাখ ডলারের এলসি
বগুড়ার কোম্পানি তামিম এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের কাছ থেকে ১ কোটি ৬০ লাখ রুপির পণ্য কেনার জন্য ভারতীয় আমদানিকারকের এলসি খোলার মধ্য দিয়ে শুরু হয় প্রথম লেনদেন। ছবি: এআরএইচ ডটকম
প্রতিবেশি দুই দেশ বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের নতুন অধ্যায় শুরু হলো। দীর্ঘ আলোচনার পর অবশেষে ভারতের সঙ্গে রুপিতে লেনদেনের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হলো; শেষ হলো বহুল প্রতিক্ষিত এই দিনের অপেক্ষা।
মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর লো মেরিডিয়ান হোটেলে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ভারতীয় হাইকমিশনের যৌথ আয়োজনে এক অনুষ্ঠানে দুই দেশের মধ্যে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে রুপির ব্যবহার শুরুর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়া হয়।
উদ্বোধন অনুষ্ঠানে দুই দেশের দুই প্রতিষ্ঠান রুপিতে ২ কোটি ৮০ লাখ ডলারের এলসি (ঋণপত্র) খুলেছে। বগুড়ার কোম্পানি তামিম এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের কাছ থেকে ১ কোটি ৬০ লাখ ভারতীয় রুপির পণ্য কেনার জন্য ভারতীয় আমদানিকারকের এলসি (ঋণপত্র) খোলার মধ্য দিয়ে শুরু হয় প্রথম লেনদেন।
স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (এসবিআই) ঢাকা শাখার মাধ্যমে এ রপ্তানি করা হয়। ভারতের আমদানিকারক ঋণপত্র ( এলসি) খোলেন দেশটির আইসিআইসিআই ব্যাংকের মাধ্যমে।
অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে রুপিতে প্রথম আমদানির এলসি খোলে নিটা কোম্পানি। এসবিআই ঢাকা শাখার মাধ্যমে তারা এক কোটি ২০ লাখ রুপির পণ্য আমদানির আদেশ দেয়। এসবিআই এর মুম্বাই শাখা পণ্য আমদানিতে ভারতে প্রতিনিধি ব্যাংক হিসেবে কাজ করবে।
প্রথম আমদানি-রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি হিসেবে কোম্পানিগুলোর মালিকদের অনুষ্ঠানে দেওয়া হয় স্মারক উপহার।
বৈদেশিক বাণিজ্যে লেনদেন সহজ করতে এবং ব্যয় সাশ্রয়ে বিকল্প মুদ্রা চালুর উদ্যোগ নিতে গত কয়েক মাস ধরে ভারত ও বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে আলোচনা চলে। সেই ধারাবাহিকতায় সীমিত পরিসরে রুপিতে লেনদেন শুরু হলো।
এর ফলে উভয় দেশের উদ্যোক্তাদের বাণিজ্য খরচ কমে আসার পাশাপাশি ডলার নির্ভরতাও কিছুটা কমে আসবে বলে আশা করছেন ব্যাংকার, অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা।
শুরুতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ও বেসরকারি ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড (ইবিএল) এবং ভারতের স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (এসবিআই) ও আইসিআইসিআই ব্যাংক রুপিতে বাণিজ্য লেনদেন নিষ্পত্তিতে অংশ নিচ্ছে।
দেড় বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও ডলার সংকট দেখা দেয়। হু হু করে বাড়তে থাকে ডলারের দর; কমতে থাকে টাকার মান। বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে ৩০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে।
দেশে এখনও ডলার সংকট কাটেনি। এ পরিস্থিতিতে বারত-বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্যে অর্থাৎ আমদানি-রপ্তানিতে মার্কিন ডলারের বিকল্প হিসেবে টাকা-রুপিতে লেনদেনের বিষয়টি ঘুরেফিরেই আলোচনায় আসে।
দীর্ঘ আলোচনার পর অবশেষে দু দেশের মধ্যে আমদানি-রপ্তানি রুপিতে করার যুগ শুরু হলো। প্রতিবেশী দেশ দুটির মধ্যে ডলারের মাধ্যমে এতদিন ধরে চলা বাণিজ্যিক লেনদেনে এবার যুক্ত হলো রুপি।
উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় কুমার ভার্মা বলেন, “শেষ ১০ বছরে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক শক্তিশালী হয়েছে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের আমলে এই সম্পর্কের ভিত আরও মজবুত হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে রুপিতে লেনদেন শুরু হওয়ার মাধ্যমে বানিজ্য আরও বাড়বে।”
“এতে দুদেশেরই বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের উপর চাপ কম পড়বে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুল রউফ তালুকদার বলেন, “বাংলাদেশ ভারতে ২ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করে। তবে রুপির মাধ্যমে বাণিজ্য শুরু হয়ায় তা অনেকগুণ বেড়ে যাবে বলে আমি আশা করছি।”
অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠানবিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ বলেন, “রুপিতে বাণিজ্য নিষ্পত্তি হওয়ায় আমাদের ডলারের সঙ্গে মুদ্রা বিনিময় করলে যে আর্থিক ক্ষতি হয়, তা আর হবে না। এটি শুধু লেনদেন নয়, দুই দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কে আরো বৈচিত্র্য নিয়ে আসবে।”
বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, বাংলাদেশ সব সময় ভারতকে ‘সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু’ হিসেবে বিবেচনা করে। বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বাণিজ্য অংশীদার ভারত।
“বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও। শুধু পণ্য আমদানিতে নয়, সেবা, ভ্রমণ ও অন্যান্য খাতেও রুপি ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। এই সম্ভাবনাকে আমাদের কাজে লাগতে হবে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নে।”
প্রথমে ভারতীয় মুদ্রায় লেনদেন শুরু হলেও পরবর্তী সময়ে এ সুবিধা মিলবে টাকাতেও। এতে বৈদেশিক মুদ্রায় চাপ কমবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি অনেক। এমন উদ্যোগের সুফল নিয়ে ব্যবসায়ী এবং বিশ্লেষকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে। বলা হচ্ছে, রুপি আন্তর্জাতিক মুদ্রা নয়, এর ফলে ভারতীয় মুদ্রার চাহিদা বাড়বে, শক্তিশালী হবে রুপি।
তবে কেউ কেউ বলছেন, ডলারের আধিপত্য কমিয়ে আনতে এটি একটি পদক্ষেপ মাত্র। ভবিষ্যতে টাকাতেও লেনদেনের উদ্যোগ নিতে হবে।
ভারতের সঙ্গে মার্কিন ডলারে লেনদেনের বিদ্যমান ব্যবস্থার পাশাপাশি রুপিতে লেনদেন শুরু হলো। তবে রুপিতে যে পরিমাণ রপ্তানি আয় হবে, শুধু সমপরিমাণ আমদানি দায় মেটাতে ভারতীয় এ মুদ্রা খরচ করা যাবে।
কোনো ব্যাংক বা ব্যবসায়ী ডলার কিংবা অন্য কোনো বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে রুপি কিনে আমদানি দায় নিষ্পত্তি করতে পারবে না।
লেনদেন হবে যেভাবে
প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে রুপিতে লেনদেনের প্রক্রিয়া চালু করতে দুই দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদনে ভারতের ব্যাংকগুলোতে রুপিতে ‘নস্ট্র অ্যাকাউন্ট’ খুলেছে সোনালী ও ইবিএল। নস্ট্র হিসাব হল- বিদেশের কোনো ব্যাংকে বিদেশি মুদ্রায় লেনদেন করতে খোলা হিসাব।
এর ফলে ডলারের মাধ্যমে এলসি বা ঋণপত্র খোলার প্রচলিত পদ্ধতির পাশাপাশি রুপিতে বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানির জন্য ভারতের ব্যাংক দুটিতে ঋণপত্র খুলতে পারবেন দেশটির আমদানিকারকরা।
একইভাবে ভারত থেকে পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের ব্যাংক দুটিতে ঋণপত্র খুলতে পারবেন আমদানিকারকরা।
বাংলাদেশ যে পরিমাণ পণ্য ভারতে রপ্তানি করবে, তার বিপরীতে প্রাপ্ত রপ্তানি আয়ের সমপরিমাণ অর্থের পণ্য আমদানি করা যাবে রুপিতে।
টাকার বিপরীতে রুপিতে বিনিময় হার ব্যাংকগুলোকে সরবরাহ করে থাকে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ হার ধরে পণ্য আমদানি ও রপ্তানি খরচ নির্ধারণ করবে ব্যাংকগুলো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ভারত থেকে এক হাজার ৩৬৯ কোটি ডলার আমদানি দায় পরিশোধ করা হয়; যা মোট আমদানি ব্যয়ের ১৮ দশমিক ১০ শতাংশ। এর বিপরীতে রপ্তানি করা হয় ১৯৯ কোটি ডলার।
বিদেশি মুদ্রা লেনদেনে আর্থিক পরিষেবা হিসেবে আন্তর্জাতিক লেনদেন মাধ্যম সুইফট সিস্টেমকে ব্যবহার করা হয়। কোনো দেশের সঙ্গে বিদেশি মুদ্রায় বাণিজ্য লেনদেন নিষ্পত্তি করতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) স্বীকৃত মুদ্রায় করতে হয়। সুইফট সিস্টেমে এখনও রুপি অন্তভূক্ত করা হয়নি।
ইউএস ডলার, ইউরো, পাউন্ড, চীনের মুদ্রা ইউয়ান ও জাপানের ইয়েন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের স্বীকৃত মুদ্রা। এর বাইরের কোনো মুদ্রায় লেনেদেন করতে হলে প্রয়োজন হয় দ্বিপক্ষীয় চুক্তি। বাংলাদেশ ও ভারত সেটাই চালু করল।
কমেন্ট