কার্ডে বিদেশি মুদ্রা লেনদেনে রেকর্ড
মে মাসে কার্ডের মাধ্যমে ৬৬০ কোটি টাকার বিদেশি মুদ্রা লেনদেন হয়েছে। এই অঙ্ক গত বছরের মে মাসের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। ফাইল ছবি
গত মে মাসে কার্ডের মাধ্যমে ৬৬০ কোটি টাকার বিদেশি মুদ্রা লেনদেন হয়েছে। এই অঙ্ক একক মাসের হিসাবে সবচেয়ে বেশি। এর আগে কখনই কোনো মাসে কার্ডের মাধ্যমে এত বেশি টাকা লেনদেন হয়নি।
গত বছরের মে মাসের চেয়ে এই লেনদেন প্রায় দ্বিগুন। ২০২২ সালের মে মাসে এ ধরনের লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৩৫৮ কোটি টাকা।
ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির কারণে বিদেশ ভ্রমণ ও চিকিৎসার খরচ বেড়ে যাওয়ায় কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন বেড়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকাররা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “ ডলার সংকটের কারণে ভ্রমণকারীরা বিদেশে কার্ডের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেনেকে বেশি সুবিধাজনক বলে মনে করছেন। এতে কার্ডের ব্যবহার বেড়েছে।”
বাংলাদেশ ব্যাংক বৃহস্পতিবার কার্ডের মাধ্যমে বিদেশি মুদ্রার লেনদেনের সবশেষ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১১ মাসে অর্থাৎ জুলাই-মে সময়ে কার্ডভিত্তিক বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেনের পরিমাণ দাঁড়ায় ৬ হাজার ৩৪৯ কোটি টাকা।
২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ২ হাজার ৫৪৬ কোটি টাকা।
এ হিসাবে এই সময়ে কার্ডের মাধ্যমে বিদেশি মুদ্রার লেনদেন বেড়েছে ১৪৯ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
ব্যাংকাররা বলছেন, বিদেশ ভ্রমণকালে মানুষ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবহার করে থাকেন।
কার্ড ব্যবহারের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন ভ্রমণকারীদের জন্য তুলনামূলক সুবিধাজনক। কারণ এতে নগদ অর্থ বহনের ঝামেলা এড়ানো যায়।
পাশাপাশি দেশের ব্যাংক ও এক্সচেঞ্জ হাউজগুলোতে ডলারের ঘাটতি চলছে। ফলে ভ্রমণকারীরা বিদেশে খরচ মেটাতে কার্ডের ব্যবহার বাড়িয়েছেন।
অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশের মহাসচিব আবদুস সালাম আরেফ এআরএইচ ডটকমকে বলেন, "রোজার ঈদের আগে ওমরার যাত্রী ছিল অনেক। তারা বিদেশে গিয়ে কার্ডের মাধ্যমে খরচ করেছেন, যার কারণে লেনদেন বেড়েছে।"
তিনি বলেন, "সধারণত মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ট্রাভেল হয়ে থাকে বেশি, কারণ এই সময়ে স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকে। বর্তমানে ভারত, মালেয়েশিয়া ও দুবাইয়ের যাত্রী অনেক।"
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্কমর্তা বলেন, বিশ্ববাজারে মূল্যস্ফীতি অনেক বেড়েছে, যার কারণে ভ্রমণ ও চিকিৎসা খরচ আগের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, "এক বছরে আগে সৌদিতে যে খাবারের জন্য ১৫ ডলার খরচ হয়েছে; এখন তার জন্য লাগছে ৩০ ডলার। সে কারণেই লেনেদেনের পরিমাণটাও বেড়ে গেছে।"
ভিসা বা মাস্টারকার্ডের মতো আন্তর্জাতিক পেমেন্ট নেটওয়ার্ক দ্বারা ইস্যুকৃত কার্ডগুলো সারাবিশ্বে ব্যাপকভাবে গৃহীত ও জনপ্রিয়।
ভ্রমণকারীরা মূলত বিমান ভাড়া, ভ্রমণ খরচ, হোটেল বুকিংসহ কেনাকাটার খরচ মেটাতে এ ধরনের কার্ড ব্যবহার করে থাকেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, প্রত্যেক কার্ডধারী ব্যক্তিগত এনটাইটেলমেন্ট হিসেবে বছরে ১২ হজার ডলার পর্যন্ত খরচ করতে পারেন।
কার্ডের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন বৃদ্ধি দেশের মুদ্রা বাজারে চাপ সৃষ্টি করছে বলে জানান ব্যাংকাররা।
এদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কথামতো বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংক ‘গ্রস’ হিসাবের পাশাপাশি বিপিএম৬ পদ্ধতি অসুসরণ করেও রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, বুধবার দিন শেষে ‘গ্রস’ রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৯ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার। আর বিপিএম৬ পদ্ধতিতে রিজার্ভ ছিল ২৩ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার।
গত মে মাসে পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের ৬ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। সে হিসাবে ২৩ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ দিয়ে চার মাসের কম সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুত থাকতে হয়।
দীর্ঘদিন ধরে আইএমএফ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বিপিএম৬ (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন) পদ্ধতি অনুসরণ করে রিজার্ভের হিসাব করতে বাংলাদেশ সরকার তথা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পরামর্শ দিয়ে আসছিল।
কিন্তু বাংলাদেশ এতদিন সে বিষয়টি আমলে নেয়নি। আমদানি দায় পরিশোধ করতে গিয়ে বাংলাদেশের ব্যালেন্স অব পেমেন্টে ঘাটতি দেখা দেয়। সেই ঘাটতি সামাল দিতে গত জানুয়ারিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফের কাছে ৪৭০ কোটি (৪.৭ বিলিয়ন) ডলার ঋণ পেতে সমঝোতা করে বাংলাদেশ।
ঋণ সমঝোতার পর আন্তর্জাতিক এ সংস্থার পরামর্শ আসে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গণনায় আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিপিএম৬ পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে।
ঋণ পেতে বাধ্য হয়ে বাংলাদেশ আইএমএফের সেই পরামর্শ মানতে রাজি হয়। সে মোতাবেক বৃহস্পতিবার থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক ‘গ্রস’ হিসাবের পাশাপাশি বিপিএম৬ পদ্ধতি অনুসরণ করেও রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ শুরু করেছে।
২০২১ সালের আগস্ট শেষে বাংলাদেশের ‘গ্রস’ রিজার্ভ অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ৪৮ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারে উঠেছিল।
আমদানি বিল পরিশোধের চাপে সেই রিজার্ভ কমতে কমতে এখন ৩০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) সব মিলিয়ে ৬ হাজার ৪৭৬ কোটি ৪০ লাখ (৬৪.৭৬ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। যা ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ের তুলানায় ১৪ দশমিক ১১ শতাংশ কম।
২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানি ব্যয় বেড়েছিল ৩৫ শতাংশের বেশি।
স্থানীয় মুদ্রার লেনদেন কমেছে
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত মে মাসে কার্ডের মাধ্যমে স্থানীয় মুদ্রার লেনদেন এপ্রিলের তুলনায় ৫ হাজার ২৬৪ কোটি টাকা বা ১১ শতাংশ কমেছে।
মে মাসে স্থানীয় মুদ্রায় লেনদেন হয়েছে ৪২ হাজার ১২১ কোটি টাকা। আগের মাস এপ্রিলে এই অঙ্ক ছিল ৪৭ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা।
ব্যাংকাররা বলছেন, মে মাস রোজার ঈদের পরের মাস ও কোরবানি ঈদের আগের মাস হওয়ায় এই সময়ে গ্রাহকদের লেনদেন কম হয়েছে।
কমেন্ট