ব্যাংকের সংখ্যা অর্ধেক করার পরামর্শ আইএফএসি কান্ট্রি ম্যানেজারের
সোমবার অ্যামচেম আয়োজিত অনুষ্ঠানে ‘বাংলাদেশে উন্নয়ন অংশীদার হিসাবে আইএফএসি’র ভূমিকা’ শীর্ষক বক্তৃতা দেন মার্টিন হল্টমান। ছবি: সংগৃহীত
আর্থিক খাতের সংস্কারে বাংলাদেশ ‘সঠিক পথেই এগোচ্ছে’ বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্ব ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইএফএসি) কান্ট্রি ম্যানেজার মার্টিন হল্টমান। এই সংস্কারের অংশ হিসেবে আগামী দশ বছরে ব্যাংকের সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
আর্থিক খাতের সাম্প্রতিক সংস্কার প্রক্রিয়াকে সাধুবাদ জানিয়ে মার্টিন হল্টমান বলেছেন, “আর্থিক খাতের সংস্কার প্রক্রিয়া ‘সঠিক পথেই এগোচ্ছে’। তবে, সেটা প্রয়োজনীয় দ্রুততার সঙ্গে হচ্ছে কি-না, তা এখন আলোচনার বিষয় হতে পারে। সংস্কার প্রক্রিয়া চলছে। আমি বলব এসব সংস্কার যদি না হয়, তাহলে এই দেশ সামনে এগোবে না। সুতরাং এগুলো মৌলিক বিষয়।”
সোমবার ঢাকার একটি হোটেলে আমেরিকান চেম্বার চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশ (অ্যামচেম) আয়োজিত অনুষ্ঠানে তিনি এ সব কথা বলেন।
মার্টিন হল্টমান বাংলাদেশের পাশাপাশি নেপাল ও ভুটানেও আইএফএসি’র কান্ট্রি ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের চাপের মুখে অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফেরাতে গতবছর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে ঋণের আবেদন করে বাংলাদেশ। ঋণ চুক্তির সময় বাংলাদেশ বেশ কিছু ক্ষেত্রে সংস্কারের শর্তে সম্মতি দিয়েছিল।
৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের মধ্যে ফেব্রুয়ারিতে প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ডলার হাতে পায় বাংলাদেশ। এর আগে ও পরে শর্ত মেনে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি কমানোসহ আর্থিক খাতের কাঠামো ও নীতি সংস্কারে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া শুরু হয়।
বাজেট ঘাটতি কমিয়ে আনতে কর অব্যাহতি দেওয়া বন্ধ করার পাশাপাশি কর-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধি এবং আর্থিক খাত সংস্কারের পরামর্শও দিয়ে আসছে আইএমএফ।
আইএমএফের শর্তের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পর্যায়ক্রমে ভুর্তকি কমিয়ে আনা, কর বাড়াতে রাজস্ব খাতের সংস্কার এবং আর্থিক খাতে সুশাসন আনতে বড় সংস্কারের ঘোষণা এসেছে চলতি বছরের বাজেটে।
এছাড়া বাজারভিত্তিক সুদহার চালু, ডলারের একাধিক বিনিময় হারের মধ্যে ব্যবধান কমিয়ে আনা, রিজার্ভ বাড়াতে সাশ্রয়ী অর্থায়ন সংগ্রহ, বিদেশ ভ্রমণে কর বৃদ্ধি ও খেলাপী ঋণ কমাতে ব্যাসেল-৩ বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
গত ১৮ জুন বাংলাদেশ ব্যাংক জুলাই-ডিসেম্বর মেয়াদের যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে, তা আইএমএফের পরামর্শেই করা হয়েছে বলে অভিমন দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
গত ১৩ জুলাই থেকে আইএমএফের কথামতো রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই দিন থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘গ্রস’ হিসাবের পাশাপাশি বিপিএম৬ পদ্ধতি অসুসরণ করেও রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
দীর্ঘদিন ধরে আইএমএফ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বিপিএম৬ (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন) পদ্ধতি অনুসরণ করে রিজার্ভের হিসাব করতে বাংলাদেশ সরকার তথা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পরামর্শ দিয়ে আসছিল।
কিন্তু বাংলাদেশ সে বিষয়টি আমলে নেয়নি। আমদানি দায় পরিশোধ করতে গিয়ে বাংলাদেশের ব্যালেন্স অব পেমেন্টে ঘাটতি দেখা দেয়। সেই ঘাটতি সামাল দিতে গত জানুয়ারিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফের কাছে ৪৭০ কোটি (৪.৭ বিলিয়ন) ডলার ঋণ পেতে সমঝোতা করে বাংলাদেশ।
ঋণ সমঝোতার পর আন্তর্জাতিক এ সংস্থার পরামর্শ আসে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গণনায় আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিপিএম৬ পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে।
বাাংলাদেশ ব্যাংক আইএমএফের সেই শর্ত বা পরামর্শ মেনেই এখন রিজার্ভের দুই ধরনের তথ্যই প্রকাশ করছে।
এ সব সংস্কার প্রক্রিয়া চলমান থাকার মধ্যেই সোমবার অ্যামচেম আয়োজিত অনুষ্ঠানে ‘বাংলাদেশে উন্নয়ন অংশীদার হিসাবে আইএফএসি’র ভূমিকা’ শীর্ষক বক্তৃতা দেন মার্টিন হল্টমান।
ব্যাংক খাতে সংস্কারের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ সঠিক রয়েছে বলে মন্তব্য করেন বেসরকারি খাতের অর্থায়ন নিয়ে কাজ করা বিশ্ব ব্যাংক গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান আইএফসির এই কর্মকর্তা।
সংস্কার চলমান রেখে ব্যাংক খাতকে শক্তিশালী ভিত্তি দেওয়ার সুপারিশ করে তিনি বলেন, “ব্যবস্থাটাকে পরিচ্ছন্ন করার কাজ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক চমৎকার কাজ করছে এবং সবাইকে এজন্য প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
তিনি বলেন “আগামী দশ বছরে ব্যাংকের সংখ্যা অর্ধেক হোক, তাদেরকে একীভূত হতে হবে, যেভাবে নেপাল করেছে। তাতে ব্যাংকগুলো এখনকার চেয়ে অনেক বেশি মূলধনী হবে এবং পরিচালন ব্যয়ের ক্ষেত্রে খরচ কমবে।”
নিজের এই বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি দিয়ে হল্টমান বলেন, “প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সুদ হারের কারণে দিনশেষে ব্যাংকগুলোর অদক্ষতা এবং ঋণের লোকসান গ্রাহককেই পরিশোধ করতে হয়। ব্যাংকের অদক্ষতার মাশুল তাদেরকেই দিতে হয়।”
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ ‘সঠিক পথে এগোচ্ছে’ বলে মন্তব্য করে আইএফসির কান্ট্রি ম্যানেজার। তিনি বলেন, “নির্দিষ্ট বিনিময় হারের পদ্ধতি ক্রমান্বয়ে উদার হচ্ছে এবং এর কোনো বিকল্প নেই। দীর্ঘ মেয়াদে আমাদেরকে সেই উদার অবস্থানে যেতে হবে।”
বর্তমানে বাংলাদেশে মোট ৬১ ব্যাংক রয়েছে। এর মধ্যে ছয়টি সরকারি মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক, তিনটি বিশেষায়িত ব্যাংক, ৪৩টি বেসরকারি ব্যাংক এবং নয়টি বিদেশি ব্যাংক।
এরমধ্যে কয়েকটি ব্যাংকের অবস্থা ‘খুবই’ খারাপ বলে বাংলাদেশ ব্যাংক চিহ্নিত করেছে।
অর্থনীতির আকারের তুলনায় বাংলাদেশের ব্যাংকের সংখ্যা অনেক বেশি বলে দীর্ঘদিন ধরেই দেশি-বিদেশি অর্থনীতিবিদরা বলে আসছেন।
অ্যামচেম সভাপতি সৈয়দ এরশাদ আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সংগঠনের সহসভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ কামাল।
কমেন্ট