বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি: ১০.৫৭% শতাংশে শেষ হলো অর্থবছর
এক বছরে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি কমেছে ৩ দশমিক শূন্য নয় শতাংশীয় পয়েন্ট। আর মুদ্রানীতিতে ধরা লক্ষ্যের চেয়ে এই প্রবৃদ্ধি কম আরও বেশি, ৩ দশমিক ৫৩ শতাংশীয় পয়েন্ট।
শেষ পর্যন্ত দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধিতে হতাশাজনক চিত্র নিয়েই শেষ হলো ২০২২-২৩ অর্থবছর।
৩০ জুন অর্থবছর শেষ হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক বৃহস্পতিবার বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধির তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ৫৭ শতাংশ। আগের অর্থবছর অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থতবছর শেষ হয়েছিল ১৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে।
এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এই এক বছরে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি কমেছে ৩ দশমিক শূন্য নয় শতাংশীয় পয়েন্ট। আর মুদ্রানীতিতে ধরা লক্ষ্যের চেয়ে এই প্রবৃদ্ধি কম আরও বেশি, ৩ দশমিক ৫৩ শতাংশীয় পয়েন্ট।
বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরের শেষার্ধের (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরেছিল ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ।
লক্ষ্যের অনেক পেছনে থাকায় গত ১৮ জুনে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছেন, তাতে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরেছেন ১১ দশমিক ১০ শতাংশ।
গত কয়েক মাস ধরে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি কমছেই। দুই বছরের করোনা মহামারির ধকল কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিল বাংলাদেশের অর্থনীতি। বেশ ভালোই বাড়ছিল বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি।
গত বছরের আগস্টে ১৪ শতাংশ ছাড়িয়ে এই প্রবৃদ্ধি ১৪ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশে উঠেছিল। এরপর থেকে কমছেই। সর্বশেষ জুনে ১০ দশমিক ৫৭ শতাংশে নেমে এসেছে ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষ হয়েছে। আগে মাস মে’তে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ১০ শতাংশ।
তার আগের মাস এপ্রিলে ছিল ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ। মার্চে ছিল ১২ দশমিক শূন্য তিন শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ দশমিক ১৪ শতাংশ।
জানুয়ারিতে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১২ দশমিক ৬২ শতাংশ। ডিসেম্বরে ছিল ১২ দশমিক ৮৯ শতাংশ। নভেম্বরে ছিল ১৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ। অক্টোবর, সেপ্টেম্বর ও আগস্টে ছিল যথাক্রমে ১৩ দশমিক ৯১ শতাংশ, ১৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ ও ১৪ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “কয়েক মাস ধরেই বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমছে। অথচ করোনার মধ্যেও এই ঋণ প্রবৃদ্ধি বাড়ছিল। করোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকার যে প্রণোদনা ঘোষণা করেছিল, তাতে এর অবদান ছিল। এ ছাড়া করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় দেশে বিনিয়োগের একটি অনুকূল পরিবেশও দেখা দিয়েছিল।”
তিনি বলেন, “পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু কর্ণফুলী টানেলসহ কয়েকটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলকে ঘিরে উদ্যোক্তারা নতুন পরিকল্পনা সাজিয়ে বিনিয়োগে নেমেছিলেন। ব্যাংকগুলোও তাতে বিনিয়োগ করছিল। সব মিলিয়ে বেসরকারি খাতের ঋণের একটি গতি এসেছিল।
কিন্তু দেড় বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিয়েছে। ডলারের অস্বাভাবিক দর বাড়ার কারণে আমদানিকারকদের এলসি খুলতে বেশি টাকা লাগছে। তাতে ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেছে।”
আহসান মনসুর বলেন, “বিশ্ববাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম এবং ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধিতে বেসরকারি খাতের ঋণের বড় অংশ চলে যাচ্ছে আমদানি খাতে। অর্থাৎ বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধির মূল কারণ অর্থনীতির বহিঃস্থ খাতের অস্থিরতা। ফলে আগামী দিনে উৎপাদন এবং কর্মসংস্থানে বড় নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে সরকার নতুন অর্থবছরেও ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের যে লক্ষ্য ধরেছে সেটা অর্জন কোনোভাবেই সম্ভব নয়।”
তবে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঠিক কাজটিই করছে মন্তব্য করে দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে (আইএমএফ) গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা এই অর্থনীতিবিদ বলেন, “আমদানি ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরাটা খুবই দরকার ছিল। সেটা সুফল হওয়া গেছে বলে আমি মনে করি। এই কৃচ্ছ্রসাধন আরও কিছুদিন চালাতে হবে। বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) প্রবৃদ্ধির দিকে না তাকিয়ে এখন মূল্যস্ফীতি সহনীয় রাখার দিকেই সবচেয়ে বেশি নজর দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে আগামী কয়েক মাস যদি বেসরকারি খাত ঋণ কমও পায়, তাতেও খুব একটা সমস্যা হবে না।”
“এখন আমাদের সংকট বা চাপ থেকে বের হয়ে আসার সময়। এ অবস্থায় যদি জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশও হয়, তাও আমি যথেষ্ট বলে মনে করি। কিন্তু মূল্যস্ফীতি যাতে কোনো অবস্থাতেই দুই অঙ্কের ঘর (ডাবল ডিজিট) অতিক্রম না করে, সেটার দিকে সজাগ থাকতে হবে,” বলেন মনসুর।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে গত অর্থবছরের শেষ মাস জুনে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে প্রায় ১০ শতাংশ, ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। অর্থবছর শেষ হয়েছে ৯ দশমিক শূন্য দুই শতাংশ গড় মূল্যস্ফীতি নিয়ে।
১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে আটকে রাখার লক্ষ্য ধরেছে সরকার। বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে যো কোনোভাবেই সম্ভব নয় বলে, আহসান মনসুরসহ দেশের অন্য অর্থনীতিবিদরা ১ জুন বাজেট ঘোষণার পর থেকেই বলে আসছেন।
২০২১ সালের আগস্ট থেকে দেশে আমদানি ব্যয় বাড়তে থাকে। বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়ে যায়। টাকার বিপরীতে ডলারের দর অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকে। ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমদানি ব্যয় কমিয়ে আনতে একটার পর একটা পদক্ষেপ নিতে শুরু করে। যার সুফল জুন থেকে পড়া শুরু করে। এখনো পাওয়া যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্য বলছে, বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) ৬৪ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা, যা ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৪ দশমিক ১১ শতাংশ কম।
এই ১১ মাসে মূলধনি যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারি) আমদানির জন্য এলসি (ঋণপত্র) খোলার পরিমাণ কমেছে কমেছে ৫৫ দশমিক ১ শতাংশ। শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমেছে ৩০ দশমিক ১৫ শতাংশ; মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি কমেছে ২৪ দশমিক ৩০ শতাংশ। তবে জ্বালানি তেল আমদানিতে খরচ বেড়েছে ৪ দশমিক ৭৩ শতাংশ।
অন্যদিকে গত এক বছরে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে ১৫ দশমিক ১৪ শতাংশ। বৃহস্পতিবার আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলারের জন্য ১০৯ টাকা খরচ করতে হয়েছে। ২০২২ সালের ২৬ জুলাই লেগেছিল ৯৪ টাকা ৬৭ পয়সা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, টানা বাড়তে বাড়তে ২০২২ সালের প্রথম মাস জানুয়ারিতে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি ১১ শতাংশ ছাড়িয়ে ১১ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশে উঠে যায়। তবে ফেব্রুয়ারিতে এই প্রবৃদ্ধি কমে ১০ দশমিক ৭২ শতাংশে নেমে আসে।
মার্চে তা দশমিক ৫৭ শতাংশীয় পয়েন্ট বেড়ে ১১ দশমিক ২৯ শতাংশে ওঠে। এপ্রিল মাসে তা ১২ শতাংশ ছাড়িয়ে ১২ দশমিক ৪৮ শতাংশে ওঠে। মে মাসে তা আরও বেড়ে ১২ দশমিক ৯৪ শতাংশ ওঠে। জুন মাসে ১৩ শতাংশ ছাড়িয়ে ১৩ দশমিক ৬৬ শতাংশে ওঠে।
২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে তা আরও বেড়ে ১৩ দশমিক ৯৫ শতাংশে উঠেছিল। পরের মাস আগস্টে ১৪ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়।
কমেন্ট