‘বিকাশ ডিজিটাল ব্যাংক’ নিয়ে আসছে ব্র্যাক ব্যাংক
২০১১ সালের ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে এমএফএস (মোবাইল ফোনে আর্থিক সেবা) চালু করে বিকাশ। বিকাশের ৫১ শতাংশ শেয়ার ব্র্যাক ব্যাংকের হাতে, বাকিটার মালিক বিভিন্ন বিদেশি প্রতিষ্ঠান।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্র্যাক ব্যাংক আলোচিত ডিজিটাল ব্যাংক স্থাপনে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দেশের দ্বিতীয় কোনো বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক ডিজিটাল ব্যাংক স্থাপনের ঘোষণা দিল।
ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান বিকাশের মাধ্যমে এই ডিজিটাল ব্যাংকের কার্যক্রম পরিচালিত হবে। প্রস্তাবিত নাম দেওয়া হয়েছে ‘বিকাশ ডিজিটাল ব্যাংক পিএলসি’। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি পেলে ডিজিটাল ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করতে চায় ব্রাক ব্যাংক।
সোমবার দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ওয়েবসাইটে এ বিষয়ে একটি ‘প্রাইস সেনসেটিভ ইনফরমেশন’ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ব্র্যাক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় ডিজিটাল ব্যাংক স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
এসিআই লিমিটেড, ব্যাংক এশিয়া ও ক্রিস্টাল ইনস্যুরেন্সের পর ব্র্যাক ব্যাংক চতুর্থ প্রতিষ্ঠান, যারা ডিজিটাল ব্যাংকে বিনিয়োগের পরিকল্পনার কথা জানালো।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত ২১ জুন ডিজিটাল ব্যাংক গঠনের জন্য আবেদনের আহ্বান করে।
রোববার উদ্যোক্তাদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ বিস্তারিত ও মানসম্মত আবেদনপত্র তৈরিতে আরও সময় দিতে এর সময়সীমা ১৭ আগস্ট পর্যন্ত বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ব্র্যাক ব্যাংক জানিয়েছে, গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ব্যাংকটির শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) আগের বছরের তুলনায় ৪১ শতাংশ বেড়ে ১ টাকা ৯৩ পয়সা হয়েছে।
২০১১ সালের ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে এমএফএস (মোবাইল ফোনে আর্থিক সেবা) চালু করে বিকাশ। বিকাশের ৫১ শতাংশ শেয়ার ব্র্যাক ব্যাংকের হাতে, বাকিটার মালিক বিভিন্ন বিদেশি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে শুরু থেকেই বিকাশের মালিকানায় যুক্ত রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মানি ইন মোশন এলএলসি।
২০১৩ সালে বিশ্বব্যাংক গ্রুপের সদস্য ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি), ২০১৪ সালের এপ্রিলে বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন ও ২০১৮ সালে চীনের আলিবাবা গ্রুপের অধিভুক্ত অ্যান্ট ফিন্যান্সিয়াল (আলি-পে) বিকাশের মালিকানায় যুক্ত হয়।
সরকারের কল্যাণ কর্মসূচিরও অন্যতম সহযোগী হিসেবে সব ধরনের ভাতা, প্রণোদনা, ও উপবৃত্তি স্বচ্ছতার সাথে প্রকৃত উপকারভোগীর কাছে পৌঁছে দিচ্ছে বিকাশ।
সরকারের স্মার্ট বাংলাদেশ রূপকল্পের অন্যতম ভিত্তি স্মার্ট অর্থনীতি বাস্তবায়নে ডিজিটাল লেনদেনের ইকোসিস্টেম শক্তিশালী করতে নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বিকাশ।
সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপকল্পের অন্যতম সহযোগী হিসেবে একযুগ আগে যাত্রা শুরু করে বিকাশ। ব্যাংকিং সেবার বাইরে থাকা বিশাল জনগোষ্ঠীকে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির আওতায় আনার পাশাপাশি সবার দৈনন্দিন লেনদেনে আরো সক্ষমতা ও স্বাধীনতা আনার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে বিকাশ।
৭ কোটি গ্রাহক, ৩ লাখ ৩০ হাজার এজেন্ট, সাড়ে ৫ লাখ মার্চেন্ট নিয়ে বিকাশ এখন দেশের প্রতিটি পরিবারের সদস্য। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিগত সহায়তা ও সরকারের দিক-নির্দেশনায় বিকাশ তৈরী হয়েছে পুরোপুরি দেশীয় মেধায় – ‘বিকাশ ইজ মেড ইন বাংলাদেশ, মেড ফর বাংলাদেশ’।
আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে অনন্য প্রতিষ্ঠান বিকাশ বিশ্বের বুকে উদাহরণ তৈরি করেছে।
১৭ আগস্ট পর্যন্ত আবেদন করা যাবে
এদিকে ডিজিটাল ব্যাংকের জন্য আবেদনের সময় বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগামী ১৭ আগস্ট পর্যন্ত আগ্রহী প্রতিষ্ঠানগুলো লাইসেন্স পেতে আবেদন করতে পারবে।
রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিপার্টমেন্ট অব কমিউনিকেশন্স অ্যান্ড পাবলিকেশন্স থেকে এ সংক্রান্ত একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়।
এতে বলা হয়, ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স প্রাপ্তির আবেদনের লক্ষ্যে সকল আবেদনকারীর পূর্ণাঙ্গ ও মানসম্মত প্রস্তাবনা তৈরি এবং বিভিন্ন দলিলাদি সংগ্রহের বিষয়টি বিবেচনা করে আবেদনপত্র দাখিলের সময়সীমা ১৭ আগস্ট পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
গত ২১ জুন ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্সের জন্য আবেদন নেওয়া শুরু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরই মধ্যে ডিজিটাল ব্যাংকের জন্য যৌথমূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তরে (আরজেএসসি) প্রায় ৬০টি নামের ছাড়পত্র আবেদন জমা পড়েছে।
এসব আবেদনের মধ্যে এক ডজনেরও বেশি বাণিজ্যিক ব্যাংক, অন্তত দুটি এমএফএস প্রদানকারী ও দুটি মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটর রয়েছে।
অনলাইন আবেদনের সময়সীমা ১ আগস্ট শেষ হওয়ার কথা থাকলেও বাংলাদেশ ব্যাংক এখনও কোনো আনুষ্ঠানিক আবেদন পায়নি। ব্যবসায়ী সংগঠন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে আবেদনের সময় ১৭ আগস্ট পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
ব্যাংকাররা বলছেন, ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের প্রতি ক্রমেই আগ্রহ বাড়তে থাকায় ব্যাংকিংয়ের ভবিষ্যৎ কীভাবে বদলে যাবে—যেমন: কতগুলো লাইসেন্স দেওয়া হবে, এসব ব্যাংকের অপারেশনাল ফ্রেমওয়ার্ক, প্রথাগত ব্যাংকিংয়ের কর্মসংস্থানের ওপর সম্ভাব্য প্রভাব, এসব ব্যাংক যেসব পণ্য দেবে—তা নিয়ে ব্যাংকাররা ভাবছেন।
ডিজিটাল ব্যাংকের কোনো শাখা উপশাখা বুথ থাকবে না
দেশে ডিজিটাল ব্যাংক স্থাপনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক যে নীতিমালা প্রকাশ করেছে তাতে বলা হয়েছে, এই ব্যাংকের কোনো শাখা, উপশাখা, এটিএম বুথ বা কোনো স্থাপনা থাকবে না। মুঠোফোন অথবা ডিজিটাল যন্ত্র ব্যবহার করেই গ্রাহকদের ব্যাংক সেবা দেওয়া হবে।
এটি গঠনে প্রয়োজন হবে ১২৫ কোটি টাকা, পরিচালক হতে লাগবে কমপক্ষে ৫০ লাখ টাকা।
নীতিমালায় বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে নিত্যনতুন প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে সমগ্র বিশ্বে অন্যান্য খাতের মতো আর্থিক খাতেও সেবা প্রদানের ধরনে বৈচিত্র্য এসেছে। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আর্থিক অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্যে বিভিন্ন বিকল্প ডেলিভারি চ্যানেল, তথা-মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (এমএফএস) এবং অন্যান্য ই-ওয়ালেটের মাধ্যমে ডিজিটাল পদ্ধতিতে আর্থিক সেবা প্রদানের জন্য ব্যাংক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানসমূহকে অনুমতি দিয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারের ঘোষিত লক্ষ্য ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’বিনির্মাণের উদ্দেশ্যে বিশ্বব্যাপী প্রচলিত তথ্য প্রযুক্তিনির্ভর ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবা জনগনের কাছে পৌঁছে দেয়ার মাধ্যমে ক্যাশলেস বাংলাদেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ডিজিটাল ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে ব্যাংক ব্যবস্থার আইনী কাঠামো, দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট, প্রযুক্তিনির্ভর ব্যাংক ব্যবস্থায় বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান ইত্যাদি বিষয়সমূহ বিশ্লেষণপূর্বক ‘ডিজিটাল ব্যাংক স্থাপন বিষয়ক গাইডলাইন্স’প্রণয়ন করা হয়েছে।
শুধু ছোট উদ্যোক্তারা ঋণ পাবেন
নীতিমালা অনুযায়ী, ডিজিটাল ব্যাংক পরিচালনার জন্য প্রধান কার্যালয় থাকবে। তবে সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে এটি হবে স্থাপনাবিহীন। অর্থাৎ এই ব্যাংক কোনো ওভার দ্য কাউন্টার (ওটিসি) সেবা দেবে না। এর নিজস্ব কোনো শাখা বা উপশাখা, এটিএম, সিডিএম অথবা সিআরএমও থাকবে না।
সব সেবাই হবে অ্যাপ–নির্ভর, মুঠোফোন বা ডিজিটাল যন্ত্রে। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই সেবা মিলবে। গ্রাহকদের লেনদেনের সুবিধার্থে ডিজিটাল ব্যাংক ভার্চুয়াল কার্ড, কিউআর কোড ও অন্য কোনো উন্নত প্রযুক্তিভিত্তিক পণ্য দিতে পারবে।
লেনদেনের জন্য কোনো প্লাস্টিক কার্ড দিতে পারবে না। অবশ্য এই ব্যাংকের সেবা নিতে গ্রাহকেরা অন্য ব্যাংকের এটিএম ও এজেন্টসহ নানা সেবা ব্যবহার করতে পারবেন।
ডিজিটাল ব্যাংক কোনো ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারবে না। বড় এবং মাঝারি শিল্পেও কোনো ঋণ দেওয়া যাবে না। শুধু ছোট ঋণ দিতে পারবে।
৫ বছরের মধ্যে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হতে হবে
একেকটি ডিজিটাল ব্যাংক স্থাপনের জন্য ন্যূনতম মূলধন লাগবে ১২৫ কোটি টাকা। প্রচলিত ধারার ব্যাংক করতে প্রয়োজন হয় ৫০০ কোটি টাকা। ডিজিটাল ব্যাংকের প্রত্যেক উদ্যোক্তাকে কমপক্ষে ৫০ লাখ টাকা মূলধন দিতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক লাইসেন্স দেওয়ার পাঁচ বছরের মধ্যে এই ব্যাংককে দেশের পুঁজিবাজারে প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) ছাড়তে হবে।
এই ব্যাংক স্থাপনে উদ্যোক্তাদের অর্ধেককে হতে হবে প্রযুক্তিভিত্তিক ব্যাংকিং, উদীয়মান প্রযুক্তি, সাইবার আইন ও বিধিবিধান বিষয়ে শিক্ষা, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা সম্পন্ন। বাকি অর্ধেককে হতে হবে ব্যাংকিং, ই-কমার্স এবং ব্যাংকিং আইন ও বিধিবিধান বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন।
ডিজিটাল ব্যাংককে কোম্পানি আইন অনুযায়ী প্রচলিত ব্যাংকের মতো সময়ে সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারিত ন্যূনতম নগদ জমা (সিআরআর) ও বিধিবদ্ধ জমা (এসএলআর) বজায় রাখতে হবে।
বর্তমানে দেশে প্রচলিত ধারার ব্যাংক আছে ৬১টি। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ১ জুন জাতীয় সংসদে ২০২৩–২৪ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় ডিজিটাল ব্যাংকিং চালুর ঘোষণা দেন। নতুন অর্থবছরেই এটি চালুর কথা বলেন তিনি।
কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণখেলাপি ব্যক্তি বা তার পরিবারের কোনো সদস্য প্রস্তাবিত ডিজিটাল ব্যাংকের উদ্যোক্তা হতে পারবেন না। এক পরিবার থেকে সর্বোচ্চ কতজন পরিচালক হতে পারবেন, তা ঠিক করা হবে ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী।
ডিজিটাল ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) ব্যাংকিং পেশায় কমপক্ষে ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে—যার মধ্যে প্রযুক্তিভিত্তিক ব্যাংকিং, রেগুলেশন, গাইডলাইন, সার্কুলার ইত্যাদি ক্ষেত্রে কমপক্ষে পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
কমেন্ট