ডলারের বাজার ফের অস্থির, আন্তঃব্যাংকে ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা, খোলাবাজারে ১১৫ টাকা
অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে আন্তঃব্যাংক লেনদেনে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের দর সর্বোচ্চ উচ্চতায় উঠেছে। বুধবার এক ব্যাংক থেকে আরেক ব্যাংকের ১ ডলার কিনতে লেগেছে ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা। কার্ব মার্কেট বা খোলাবাজারে ডলার বিক্রি হচ্ছে ১১৫ টাকায়।
অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে আন্তঃব্যাংক লেনদেনে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের দর সর্বোচ্চ উচ্চতায় উঠেছে। বুধবার এক ব্যাংক থেকে আরেক ব্যাংকের ১ ডলার কিনতে লেগেছে ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা। কার্ব মার্কেট বা খোলাবাজারে ডলার বিক্রি হচ্ছে ১১৫ টাকায়।
দুই সপ্তাহের বেশি সময় আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে টাকা-ডলারের বিনিময় হার ১০৯ টাকায় ‘স্থির’ ছিল। বুধবার তা বেড়ে ১০৯ টাকা ৫০ পয়সায় উঠেছে।
ওদিকে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির দরও বাড়িয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মঙ্গলবার রিজার্ভ থেকে ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা দরে রাষ্ট্রায়ত্ত কয়েকটি ব্যাংকের কাছে ৬ কোটি ৮০ লাখ ডলার বিক্রি করা হয়েছে।
গত ১৫ জুন আনঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে টাকা-ডলারের বিনিময় হার ১০৯ টাকায় উঠেছিল। এরপর জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ১০৮ টাকা ৭০ পয়সা থেকে ১০৮ টাকা ৮০ পয়সায় লেনদেন হয়। এর পর মঙ্গলবার পর্যন্ত ১০৯ টাকায় ‘স্থির’ ছিল ডলারের দর।
এদিকে খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেটেও ডলারের দর ঊর্ধ্বমূখী। বুধবার এই বাজারে ১১৫ টাকায় প্রতি ডলার বিক্রি হয়েছে।
‘গত কিছু দিন ধরেই বাজার চড়া’ জানিয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ডলার ব্যবসায়ী এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “বাজারে চাহিদা বেশি, সরবরাহ কম। সে কারণেই দাম বাড়ছে। বুধবার আমরা ১১৪ টাকা ৮০ পয়সা থেকে ১১৫ টাকায় ডলার বিক্রি করেছি। কিনেছি ১১৪ টাকা ৪০ পয়সা থেকে ৫০ পয়সা দরে।”
গত বছরের মার্চে দেশে মার্কিন ডলারের যে সংকট শুরু হয়েছিল, তা এখনো কাটেনি। অনেক ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, পণ্য আমদানিতে তারা চাহিদামতো ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারছেন না। অনেক বিদেশি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে সেবা দিয়ে যে আয় ও মুনাফা করেছে, তা-ও নিজ দেশে নিতে পারছে না।
বাজারে চাহিদা বাড়লেও জোগান কমছে ডলারের। আর এতে আন্তঃব্যাংক লেনদেনে এই বিদেশি মুদ্রার দাপট অব্যাহত রয়েছে। নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণার পরও অস্থির ডলারের বাজারে স্বস্তি ফিরে আসছে না।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর গত বছরের মার্চ থেকে দেশে ডলার-সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। এ সংকট মোকাবিলায় শুরুতে ডলারের দাম বেঁধে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এতে সংকট আরও বেড়ে যায়।
পরে গত সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম নির্ধারণের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ায়। এ দায়িত্ব দেওয়া হয় ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের সঙ্গে জড়িত ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) ওপর। এর পর থেকে এই দুই সংগঠন মিলে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় এবং আমদানি দায় পরিশোধের ক্ষেত্রে ডলারের দাম নির্ধারণ করে আসছে।
মূলত বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত কার্যকর করছে এই দুই সংগঠন।
গত সোমবার এবিবি ও বাফেদার বৈঠকে রপ্তানি আয়ে ডলারের দর ১ টাকা বাড়ানো হয়েছে; রেমিটেন্স বাড়ানো হয়েছে ৫০ পয়সা। সে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, মঙ্গলবার থেকে রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে প্রতি ডলারের দর ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা। আর রেমিটেন্সের ক্ষেত ১০৯ টাকা।
আর আমদানি নিষ্পত্তিতেও ডলারের দাম ৫০ পয়সা বাড়িয়ে ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা করা হয়েছে।
পরের দিন বুুধবার রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির দর বাড়িয়ে ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
তবে, এবিবি ও বাফেদার সিদ্ধান্ত অনেক ক্ষেত্রেই মানেনি ব্যাংকগুলো। অনেক ব্যাংক এই দুই সংগঠনের বেঁধে দেওয়া দামের চেয়েও বেশি দামে রেমিটেন্স সংগ্রহ করেছে। এজন্য কয়েক দফায় কয়েকটি ব্যাংককে সতর্ক করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা অনেক দিন ধরেই অভিযোগ করে আসছেন, আমদানির ক্ষেত্রে বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে ডলারের দামে বেশি রাখছে ব্যাংকগুলো।
একটি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধান নাম না প্রকাশ করার শর্তে এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে যে পরিমাণ ডলার চাওয়া হয় তার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পাওয়া যায়। দেড় বছর ধরে এই সংকট চলছে দেশে।”
তবে,বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ডলার-সংকট যতটা প্রকট ছিল, তা অনেকটা কমে এসেছে। আমদানি ঋণপত্র খোলা কমে গেছে। তাতে ব্যাংকগুলোতে ডলারের মজুত কিছুটা বেড়েছে।
এর আগে গত মাসের বৈঠকে আন্তঃব্যাংক ডলারের দাম ১০৯ টাকার বেশি হওয়া যাবে না বলে একটি নতুন নিয়ম করা হয়েছিল। তার পর থেকে অবশ্য আন্তঃব্যাংক মুদ্রা বাজারে ডলারের দর ১০৯ টাকার উপরে উঠেছি।
এদিকে জুলাই থেকে রিজার্ভ থেকে আর কম দামে ডলার বিক্রি করছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারের দরেই ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সব ক্ষেত্রে ডলারের এক দর নির্ধারণের লক্ষেই এ সব করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে এবিবির চেয়ারম্যান ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “রপ্তানি উৎসাহিত করতে ডলারের বিনিময় হার বাড়ানো হয়েছে। রপ্তানিকারক ও প্রবাসীদের কাছ থেকে ডলারের ক্রয়মূল্যের ব্যবধান কমে এসেছে।'
'আমরা ধীরে ধীরে ডলারের অভিন্ন বিনিময় হারের দিকে যাচ্ছি।”
বর্তমানে আমদানি, রপ্তানি, রেমিটেন্স ও নগদ বিক্রিতে ডলারের দর ভিন্ন ভিন্ন। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের অন্যতম প্রধান শর্ত ছিল ডলারের একাধিক দর না রেখে একক দর করতে হবে।
আইএমএফের সেই শর্ত পূরণ করতে আমদানি, রপ্তানি, রেমিটেন্স ও নগদ কেনাবেচায় বিদেশি মুদ্রার একাধিক বিনিময় হারকে একটিতে নামিয়ে আনার প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ১৮ জুন মুদ্র্রানীতি ঘোষণার সময় এই ইঙ্গিত দিয়েছেন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।
দীর্ঘদিন ডলারের বিনিময় হার কৃত্রিমভাবে ধরে রাখার খেসারত এখন দিতে হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।
এআরএইচ ডটকমকে তিনি বলেন, “এত দিন টাকার মান ৪০ শতাংশ অতিমূল্যায়িত ছিল। ডলার-সংকট শুরু হওয়ার পর ৩০ শতাংশের মতো টাকার অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। আরও ১০ শতাংশ অবমূল্যায়ন করতে হবে।”
তিনি বলেন, “দেরিতে হলেও ডলারের দর বাজারভিত্তিক করার দিকে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এটা করলে একটা সমাধান হতে পারে। খোলাবাজারের সঙ্গে ব্যাংকের ডলারের দামের পার্থক্য সর্বোচ্চ ২ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। এ জন্য বৈধ পথে আয় বাড়াতে হবে। তাহলে সংকটও কমবে।”
“অন্যদিকে সংকটের এই সময়ে রপ্তানি আয় যাতে না কমে সেদিকেও বিশেষ নজর রাখতে হবে। বিশ্ব ব্যাংক-আইএমএফসহ অন্য দাতাদের কাছ থেকে কম সুদের ঋণ আনার দিকেও মনোযোগ দিতে হবে। এফডিআই (সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ) বাড়তে হবে।”
“আমাদের একটা বিষয় খুব ভালোভাবে মনে রাখতে হবে, বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক হচ্ছে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ। নানা ভুলের কারণে এই রিজার্ভ অনেক কমেছে; ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে ২৯ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে এসেছে।
“কিন্তু আর নয়, আর কমতে দেয়া যাবে না। যে করেই হোক আটকাতে হবে। তানাহলে কিন্তু আমরা বড় ধরনের বিপদে পড়বো,” বলেন দীর্ঘদিন আইএমএফে গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা আহসান মনসুর।
কমেন্ট