ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ বাজেটের অর্ধেক

ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ বাজেটের অর্ধেক

বিশাল অঙ্কের এই ঋণ আটকে থাকায় অর্থনীতিতে বড় ধরনের উদ্বেগের কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে মনে করছেন অর্থনীতির গবেষকরা। প্রতীকী ছবি

২০২২ সাল শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে মোট ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৯২২ কোটি টাকা। এই অঙ্ক চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের প্রায় অর্ধেক।

মোট খেলাপি ঋণ (এনপিএল), পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন করা ঋণ এবং অবলোপনকৃত মন্দ ঋণ (রাইট অফ) মিলিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এই ঋণের হিসাব দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। 

রোববার প্রকাশিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে (ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্ট) এই তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। 

আন্ত:র্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইমএফ) ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের বাকি কিস্তিগুলো পাওয়ার শর্ত পূরণের অংশ হিসেবে এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। 

বিশাল অঙ্কের এই ঋণ আটকে থাকায় অর্থনীতিতে বড় ধরনের উদ্বেগের কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে মনে করছেন অর্থনীতির গবেষকরা।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২২ সাল শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা। পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন করা মোট ঋণের অঙ্ক ২ লাখ ১২ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা। আর রাইট অফ করা ঋণের পরিমাণ ৪৪ হাজার ৪৯৩ কোটি টাকা। 

এই অঙ্ক যোগ করেই ঝুঁকিপূর্ণ মোট ঋণের হচ্ছে পৌণে চার লাখ কোটি টাকার বেশি। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে গত মার্চ পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। 

অর্থনীতির গবেষক বেসরকরি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের  (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “পৌণে চার লাখ কোটি টাকার বেশি এই ঝুঁকিপূর্ণ ঋণই প্রমাণ করে যে, আমাদের ব্যাংকিং খাতের অবস্থা কতোটা খারাপ অবস্থায় আছে। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে-অর্থ আমাদের জাতীয় বাজেটের অর্ধেক।”

“এই বিশাল অঙ্কের ঋণ আদৌ আদায় হবে কী না-তা নিয়ে যথেস্ট সংশ্রয় আছে। আর যদি সেটা্এি হয়, তাহলে এটা বলা যায় যে, আমাদের ব্যাংকিং খাত একটি ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে।"

চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের আকার ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা।

একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ মইনুল ইসলাম বলেন, “ব্যাংকিং খাতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় লুটপাটের অর্থনীতি চালু আছে দেশে। লুটপাটের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে খেলাপি ঋণ। আমার ‘বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে খেলাপি ঋণ’ শীর্ষক এক গবেষণায় আমি দেখিয়েছি, ৭৭ শতাংশ খেলাপি ঋণ রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার কারণে হয়েছে। ২০১০ সালে এ গবেষণা বই আকারে বেরিয়েছে।” 

৩০ বছর ধরে খেলাপি ঋণ নিয়ে গবেষণা করার অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে মইনুল ইসলাম বলেন, “আমি দেখেছি সরকারের একটা দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে খেলাপিদের লাই দেওয়া, সুবিধা দেওয়া। ২০১৯ সালে আ হ ম মুস্তফা কামাল অর্থমন্ত্রী হয়ে আসার পর থেকে এ প্রবণতা আরও বেড়েছে। একটার পর একটা আইনি সুবিধা দেওয়ার সর্বশেষ সংযোজন হচ্ছে কিছুদিন আগে ব্যাংক কোম্পানি আইনের পরিবর্তন করে তাদের আরও সুবিধা দেওয়া হয়েছে।” 

দেশের প্রায় দেড় কোটি মানুষ প্রবাসে আছেন উল্লেখ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক মইনুল ইসলাম আরও বলেন, “তারা ব্যাংকিং চ্যানেল বা হুন্ডির মাধ্যমে যে অর্থ পাঠান, তা ব্যাংকে আমানত হিসেবে জমা পড়ে। সুতরাং আমানতের ঘাটতির মধ্যে নেই দেশের ৬২টি ব্যাংক। তবে এ আমানত লুট হয়ে যাচ্ছে।” 

“ঋণখেলাপিরা কোনো বিপদের কারণে ঋণখেলাপি হননি। মামলাগুলোকে বছরের পর বছর ঝুলিয়ে রাখছেন তারা। তারা সুবিধা নিচ্ছেন এবং কোনো ধরনের নিয়ম মানছেন না। এমনকি খেলাপি ঋণের বেশির ভাগ মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, দুবাই ইত্যাদি দেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে।” 

দীর্ঘ আলোচনার পর গত ৩০ জানুয়ারি আইএমএফের নির্বাহী পর্ষদের বৈঠকে বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। ঋণ অনুমোদনের তিন দিনের মাথায় সংস্থাটি প্রথম কিস্তির অর্থ ছাড় করেে। 

২ ফেব্রুয়ারি এই ঋণের প্রথম কিস্তি ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার ডলার বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভে যোগ হয়। 

ঋণের বাকি অর্থ পাওয়া যাবে তিন বছরে অর্থাৎ ছয়টি সমান কিস্তিতে ৩৬ মাসে। দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়া যাবে এ বছরের ডিসেম্বরে আর শেষ কিস্তি পাওয়া যাবে ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে। এসব কিস্তির পরিমাণ ৭০ কোটি ৪০ লাখ ডলার করে।

এই ছয় কিস্তির অর্থ পাওয়ার জন্য আইএমএফের কথামতো অনেক শর্ত পূরণ করছে সরকার তথা বাংলাদেশ ব্যাংক। 

ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, তা সেই শর্ত পূরণের একটি অংশ।

রেকর্ড লেনদেন মোবাইলে: ৪ বছরে বেড়েছে ৪ গুণ পরবর্তী

রেকর্ড লেনদেন মোবাইলে: ৪ বছরে বেড়েছে ৪ গুণ

কমেন্ট