দুই বছরে টাকার মান কমেছে ২৯.১৩ শতাংশ
এর অর্থ হলো ২০২১ সালের ৫ আগস্ট আন্তর্জাতিক বাজার থেকে কোনো পণ্য বা সেবা আমদানি করতে যে ডলারের প্রয়োজন হতো, তার জন্য ১০০ টাকা লাগতো, বর্তমানে তা কিনতে ১২৯ টাকা ১৩ পয়সা খরচ করতে হচ্ছে।
২০২১ সালের ৫ আগস্ট আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে টাকা-ডলারের বিনিময় হার ছিল ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা। অর্থাৎ দুই বছর আগে এক ব্যাংক আরেক ব্যাংক থেকে ডলার কিনতে প্রতি ডলারের জন্য ৮৪ টাকা ৮০ খরচ করতে হতো। সোমবার লেগেছে ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা।
এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এই দুই বছরে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশের মুদ্রা টাকার মান কমেছে ২৯ দশমিক ১৩ শতাংশ।
এর অর্থ হলো ২০২১ সালের ৫ আগস্ট আন্তর্জাতিক বাজার থেকে কোনো পণ্য বা সেবা আমদানি করতে যে ডলারের প্রয়োজন হতো, তার জন্য ১০০ টাকা লাগতো, বর্তমানে তা কিনতে ১২৯ টাকা ১৩ পয়সা খরচ করতে হচ্ছে।
বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে অর্থনীতির সবচেয়ে স্পর্শকাতর সূচক মূল্যস্ফীতি যে প্রায় ১০ শতাংশে উঠেছে, তাতে ডলারের এই উল্লম্ফন অন্যতম প্রধান একটি কারণ বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় ‘স্থির’ ছিল ডলারের দর। ২০২১ সালের ৫ আগস্ট থেকে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বাড়তে শুরু করে।
আমদানি বাড়ায় ডলারের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় শক্তিশালী হতে থাকে ডলার; বিপরীতে দুর্বল হচ্ছে টাকা। এখনও তা অব্যাহত আছে।
মাঝে এক বছর ছাড়া (২০২১ সালের ৫ আগস্টের আগে এক বছর) প্রতি বছরই টাকার মান কমেছে। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য করে থাকে ডলারে। অনেকটা ‘রক্ষণশীল নীতি’ অবলম্বন করায় আওয়ামী লীগ সরকারের ১২ বছরে (২০০৯ সাল থেকে ২০২১ সাল) ডলারের বিপরীতে টাকার মাস কমেছিল ২৪ শতাংশের মতো। আর গত দুই বছরেই কমেছে ২৯ শতাংশের বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে এ বছরের ১৪ আগস্ট পর্যন্ত মুদ্রা বিনিময় হারের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে এ তথ্য মিলেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রতি ডলারের জন্য লাগত ৬৯ টাকা। ২০১৭ সালের শুরুর দিকে প্রতি ডলারের মূল্যমান ছিল ৭৯ টাকা ৭৫ পয়সা।
বাংলাদেশে ডলার ও টাকার বিনিময় হার স্বাধীনতার পর থেকে সরকার তথা বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারণ করে দিত। ২০০৩ সালে এই বিনিময় হারকে করা হয় ফ্লোটিং বা ভাসমান। এর পর থেকে আর ঘোষণা দিয়ে টাকার অবমূল্যায়ন বা পুনর্মূল্যায়ন করা হয় না।
তবে বিনিময় হার ভাসমান হলেও পুরোপুরি তা বাজারভিত্তিক থাকেনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সব সময়ই এতে পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ রেখে আসছে।
গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর গত বছরের মার্চ থেকে দেশে ডলার-সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। এ সংকট মোকাবিলায় শুরুতে ডলারের দাম বেঁধে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এতে সংকট আরও বেড়ে যায়।
পরে গত সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম নির্ধারণের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ায়। এ দায়িত্ব দেওয়া হয় এবিবি ও বাফেদার ওপর। এর পর থেকে এই দুই সংগঠন মিলে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় এবং আমদানি দায় পরিশোধের ক্ষেত্রে ডলারের দাম নির্ধারণ করে আসছে। মূলত বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত কার্যকর করছে এই দুই সংগঠন।
তবে, এবিবি ও বাফেদার এই সিদ্ধান্ত অনেক ক্ষেত্রেই মানেনি ব্যাংকগুলো। অনেক ব্যাংক এই দুই সংগঠনের বেঁধে দেওয়া দামের চেয়েও বেশি দামে রেমিটেন্স সংগ্রহ করেছে। এজন্য কয়েক দফায় কয়েকটি ব্যাংককে সতর্ক করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা অনেক দিন ধরেই অভিযোগ করে আসছেন, আমদানির ক্ষেত্রে বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে ডলারের দামে বেশি রাখছে ব্যাংকগুলো।
তবে,বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ডলার-সংকট যতটা প্রকট ছিল, তা অনেকটা কমে এসেছে। আমদানি ঋণপত্র খোলা কমে গেছে। তাতে ব্যাংকগুলোতে ডলারের মজুত কিছুটা বেড়েছে।
সবশেষ গত ৩১ জুলাই রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে প্রতি ডলারের দর ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা আর রেমিটেন্সের ক্ষেত্রে হবে ১০৯ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে এবিবি ও বাফেদা।
এদিকে জুলাই থেকে রিজার্ভ থেকে আর কম দামে ডলার বিক্রি করছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারের দরেই ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সব ক্ষেত্রে ডলারের এক দর নির্ধারণের লক্ষেই এ সব করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে এবিবির চেয়ারম্যান ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “রপ্তানি উৎসাহিত করতে ডলারের বিনিময় হার বাড়ানো হয়েছে। রপ্তানিকারক ও প্রবাসীদের কাছ থেকে ডলারের ক্রয়মূল্যের ব্যবধান কমে এসেছে।'
'আমরা ধীরে ধীরে ডলারের অভিন্ন বিনিময় হারের দিকে যাচ্ছি।”
টাকা-ডলারের বিনিময় হার
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বোচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রতি ডলারের বিনিময়ে পাওয়া যেত ৬৯ টাকা। এরপর পাঁচ বছরে ডলারের বিপরীতে টাকা সাড়ে ৮ টাকার মতো দর হারায়।
আওয়ামীলীগ সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর ২০১৪ সালের আগস্টে ডলারের আন্তঃব্যাংক মুদ্রা বিনিময় হার ছিল ৭৭ টাকা ৪০ পয়সা। ২০১৫ সালের আগস্টে এই দর বেড়ে হয় ৭৭ টাকা ৮০ পয়সা। ২০১৬ সালের আগস্টে ডলারের দর ছিল ৭৮ টাকা ৪০ পয়সা।
২০১৭ সালের আগস্টে ডলারের দর বেড়ে হয় ৮০ টাকা ৭০ পয়সা। ২০১৮ সালের আগস্টে ডলারের দর ৮৩ টাকা ৭৫ পয়সা হয়।
২০১৯ সালের ১২ জানুয়ারি ডলারের দর ছিল ৮৪ টাকা ৯০ পয়সা। তবে এর পরপরই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপে ডলারের দর আবার আগের অবস্থানে ফিরে আসে।
ওই বছরের ডিসেম্বর নাগাদ ডলারের দর একটু একটু করে বেড়ে আবার ৮৪ টাকা ৯০ পয়সায় উঠে আসে।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত ডলারের দর ছিল ৮৪ টাকা ৯৫ পয়সা। জুনে ওই দর ৮৪ টাকা ৮৫ পয়সায় নেমে আসে। এর পর থেকে ডলারের দর ২০২১ সালের ৪ আগস্ট পর্যন্ত ৮৪ দশমিক ৮০ পয়সায় ‘স্থির’ ছিল।
২০২২ সালে টাকার মান কমেছে ১৩.৩ শতাংশ
২০২২ সালে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতন হয়েছে ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ। রোববার প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্ট-২০২২ এ তথ্য জানানো হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছরের ২ জানুয়ারি ডলারের আন্তঃব্যাংক বিনিময় হার ছিল ৮৫ টাকা ৮০ পয়সা, যা ১ ডিসেম্বর দাঁড়ায় ১০৫ টাকা ৪০ পয়সায়।
মূলত করোনা মহামারির পরে বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে অস্থিরতা দেখা দেয়, যা গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর আরও খারাপ হয়।
ওই যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হয় এবং ডলারের বিপরীতে বেশিরভাগ দেশের মুদ্রার দরপতন হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছর চীনা ইউয়ান, ভারতীয় রুপি, জাপানি ইয়েন এবং ইন্দোনেশিয়ান রুপিসহ প্রধান আমদানি দেশগুলোর মুদ্রার উল্লেখযোগ্য দরপতন হয়েছে।
পাকিস্তানি রুপির ২২ শতাংশ দরপতন হয়েছে, যা সবচেয়ে বেশি। জাপানি ইয়েনের দরপতন হয়েছে ১৪ শতাংশ। ইউরোর দর ৬ শতাংশ এবং ইউকে পাউন্ড স্টার্লিংয়ের ১০ শতাংশ দরপতন হয়েছে।
তবে, ২০২২ সালে রাশিয়ান রুবল ও সিঙ্গাপুরি ডলারের দর বেড়েছে যথাক্রমে ২ শতাংশ ও ১ শতাংশ।
কমেন্ট