আমদানির আড়ালে পাচার কমলেও রপ্তানিতে বেড়েছে

আমদানির আড়ালে পাচার কমলেও রপ্তানিতে বেড়েছে

রপ্তানিকারকরা যাতে কোনো অবস্থাতেই রপ্তানির মাধ্যমে দেশ থেকে অর্থ পাচার করতে না পারে, সেজন্য ব্যাংকার্স সভায় ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের কড়া নির্কদেশ দিয়েছেন গভর্নর রউফ তালুকদার।

পণ্য আমদানির আড়ালে অর্থ পাচার কমলেও রপ্তানিতে বেড়েছে বলে মনে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। 

বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের (ব্যবস্থাপনা পরিচালক) সঙ্গে বৈঠক করেন। ব্যাংকার্স সভা নামে পরিচিত এই সভায় পণ্য রপ্তানির আড়ালে দেশ থেকে অর্থ পাচার বেড়ে যাওয়ায়  উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। 

রপ্তানিকারকরা যাতে কোনো অবস্থাতেই রপ্তানির মাধ্যমে দেশ থেকে অর্থ পাচার করতে না পারে, সেজন্য ব্যাংকার্স সভায় ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের কড়া নির্কদেশ দিয়েছেন গভর্নর রউফ তালুকদার। 

সভা শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক সাংবাদিকদের বলেন, “আমদানিতে অর্থ পাচার কমেছে। কিন্তু রপ্তানির মাধ্যমে ব্যাপকহারে বেড়েছে অর্থ পাচার। এতে রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন কেন্দ্রীয় ব্যাংক।” 

“এমন পরিস্থিতিতে রপ্তানির অর্থ পাচার নিয়ন্ত্রণে সভায় ব্যাংকগুলোকে কঠোর নির্দেশ দিয়েছে গভর্নর।”

 

তিনি বলেন, “ওভার ইনভয়েসিং নিয়ন্ত্রণে এলেও এখনো আন্ডার ইনভয়েসিং হচ্ছে। সে বিষয়টা গুরুত্বসহকারে পর্যবেক্ষণ এবং প্রতিরোধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ব্যাংকগুলোকে। পাশাপাশি বিপুল অংকের খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার জন্য ব্যাংকগুলোকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপে নিতে বলা হয় সভায়।” 

পণ্য আমদানিতে ‘ওভার ইনভয়েসিং’ মানেই হচ্ছে অতিরিক্ত অর্থ ব্যাংক চ্যানেলেই বিদেশে পাচার হচ্ছে। পণ্যের মূল্যের নামে পাঠানো অতিরিক্ত অর্থ পরবর্তীতে বিদেশেই আমদানিকারকের পক্ষে কেউ গ্রহণ করছে। এমন অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরেই অর্থনীতিবিদদের কাছ থেকে আসছে। 

আর ‘আন্ডার ইনভয়েসিং’ ব্যবহার করা হয় পণ্য রপ্তানিতে। পণ্য রপ্তানির সময়ে যে পরিমাণ অর্থ কম দেখানো হয়, তা বিদেশে রপ্তানিকারকের পক্ষে বুঝে নেওয়া হয়। এভাবেও অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা বিভিন্ন সময়ে আলোচিত হয়ে আসছে। 

আমদানি-রপ্তানিতে এমন ‘মিস ইনভয়েসিং’র মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর বড় অংকের অর্থ পাচারের তথ্য উঠে আসছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষণায়ও। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) এক তথ্যে দেখা যায়, ২০০৪ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে মিস ইনভয়েসিং বা অস্বচ্ছ লেনদেনের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৮০৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার। 

দেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি মিস ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে অর্থ পাচারের বিষয়টি বেশ আগে থেকে বলে আসছে। ডলারের সাম্প্রতিক সংকটের মধ্যে দেশ থেকে অর্থ পাচারের বিষয়টিও নতুন করে আলোচনায় আসছে। 

ব্যাংকার্স সভায় দেশের ব্যাংকিং খাতের প্রধান সমস্যা খেলাপি ঋণ নিয়েও গভর্নর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বলে জানান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র। 

মেজবাউল হক সাংবাদিকদের বলেন, “সভায় বিপুল অংকের খেলাপি ঋণের বিষয়টি নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় গভর্নর স্যার উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সেই সঙ্গে এটা কমিয়ে আনার জন্য ব্যাংকগুলোকে জরুরিভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপে নিতে বলেছেন।” 

বাংলাদেশ ব্যাংকের  সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ মাস শেষে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা; যা মোট ঋণের ৮ দশমিক ৮০ শতাংশ খেলাপি। 

গত ডিসেম্বরে এর পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি। 

মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, “সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণের একক সুদের সীমা উঠিয়ে দিয়েছে এবং সেটা সফলভাবে বাস্তবায়ন করেছে সব ব্যাংক। বৈশ্বিক সংকট এখনো বিদ্যমান থাকায় দেশের মূল্যস্ফীতিতে একটি চাপ রয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ডলার সংকট। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজার নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে।” 

এক প্রশ্নের উত্তরে মুখপাত্র বলেন, “যেসব ব্যাংক বাফেদা বিদেশি মুদ্রা লেনদেনকারী প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন)  নির্ধারিত রেটের বেশি দামে ডলার বিক্রি করছে তাদের অবজারভেশনের মধ্যে রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নিশ্চই অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” 

ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সেলিম আর এফ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, “এ মুহূর্তে বাংলাদেশ অনেকগুলো চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে। সেগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে এবং কীভাবে সেই চ্যালেঞ্জগুলো প্রতিরোধ করা যায় সেই নির্দেশনা দিয়েছেন গভর্নর।” 

“আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি কিছুটা কমে এলেও ফাইনান্সিয়াল অ্যাকাউন্টস ব্যালেন্স এখনো ঋণাত্মক। দ্রুত সময়ের মধ্যে সেটা কীভাবে কমিয়ে আনা যায় তার ব্যবস্থা নিতে বলেছেন তিনি। পাশাপাশি অতিরিক্ত দরে ডলার সংগ্রহ প্রতিরোধ, খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ ভূমিকা এবং ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে।”


  
ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে রয়েছে কি না, এ বিষয়ে জানতে চাইলে এবিবির চেয়ারম্যান বলেন, “তারল্য সংকট আছে। তবে কিছু কিছু ব্যাংকে এই সমস্যা। সব ব্যাংকের সংকট নেই। ব্যাংকগুলোকে সংকট নিরসণে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন গভর্নর।” 
  
রাষ্ট্রায়ত্ত ৪ ব্যাংক মিলে করবে ‘ডিজিটাল ব্যাংক’ 

রাষ্ট্রায়ত্ত চারটি ব্যাংক মিলে ডিজিটাল ব্যাংক গঠন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। 

ব্যাংকার্স সভায় উপস্থিত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “দেশের বেসরকারি খাতের ৯ ব্যাংকের পর এবার রাষ্ট্রায়ত্ত চারটি ব্যাংক মিলে ডিজিটাল ব্যাংক গঠন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সোনালী, অগ্রাণী, জনতা ও রূপালী- এই চারটি ব্যাংক মিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনলাইনে ডিজিটাল ব্যাংকের জন্য আবেদন করা হবে।” 

“ইতোমধ্যে পর্ষদ থেকে অনুমতি নেওয়া হয়েছে। এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েব পোর্টালে আবেদন করবো।” 
  
এর আগে দেশের বেসরকারি খাতের ৯টি ব্যাংক মিলে ডিজিটাল ব্যাংক করার উদ্যোগ নিয়েছে। একসঙ্গে ৯ ব্যাংক মিলে এ ধরনের উদ্যোগ দেশে এখন পর্যন্ত এটিই প্রথম। 

ডিজিটাল ব্যাংক করার জন্য একসঙ্গে জোট বা কনসোর্টিয়াম গঠন করেছে সেগুলো হচ্ছে- সিটি ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক (এমটিবি), ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড (ইবিএল), ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংক লিমিটেড (ডিবিবিএল), ট্রাস্ট ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, ন্যাশনাল ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক (এনসিসিবি), মার্কেন্টাইল ব্যাংক ও মিডল্যান্ড ব্যাংক। 

ডিজিটাল ব্যাংক গঠনে ৯ ব্যাংকের প্রতিটি প্রায় ১৪ কোটি টাকা করে মোট ১২৬ কোটি টাকা মূলধন জোগান দেবে।   

সম্প্রতি দেশে ডিজিটাল ব্যাংক প্রতিষ্ঠার অনুমতি প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ জন্য আগ্রহীদের কাছ থেকে আবেদনও আহ্বান করা হয়েছে। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের এ উদ্যোগের পর দেশের বিভিন্ন ব্যাংক, বিমা প্রতিষ্ঠান, মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি খাতের শিল্পপ্রতিষ্ঠান ডিজিটাল ব্যাংক করতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। 

এর আগে চলতি বছরের ২১ জুন ডিজিটাল ব্যাংক গঠনে আগ্রহী উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে আবেদন আহ্বান করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ১ আগস্ট পর্যন্ত আবেদন গ্রহণ করা হবে বলে জানানো হয়েছিল। 

তবে সেই আবেদনের সময় বাড়িয়ে ১৭ আগস্ট পর্যন্ত করা হয়।

সর্বজনীন পেনশন উদ্বোধন বৃহস্পতিবার, কত টাকা কিস্তিতে মাসে কত পাওয়া যাবে পূর্ববর্তী

সর্বজনীন পেনশন উদ্বোধন বৃহস্পতিবার, কত টাকা কিস্তিতে মাসে কত পাওয়া যাবে

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ২০ কোটি ডলার দিচ্ছে বিশ্ব ব্যাংক পরবর্তী

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ২০ কোটি ডলার দিচ্ছে বিশ্ব ব্যাংক

কমেন্ট