ডিজিটাল ব্যাংকের জন্য ৫২ আবেদন
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, "ডিজিটাল ব্যাংকের ওয়েব পোর্টাল খোলা হয়। নির্ধারিত সময়ে ৫২টি প্রতিষ্ঠান আবেদন করেছে। এটা আমাদের প্রত্যাশার চেয়েও বেশি।”
নতুন ধারার আলোচিত 'ডিজিটাল ব্যাংক' করতে আবেদন করেছে দেশি-বিদেশি ৫২টি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে আছে বাণিজ্যিক ব্যাংক, মোবাইল আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান (এমএফএস), রাইড শেয়ারিং, ফুড ডেলিভারি, তথ্য প্রযুক্তি সেবাদানকারী, ওষুধ কোম্পানির মতো দেশি ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান।
প্রতিষ্ঠানগুলো লাইসেন্স পেতে কেউ এককভাবে আবেদন করেছে, আবার যৌথ উদ্যোগও আছে।
রোববার এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক এআরএইচ ডটকমকে বলেন, "ডিজিটাল ব্যাংকের ওয়েব পোর্টাল খোলা হয়। নির্ধারিত সময়ে ৫২টি প্রতিষ্ঠান আবেদন করেছে। এটা আমাদের প্রত্যাশার চেয়েও বেশি।”
“এসব আবেদন যাচাই-বাছাই করা হবে। নীতিমালা অনুযায়ী শর্ত মেনে যারা আবেদন করেছে এবং যেগুলো যোগ্য হবে তাদের লাইসেন্সের জন্য এলওআই (লেটার অব ইন্টেন্ট) দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বোর্ড।"
গত ২১ জুন ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্সের জন্য আবেদন নেওয়া শুরু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
অনলাইন আবেদনের সময়সীমা ১ আগস্ট শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ব্যবসায়ী সংগঠন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে আবেদনের সময় ১৭ আগস্ট পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, গত বৃহস্পতিবার রাত ১২টা পর্যন্ত অনলাইনে আবেদন করার সুযোগ ছিল। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংকের খোলা ওয়েবপোর্টালে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আবেদন গ্রহণ প্রক্রিয়া বন্ধ হয়।
“দুই দিনের সাপ্তাহিক ছুটি শেষে আজ (রোববার) সার্ভারের লক খোলা হয়। দেখা যায়, যৌথ ও এককভাবে মোট ৫২টি আবেদন জমা পড়েছে।”
আগ্রহীদের মধ্যে সরকারি ও বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক, মোবাইল আর্থিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ছাড়াও আছে বেসরকারি মোবাইল ফোন অপারেটর, তথ্য প্রযুক্তি সেবাদানকারী উদ্যোগ, এমনকি ওষুধ কোম্পানি ও ঢেউশিট উৎপাদনকারী কোম্পানিও।
লাইসেন্সের জন্য যত আবেদন জমা পড়েছে, সেগুলোর মধ্যে বিদেশি দুই বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের ফিনটেক (প্রযুক্তিভিত্তিক লেনদেন) ব্যবসার দক্ষতা রয়েছে।
নগদ টাকার ব্যবহার কমিয়ে আনা ও লেনদেন আরও সহজ করতে সরকারের ‘ক্যাশলেস সোসাইটি’ গড়ার উদ্যোগে ডিজিটাল ব্যাংক চালু করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বেশ কয়েক বছরের প্রস্তুতি শেষে বাংলাদেশ ব্যাংক লাইসেন্সের জন্য আবেদন গ্রহণ শুরু করে গত জুন থেকে। শুরুতে আবেদন করার শেষ সময় ছিল গত ১ অগাস্ট। সে সময়ের মধ্যে কোনো আবেদন জমা না পড়ায় পরে তা বাড়িয়ে ১৭ অগাস্ট করা হয়।
সবার আগে ‘ডিজি টেন পিএলসি’ নামে নয় ব্যাংকের জোট ডিজিটাল ব্যাংকে বিনিয়োগের ঘোষণা দেয়। এই ১০টি ব্যাংক মিলিয়ে ১২৭ কোটি ৭৮ লাখ টাকা বিনিয়োগের কথা জানিয়েছে।
বেসরকারি সিটি ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক (এমটিবি), ব্যাংক ডাচ্-বাংলা, ইস্টার্ন ব্যাংক (ইবিএল), ট্রাস্ট ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, ন্যাশনাল ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক (এনসিসিবি), প্রাইম ব্যাংক ও মিডল্যান্ড ব্যাংক রয়েছে এই উদ্যোগে।
এছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত চার বাণিজ্যিক ব্যাংক সোনালী, রূপালী, অগ্রণী ও জনতা মিলে জোটবদ্ধভাবে ডিজিটাল ব্যাংক গঠনের আবেদন করেছে।
বেসরকারি ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক ইউসিবির মোবাইল আর্থিক সেবাদানকারী কোম্পানি উপায়ের নেতৃত্বে যে জোট আবেদন করেছে, তার নাম ঠিক করা হয়েছে ‘উপায় ডিজিটাল ব্যাংক পিএলসি’। এই জোটে আছে বেসরকারি ব্যাংক এনআরবিসি ও মেঘনাও।
আবেদনকারীদের মধ্যে আছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি আরামিট, যারা মূলত ঢেউশিট উৎপাদন করে।
আরও আছে ওষুধ খাতের তালিকাভুক্ত কোম্পানি নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালস ও তথ্য প্রযুক্তি সেবাদানকারী কোম্পানি জেনেক্স ইনফোসিস, মোবাইল ফোন অপারেটর বাংলালিংক।
‘সঞ্চয় ডিজিটাল ব্যাংক পিএলসি’ নামে ডিজিটাল ব্যাংক প্রতিষ্ঠার আবেদন করেছে বেসরকারি ঢাকা ব্যাংক। তাদের জোটেও বেশ কয়েকটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান আছে।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্র্যাক ব্যাংক তাদের সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান বিকাশ ডিজিটাল ব্যাংকের ৫১ শতাংশ শেয়ার পেতে বিনিয়োগ করার কথা জানিয়েছে।
রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠান পাঠাও ডিজিটাল ব্যাংক পেতে আবেদন করেছে। তাদের প্রস্তাবিত ব্যাংকের নাম ‘পাঠাও ডিজিটাল ব্যাংক।’
নগদ ডিজিটাল ব্যাংক চেয়ে আবেদন করেছে ডিজিটাল আর্থিক সেবাদানকারী কোম্পানি নগদও।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, ডিজিটাল ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন হবে ন্যূনতম ১২৫ কোটি টাকা, যেখানে প্রচলিত ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন হচ্ছে ৫০০ কোটি টাকা।
প্রচলিত ধারার ব্যাংক পেতে সর্বশেষ ২০১৯ সালে তিনটি ব্যাংকের অনুমোদন দেয় বর্তমান সরকার।
রাজনৈতিক বিবেচনায় গত তিন মেয়াদে এ সরকার ১৩টি ব্যাংকের অনুমোদন দিয়েছে। যার মধ্যে প্রথম মেয়াদে নয়টি, দ্বিতীয় মেয়াদে একটি এবং বর্তমান মেয়াদের শুরুতে তিনটি ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়।
এর বাইরে আরো একটি ব্যাংকের জন্য প্রাথমিক অনুমোদন আগ্রহপত্র বা লেটার অব ইনটেন্ট জমা দেওয়া হয়েছিল, একাধিকবার সময় বাড়িয়েও শর্ত পূরণ করতে না পারায় তা বাতিল করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সব মিলিয়ে দেশে তফসিলি ব্যাংকের সংখ্যা বর্তমানে ৬১টি।
কোনো শাখা উপশাখা বুথ থাকবে না
দেশে ডিজিটাল ব্যাংক স্থাপনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক যে নীতিমালা প্রকাশ করেছে তাতে বলা হয়েছে, এই ব্যাংকের কোনো শাখা, উপশাখা, এটিএম বুথ বা কোনো স্থাপনা থাকবে না। মুঠোফোন অথবা ডিজিটাল যন্ত্র ব্যবহার করেই গ্রাহকদের ব্যাংক সেবা দেওয়া হবে।
এটি গঠনে প্রয়োজন হবে ১২৫ কোটি টাকা, পরিচালক হতে লাগবে কমপক্ষে ৫০ লাখ টাকা।
নীতিমালায় বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে নিত্যনতুন প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে সমগ্র বিশ্বে অন্যান্য খাতের মতো আর্থিক খাতেও সেবা প্রদানের ধরনে বৈচিত্র্য এসেছে। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আর্থিক অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্যে বিভিন্ন বিকল্প ডেলিভারি চ্যানেল, তথা-মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (এমএফএস) এবং অন্যান্য ই-ওয়ালেটের মাধ্যমে ডিজিটাল পদ্ধতিতে আর্থিক সেবা প্রদানের জন্য ব্যাংক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানসমূহকে অনুমতি দিয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারের ঘোষিত লক্ষ্য ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’বিনির্মাণের উদ্দেশ্যে বিশ্বব্যাপী প্রচলিত তথ্য প্রযুক্তিনির্ভর ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবা জনগনের কাছে পৌঁছে দেয়ার মাধ্যমে ক্যাশলেস বাংলাদেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ডিজিটাল ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে ব্যাংক ব্যবস্থার আইনী কাঠামো, দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট, প্রযুক্তিনির্ভর ব্যাংক ব্যবস্থায় বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান ইত্যাদি বিষয়সমূহ বিশ্লেষণপূর্বক ‘ডিজিটাল ব্যাংক স্থাপন বিষয়ক গাইডলাইন্স’প্রণয়ন করা হয়েছে।
শুধু ছোট উদ্যোক্তারা ঋণ পাবেন
নীতিমালা অনুযায়ী, ডিজিটাল ব্যাংক পরিচালনার জন্য প্রধান কার্যালয় থাকবে। তবে সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে এটি হবে স্থাপনাবিহীন। অর্থাৎ এই ব্যাংক কোনো ওভার দ্য কাউন্টার (ওটিসি) সেবা দেবে না। এর নিজস্ব কোনো শাখা বা উপশাখা, এটিএম, সিডিএম অথবা সিআরএমও থাকবে না।
সব সেবাই হবে অ্যাপ–নির্ভর, মুঠোফোন বা ডিজিটাল যন্ত্রে। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই সেবা মিলবে। গ্রাহকদের লেনদেনের সুবিধার্থে ডিজিটাল ব্যাংক ভার্চুয়াল কার্ড, কিউআর কোড ও অন্য কোনো উন্নত প্রযুক্তিভিত্তিক পণ্য দিতে পারবে।
লেনদেনের জন্য কোনো প্লাস্টিক কার্ড দিতে পারবে না। অবশ্য এই ব্যাংকের সেবা নিতে গ্রাহকেরা অন্য ব্যাংকের এটিএম ও এজেন্টসহ নানা সেবা ব্যবহার করতে পারবেন।
ডিজিটাল ব্যাংক কোনো ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারবে না। বড় এবং মাঝারি শিল্পেও কোনো ঋণ দেওয়া যাবে না। শুধু ছোট ঋণ দিতে পারবে।
৫ বছরের মধ্যে পুঁজিবাজারে আসতে হবে
একেকটি ডিজিটাল ব্যাংক স্থাপনের জন্য ন্যূনতম মূলধন লাগবে ১২৫ কোটি টাকা। প্রচলিত ধারার ব্যাংক করতে প্রয়োজন হয় ৫০০ কোটি টাকা। ডিজিটাল ব্যাংকের প্রত্যেক উদ্যোক্তাকে কমপক্ষে ৫০ লাখ টাকা মূলধন দিতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক লাইসেন্স দেওয়ার পাঁচ বছরের মধ্যে এই ব্যাংককে দেশের পুঁজিবাজারে প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) ছাড়তে হবে।
এই ব্যাংক স্থাপনে উদ্যোক্তাদের অর্ধেককে হতে হবে প্রযুক্তিভিত্তিক ব্যাংকিং, উদীয়মান প্রযুক্তি, সাইবার আইন ও বিধিবিধান বিষয়ে শিক্ষা, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা সম্পন্ন। বাকি অর্ধেককে হতে হবে ব্যাংকিং, ই-কমার্স এবং ব্যাংকিং আইন ও বিধিবিধান বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন।
ডিজিটাল ব্যাংককে কোম্পানি আইন অনুযায়ী প্রচলিত ব্যাংকের মতো সময়ে সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারিত ন্যূনতম নগদ জমা (সিআরআর) ও বিধিবদ্ধ জমা (এসএলআর) বজায় রাখতে হবে।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ১ জুন জাতীয় সংসদে ২০২৩–২৪ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় ডিজিটাল ব্যাংকিং চালুর ঘোষণা দেন। নতুন অর্থবছরেই এটি চালুর কথা বলেন তিনি।
কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণখেলাপি ব্যক্তি বা তার পরিবারের কোনো সদস্য প্রস্তাবিত ডিজিটাল ব্যাংকের উদ্যোক্তা হতে পারবেন না। এক পরিবার থেকে সর্বোচ্চ কতজন পরিচালক হতে পারবেন, তা ঠিক করা হবে ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী।
ডিজিটাল ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) ব্যাংকিং পেশায় কমপক্ষে ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে—যার মধ্যে প্রযুক্তিভিত্তিক ব্যাংকিং, রেগুলেশন, গাইডলাইন, সার্কুলার ইত্যাদি ক্ষেত্রে কমপক্ষে পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
কমেন্ট