কার্যকর হলো ডলার কেনায় ‘একক দর’
রপ্তানি ও রেমিটেন্সে ডলার কেনায় একদর কার্যকর করল ব্যাংকগুলো। এখন থেকে রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্সে ডলারের দর হবে একই; ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা।
ডলারের দাম নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা এখনও শেষ হয়নি। বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন ও রিজার্ভের প্রধান দুই উৎস রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্সে ডলারের দর আরও বাড়ানো হয়েছে।
রপ্তানি ও রেমিটেন্সে ডলার কেনায় একদর কার্যকর করল ব্যাংকগুলো। এখন থেকে রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্সে ডলারের দর হবে একই; ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা। এত দিন রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রতি ডলারের দর ছিল ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা। আর রেমিটেন্সের জন্য ছিল ১০৯ টাকা।
এছাড়া আমদানি ও আন্তঃব্যাংকে ডলারের সর্বোচ্চ দর হবে ১১০ টাকা। এতদিন যা ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা ছিল।
এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, রপ্তানি আয়ে ডলারের দর বেড়েছে ১ টাকা; রেমিটেন্সে বেড়েছে ৫০ পয়সা।
বৃহস্পতিবার ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের সঙ্গে জড়িত ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) এক সভায় ডলারের দাম আরেক দফা বাড়ানোর এই সিদ্ধান্ত হয়।
নতুন এ সিদ্ধান্ত ১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার থেকে কার্যকর হবে।
গত এক মাস রেমিটেন্সে প্রতি ডলারের জন্য ১০৯ টাকা দিচ্ছিল ব্যাংকগুলো। আর রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে দিচ্ছিল ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা।
গত ৩১ জুলাই ওই দর নির্ধারণ করে দিয়েছিল বাফেদা ও এবিবি। বৃহস্পতিবার দুই ক্ষেত্রেই ডলারের দর বাড়িয়ে নতুন দর নির্ধারণ করে দিয়েছে বাফেদা ও এবিবি।
ব্যাংকাররা জানান, অনেক দিন ধরে রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের ডলার রেট এক করার চেষ্টা চলছিল। এখন থেকে এটা কার্যকর হবে। শুক্রবার থেকে প্রবাসী আয় ও রপ্তানি বিল নগদায়নে ডলার রেটে কোনো পার্থক্য থাকবে না। প্রতি ডলারের রেট হবে ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা।
গত কয়েক দিন ধরে ডলারের বাজার ফের অস্থির হয়ে হয়ে উঠেছে। আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে টাকা-ডলারের বিনিময় হার ১০৯ টাকা হলেও খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেটে ১১৭/১১৮ টাকা দরে ডলার বিক্রি হচ্ছে।
বাড়তি চাহিদার সুযোগ নিয়ে ডলারের দর বাড়িয়েছে মানিচেঞ্জার প্রতিষ্ঠানগুলো। আর এ অবস্থায় বিশেষ পরিদর্শনে গিয়ে বুধবার ৭টি মানিচেঞ্জার প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স স্থগিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া আরও ১০ প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে।
ব্যাংকগুলো নগদ ডলারও বিক্রি করছে বেশি দামে। বৃহস্পতিবার বেসরকারি সিটি ব্যাংক ১১১ টাকা ৫০ পয়সায় নগদ ডলার বিক্রি করেছে। ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড (ইবিএল) বিক্রি করেছে ১১১ টাকায়।
রাজধানীর মতিঝিলে সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় সভাপতিত্ব করেন বাফেদার চেয়ারম্যান এবং রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও আফজাল করিম।
এবিবির চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেনসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা সভায় উপস্থিত ছিলেন।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর গত বছরের মার্চ থেকে দেশে ডলার-সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। এ সংকট মোকাবিলায় শুরুতে ডলারের দাম বেঁধে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এতে সংকট আরও বেড়ে যায়।
পরে গত বছরের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম নির্ধারণের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ায়। এ দায়িত্ব দেওয়া হয় এবিবি ও বাফেদার ওপর। এর পর থেকে এই দুই সংগঠন মিলে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় এবং আমদানি দায় পরিশোধের ক্ষেত্রে ডলারের দাম নির্ধারণ করে আসছে। মূলত বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত কার্যকর করছে এই দুই সংগঠন।
তবে, এবিবি ও বাফেদার এই সিদ্ধান্ত অনেক ক্ষেত্রেই মানেনি ব্যাংকগুলো। অনেক ব্যাংক এই দুই সংগঠনের বেঁধে দেওয়া দামের চেয়েও বেশি দামে রেমিটেন্স সংগ্রহ করেছে। এজন্য কয়েক দফায় কয়েকটি ব্যাংককে সতর্ক করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা অনেক দিন ধরেই অভিযোগ করে আসছেন, আমদানির ক্ষেত্রে বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে ডলারের দামে বেশি রাখছে ব্যাংকগুলো।
তবে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ডলার-সংকট যতটা প্রকট ছিল, তা অনেকটা কমে এসেছে। আমদানি ঋণপত্র খোলা কমে গেছে। তাতে ব্যাংকগুলোতে ডলারের মজুত কিছুটা বেড়েছে।
এদিকে গত জুলাই থেকে রিজার্ভ থেকে আর কম দামে ডলার বিক্রি করছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারের দরেই ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সব ক্ষেত্রে ডলারের এক দর নির্ধারণের লক্ষেই এ সব করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে বাফেদার চেয়ারম্যান এবং সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল করিম এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “এখন থেকে সব ধরনের ডলার কেনার সর্বোচ্চ দর হবে ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা। আর বিক্রির সর্বোচ্চ দর হবে ১১০ টাকা।”
সব ব্যাংক এ সিদ্ধান্ত মেনে চলবে বলে তিনি আশা করেন।
“যদি রেকানো ব্যাংক এই রেট না মানে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের মৌখিক নির্দেশনার আলোকে বাফেদা ও এবিবি গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর থেকে ডলার কেনা ও বিক্রির একটি সর্বোচ্চ দর ঠিক করে দিচ্ছে। শুরুতে রপ্তানি বিল নগদায়নে প্রতি ডলার ৯৯ টাকা এবং রেমিট্যান্সে ১০৮ টাকা দর ঠিক করা হয়। ডলার কেনার গড় দরের সঙ্গে সর্বোচ্চ এক টাকা যোগ করে আমদানি ও আন্তঃব্যাংকে ডলার বিক্রির সিদ্ধান্ত হয়।
তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি (৪.৭ বিলিয়ন) ডলার ঋণের শর্তের কারণে এখন ডলারের সিঙ্গেল রেট তথা একক দর কার্যকর করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ব্যাংকগুলোর কাছে এখন ১১০ টাকা দরে ডলার বিক্রি করবে।
ডলার সঙ্কট মেটাতে আমদানি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়ে আসছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপরও চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) রিজার্ভ থেকে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিক্রি করা হয়েছে।
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে বিক্রি করা হয় ১৩ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার। আর ২০২১–২২ অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে বিক্রি করা ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার।
এভাবে ডলার বিক্রির ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছেই। বৃহস্পতিবার দিন শেষে বাংলাদেশের ‘গ্রস’ রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৯ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার। আর বিপিএম৬ পদ্ধতির হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২৩ দশমিক ০৬ বিলিয়ন ডলার।
২০২১ সালের আগস্টে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ‘গ্রস’ রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছিল। তখন বিপিএম৬ পদ্ধতিতে রিজার্ভের হিসাব করত না বাংলাদেশ ব্যাংক।
কমেন্ট