আন্তঃব্যাংক লেনদেনে ডলারের দর ১১০ টাকা
গত ১৫ জুন আন্তঃব্যাংক লেনদেনে টাকা-ডলারের বিনিময় হার ১০৯ টাকায় উঠে। এরপর কিছু দিন ১০৮ টাকা ৭০ পয়সা থেকে ১০৯ টাকার মধ্যে লেনদেন হয়। বেশ কিছু দিন টাকা-ডলারের বিনিময় হার ১০৯ টাকা ৫০ পয়সায় স্থির ছিল। মঙ্গলবার আরও ৫০ পয়সা বাড়িয়ে ১১০ টাকা করা হয়েছে।
অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে বাংলাদেশে আন্তঃব্যাংক লেনদেনে ডলারের দর ১১০ টাকায় উঠেছে।
বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনে আন্তঃব্যাংকের যে দর বাংলাদেশ ব্যাংক মঙ্গলবার প্রকাশ করেছে, তাতে ডলারের এই দর দেখা যায়।
গত ১৫ জুন আন্তঃব্যাংক লেনদেনে টাকা-ডলারের বিনিময় হার ১০৯ টাকায় উঠে। এরপর কিছু দিন ১০৮ টাকা ৭০ পয়সা থেকে ১০৯ টাকার মধ্যে লেনদেন হয়। বেশ কিছু দিন টাকা-ডলারের বিনিময় হার ১০৯ টাকা ৫০ পয়সায় স্থির ছিল। মঙ্গলবার আরও ৫০ পয়সা বাড়িয়ে ১১০ টাকা করা হয়েছে।
এদিকে খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেটেও ডলারের দর ঊর্ধ্বমূখী। মঙ্গলবার এই বাজারে ১১৭ টাকা ৫০ পয়সা দরে ডলার বিক্রি হয়েছে। গত তিন সপ্তাহ ধরে ১১৭ টাকা থেকে ১১৮ টাকায় ডলার কেনাবেচা হচ্ছে।
গত বছরের মার্চে দেশে মার্কিন ডলারের যে সংকট শুরু হয়েছিল, তা এখনো কাটেনি। অনেক ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, পণ্য আমদানিতে তারা চাহিদামতো ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারছেন না। অনেক বিদেশি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে সেবা দিয়ে যে আয় ও মুনাফা করেছে, তা-ও নিজ দেশে নিতে পারছে না।
বাজারে চাহিদা বাড়লেও জোগান কমছে ডলারের। আর এতে আন্তঃব্যাংক লেনদেনে এই বিদেশি মুদ্রার দাপট অব্যাহত রয়েছে। নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণার পরও অস্থির ডলারের বাজারে স্বস্তি ফিরে আসছে না।
এক বছর আগে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের বিনিময় হার বাজারের উপর ছেড়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
এর আগে গত ১৬ মে আন্তঃব্যাংকে ডলারের দর উঠেছিল ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা। এরপর সামান্য কিছু বেড়ে ১০৮ টাকা ৭০ পয়সা পর্যন্ত উঠে ফের ১০৮ টাকা ৫০ পয়সায় নেমে অবস্থান করছিল মে মাসের শেষের দিকে।
জুন মাসে দুই সপ্তাহ ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১০৮ টাকা ৮০ পয়সার মধ্যে লেনদেন হয়। ১৫ জুন ১০৯ টাকায় উঠেছিল।
এক বছর আগে গত বছরের ৩০ আগস্ট এই দর ছিল ৯৫ টাকা। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এই এক বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে ১৫ দশমিক ৭৯ শতাংশ।
ডলারের এ দরের সঙ্গে ব্যাংক গ্রাহকের কাছ থেকে কমিশন আকারে ১০ থেকে ৫০ পয়সা পর্যন্ত যোগ করে। ফলে গ্রাহক পর্যায়ে ডলারের দর আরও বাড়ে।
বেসরকারি সিটি ব্যাংক মঙ্গলবার ১১১ টাকা ৫০ পয়সা দরে নগদ ডলার বিক্রি করছে বলে তাদের ওয়েবসাইটে জানিয়েছে। ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডও (ইবিএল) ১১১ টাকা ৫০ পয়সায় নগদ ডলার বিক্রি করেছে।
প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয় দেশের ডলার উপার্জনের মূল ক্ষেত্র।
চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় মাস আগস্টে ১৬০ কোটি (১.৬ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স দেশে এসেছে। এই অঙ্ক গত ছয় মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই আগেস্ট গত বছরের আগস্টের চেয়ে ২১ দশমিক ৪৭ শতাংশ কম রেমিটেন্স এসেছে। আর আগের মাস জুলাইয়ের চেয়ে কম এসেছে ১৯ শতাংশ।
গত ফেব্রুয়ারিতে ১৫৬ কোটি (১.৫৬ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।
অবশ্য রপ্তানি আয়ে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। আগস্ট মাসে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে সব মিলিয়ে ৪৭৮ কোটি ২২ লাখ (৪.৭৮ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছেন বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা। এই অঙ্ক গত বছরের আগস্টের চেয়ে ৩ দশমিক ৮০ শতাংশ বেশি।
অন্যদিকে আমদানি খরচও বেশ কমে এসেছে। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমদানি ব্যয় কমেছিল প্রায় ১৬ শতাংশ। আর ঋণপত্র বা এলসি খোলার সবশেষ যে তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে এলসি কমেছে ৩১ দশমিক ২০ শতাংশ।
বৈদেশিক মুদ্রা আয়-ব্যয়ের এ খরচে ঘাটতি দেখা দেওয়ায় সর্বশেষ গত ৩১ আগস্ট রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয়ের বিপরীতে ডলারের দর ফের বাড়ায় বিদেশি মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাংলাদেশে ফরেইন এক্সচেঞ্জ ডিলার অ্যাসোসিয়েশন-বাফেদা ও ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ-এবিবি।
১ সেপ্টেম্বর থেকে রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্সে ডলারের দর হবে একই; ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা। এত দিন রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রতি ডলারের দর ছিল ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা। আর রেমিটেন্সের জন্য ছিল ১০৯ টাকা।
এছাড়া আমদানি ও আন্তঃব্যাংকে ডলারের সর্বোচ্চ দর হবে ১১০ টাকা। এতদিন যা ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা ছিল।
এতদিন আমদানি, রপ্তানি, রেমিটেন্স ও নগদ বিক্রিতে ডলারের দর ভিন্ন ভিন্ন। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের অন্যতম প্রধান শর্ত ছিল বৈদেশিক মুদ্রার একাধিক দর না রেখে একক দর করতে হবে।
আইএমএফের সেই শর্ত মেনেই আমদানি, রপ্তানি, রেমিটেন্স ও নগদ কেনাবেচায় বিদেশি মুদ্রার একাধিক বিনিময় হারকে একটিতে নামিয়ে আনার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে মঙ্গলবার টাকা-ডলার বিনিময় হার আরও ৫০ পয়সা বাড়িয়ে ১১০ টাকা করা হয়েছে।
দীর্ঘদিন ডলারের বিনিময় হার কৃত্রিমভাবে ধরে রাখার খেসারত এখন দিতে হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।
এআরএইচ ডটকমকে তিনি বলেন, “এত দিন টাকার মান ৪০ শতাংশ অতিমূল্যায়িত ছিল। ডলার-সংকট শুরু হওয়ার পর ৩০ শতাংশের মতো টাকার অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। আরও ১০ শতাংশ অবমূল্যায়ন করতে হবে।”
তিনি বলেন, “দেরিতে হলেও ডলারের দর বাজারভিত্তিক করার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এটা করলে একটা সমাধান হতে পারে। খোলাবাজারের সঙ্গে ব্যাংকের ডলারের দামের পার্থক্য সর্বোচ্চ ২ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। এ জন্য বৈধ পথে আয় বাড়াতে হবে। তাহলে সংকটও কমবে।”
“অন্যদিকে সংকটের এই সময়ে রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্স যাতে না কমে সেদিকেও বিশেষ নজর রাখতে হবে। বিশ্ব ব্যাংক-আইএমএফসহ অন্য দাতাদের কাছ থেকে কম সুদের ঋণ আনার দিকেও মনোযোগ দিতে হবে। এফডিআই (সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ) বাড়তে হবে।”
“আমাদের একটা বিষয় খুব ভালোভাবে মনে রাখতে হবে, বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক হচ্ছে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ। নানা ভুলের কারণে এই রিজার্ভ অনেক কমেছে; ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে ২৮ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে এসেছে।
“কিন্তু আর নয়, আর কমতে দেয়া যাবে না। যে করেই হোক আটকাতে হবে। তানাহলে কিন্তু আমরা বড় ধরনের বিপদে পড়বো,” বলেন দীর্ঘদিন আইএমএফে গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা আহসান মনসুর।
কমেন্ট