২১ মাস পর এক অঙ্কের ঘরে নেমে এল বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি

২১ মাস পর এক অঙ্কের ঘরে নেমে এল বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি

চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ৮২ শতাংশ। আগের মাস জুনে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ দশমিক ৫৭ শতাংশ।

দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধিতে হতাশাজনক চিত্র নিয়ে শুরু  হলো ২০২২-২৩ অর্থবছর। ২১ মাস পর অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচকের প্রবৃদ্ধি এক অঙ্কের (সিঙ্গেল ডিজিট) ঘরে নেমে এসেছে। 

বাংলাদেশ ব্যাংক বৃহস্পতিবার বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধির হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ৮২ শতাংশ। 

আগের মাস জুনে এই প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ৫৭ শতাংশ। অর্থাৎ বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহে ১০ দশমিক ৫৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে গত ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষ হয়েছিল। 

এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এক মাসের ব্যবধানে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি কমেছে দশমিক ৭৫ শতাংশীয় পয়েন্ট।  

২০২২-২৩ অর্থবছরের শেষার্ধের (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরেছিল ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ।  

লক্ষ্যের অনেক পেছনে থাকায় গত ১৮ জুনে বাংলাদেশ ব্যাংক ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে, তাতে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরেছে ১১ দশমিক ১০ শতাংশ।  

গত কয়েক মাস ধরে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি কমছেই। দুই বছরের করোনা মহামারির ধকল কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিল বাংলাদেশের অর্থনীতি। বেশ ভালোই বাড়ছিল বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি।  

গত বছরের আগস্টে ১৪ শতাংশ ছাড়িয়ে এই প্রবৃদ্ধি ১৪ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশে উঠেছিল। এরপর থেকে কমছেই। সর্বশেষ জুলাই মাসে ৯ দশমিক ৮২ শতাংশে নেমে এসেছে। 

মে মাসে এই প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১১  দশমিক ১০ শতাংশ।  

তার আগের মাস এপ্রিলে ছিল ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ। মার্চে ছিল ১২ দশমিক শূন্য তিন শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ দশমিক ১৪ শতাংশ।  

জানুয়ারিতে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১২ দশমিক ৬২ শতাংশ। ডিসেম্বরে ছিল ১২ দশমিক ৮৯ শতাংশ। নভেম্বরে ছিল ১৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ। অক্টোবর, সেপ্টেম্বর ও আগস্টে ছিল যথাক্রমে ১৩ দশমিক ৯১ শতাংশ, ১৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ ও ১৪ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ।

 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, ২০২১ সালের শেষ মাস ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ৬৮ শতাংশ। তার আগের মাস নভেম্বরে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ১১ শতাংশ; অক্টোবরে ৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ আর সেপ্টেম্বরে হয়েছিল ৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ। আগস্ট ও জুলাইয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল যথাক্রমে ৮ দশমিক ৪২ শতাংশ ও ৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ। 

করোনা মহামারির ধাক্কায় কমতে কমতে ওই বছরের মে মাসে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি একেবারে তলানিতে, ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশে নেমে এসেছিল। এরপর থেকে তা ধারাবাহিকভাবে বেড়ে নভেম্বরে দুই অঙ্কের ঘরে পৌঁছায়। 

২১ মাস পার জুলাইয়ে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি আবার এক অঙ্কের ঘরে, ৯ দশমিক ৮২ শতাংশে নেমে এসেছে। 

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “কয়েক মাস ধরেই বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমছে। অথচ করোনার মধ্যেও এই ঋণ প্রবৃদ্ধি বাড়ছিল। করোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকার যে প্রণোদনা ঘোষণা করেছিল, তাতে এর অবদান ছিল। এ ছাড়া করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় দেশে বিনিয়োগের একটি অনুকূল পরিবেশও দেখা দিয়েছিল।”  

তিনি বলেন, “পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু কর্ণফুলী টানেলসহ কয়েকটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলকে ঘিরে উদ্যোক্তারা নতুন পরিকল্পনা সাজিয়ে বিনিয়োগে নেমেছিলেন। ব্যাংকগুলোও তাতে বিনিয়োগ করছিল। সব মিলিয়ে বেসরকারি খাতের ঋণের একটি গতি এসেছিল।”  

“কিন্তু দেড় বছরের বেশি সময় ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিয়েছে। ডলারের অস্বাভাবিক দর বাড়ার কারণে আমদানিকারকদের এলসি খুলতে বেশি টাকা লাগছে। তাতে ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেছে।”  

আহসান মনসুর বলেন, “বিশ্ববাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম এবং ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধিতে বেসরকারি খাতের ঋণের বড় অংশ চলে যাচ্ছে আমদানি খাতে। অর্থাৎ বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধির মূল কারণ অর্থনীতির বহিঃস্থ খাতের অস্থিরতা। 

“ফলে আগামী দিনে উৎপাদন এবং কর্মসংস্থানে বড় নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে সরকার নতুন অর্থবছরেও ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের যে লক্ষ্য ধরেছে সেটা অর্জন কোনোভাবেই সম্ভব নয়।”  

তবে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঠিক কাজটিই করছে মন্তব্য করে দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে (আইএমএফ) গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা এই অর্থনীতিবিদ বলেন, “আমদানি ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরাটা খুবই দরকার ছিল। সেটা সুফল হওয়া গেছে বলে আমি মনে করি। এই কৃচ্ছ্রসাধন আরও কিছুদিন চালাতে হবে।

 

“বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) প্রবৃদ্ধির দিকে না তাকিয়ে এখন মূল্যস্ফীতি সহনীয় রাখার দিকেই সবচেয়ে বেশি নজর দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে আগামী কয়েক মাস যদি বেসরকারি খাত ঋণ কমও পায়, তাতেও খুব একটা সমস্যা হবে না।”  

“এখন আমাদের সংকট বা চাপ থেকে বের হয়ে আসার সময়। এ অবস্থায় যদি জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশও হয়, তাও আমি যথেষ্ট বলে মনে করি। কিন্তু মূল্যস্ফীতি যাতে কোনো অবস্থাতেই দুই অঙ্কের ঘর (ডাবল ডিজিট) অতিক্রম না করে, সেটার দিকে সজাগ থাকতে হবে,” বলেন মনসুর।  

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ। গত ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষ হয় ৯ দশমিক শূন্য দুই শতাংশ গড় মূল্যস্ফীতি নিয়ে।  

১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে আটকে রাখার লক্ষ্য ধরেছে সরকার। বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে যো কোনোভাবেই সম্ভব নয় বলে, আহসান মনসুরসহ দেশের অন্য অর্থনীতিবিদরা বলে আসছেন।  

২০২১ সালের আগস্ট থেকে দেশে আমদানি ব্যয় বাড়তে থাকে। বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়ে যায়। টাকার বিপরীতে ডলারের দর অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকে। ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমদানি ব্যয় কমিয়ে আনতে একটার পর একটা পদক্ষেপ নিতে শুরু করে। যার সুফল জুন থেকে পড়া শুরু করে। এখনো পাওয়া যাচ্ছে।  

বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্য বলছে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে বিভিন্ন পণ্য আমদানির জন্য ৪৩৭ কোটি ২৪ লাখ (৪.৩৭ বিলিয়ন) ডলারের ঋণপত্র বা এলসি খুলেছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা উদ্যোক্তারা।  

এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩১ দশমিক ১৯ শতাংশ কম। ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই মাসে ৬৩৫ কোটি ৪০ লাখ (৬.৩৫ বিলিয়ন) ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল।  

ডলার সংকটের কারণে বিলাসবহুল ও অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির লাগাম টেনে ধরতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা পদক্ষেপে গত অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় এলসি খোলায় নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি নিয়ে নতুন অর্থবছর শুরু হলো।  

গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের পুরো সময়ে (২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৩  সালের জুন) বিভিন্ন পণ্য আমদানির জন্য সব মিলিয়ে সাত হাজার ২১৯ কোটি ৮০ লাখ (৭২.২০ বিলিয়ন) ডলারের এলসি খুলেছিলেন ব্যবসায়ীরা উদ্যোক্তারা।  

যা ছিল আগের অর্থবছরের (২০২১-২২) চেয়ে প্রায় ২৬ শতাংশ কম।

 

বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতেই আমদানিকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছিল। তার সুফলও মিলছে। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, জুলাই মাসে খাদ্য (চাল ও গম) আমদানির এলসি কমেছে ২১ দশমিক শূন্য এক শতাংশ; নিস্পত্তি কমেছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ।  

নতুন শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় ক্যাপিটাল মেশিনারি (মূলধনি যন্ত্রপাতি) আমদানির এলসি কমেছে সবচেয়ে ২২ দশমিক ১৭ শতাংশ; নিস্পত্তি কমেছে ১ দশমিক ৮৭ শতাংশ। 

শিল্পের মধ্যবর্তী পণ্য (ইন্টারমেডিয়েট গুডস) আমদানির এলসি কমেছে ৩০ দশমিক ৬৫ শতাংশ; নিস্পত্তি কমেছে ১৭ শতাংশ।  

জ্বালানি তেলের এলসি কমেছে ৫০ দশমিক ১২ শতাংশ; নিস্পত্তি বেড়েছে ৩৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ।  

শিল্পের কাঁচামাল আমদানির এলসি কমেছে ৩৬ দশমিক ১২ শতাংশ; নিস্পত্তি কমেছে ২৪ দশমিক ৩১ শতাংশ।  

এছাড়া নতুন অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে অন্যান্য পণ্য আমদানির এলসি কমেছে ১৮ দশমিক ৬২ শতাংশ; নিস্পত্তি কমেছে ১১ দশমিক ২১ শতাংশ। 

২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্য আমদানিতে মোট ৬৯ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে বাংলাদেশ। যা ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ কম। 

অন্যদিকে গত এক বছরে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে প্রায় ১৬ শতাংশ। বৃহস্পতিবার আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলারের জন্য ১১০ টাকা খরচ করতে হয়েছে। ২০২২ সালের ৩০ আগস্ট লেগেছিল ৯৫ টাকা।   

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, টানা বাড়তে বাড়তে ২০২২ সালের প্রথম মাস জানুয়ারিতে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি ১১ শতাংশ ছাড়িয়ে ১১ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশে উঠে যায়। তবে ফেব্রুয়ারিতে এই প্রবৃদ্ধি কমে ১০ দশমিক ৭২ শতাংশে নেমে আসে।  

মার্চে তা দশমিক ৫৭ শতাংশীয় পয়েন্ট বেড়ে ১১ দশমিক ২৯ শতাংশে ওঠে। এপ্রিল মাসে তা ১২ শতাংশ ছাড়িয়ে ১২ দশমিক ৪৮ শতাংশে ওঠে। মে মাসে তা আরও বেড়ে ১২ দশমিক ৯৪ শতাংশ ওঠে। জুন মাসে ১৩ শতাংশ ছাড়িয়ে ১৩ দশমিক ৬৬ শতাংশে ওঠে।  

২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে তা আরও বেড়ে ১৩ দশমিক ৯৫ শতাংশে উঠেছিল। পরের মাস আগস্টে ১৪ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়।

অনলাইন জুয়া, মোবাইল ব্যাংকিংয়ে অর্থ পাচার নিয়ে সতর্কতা পরবর্তী

অনলাইন জুয়া, মোবাইল ব্যাংকিংয়ে অর্থ পাচার নিয়ে সতর্কতা

কমেন্ট