টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ না দেওয়ার পরামর্শ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের
বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে এক বৈঠকে এই পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। ফাইল ছবি
নতুন করে টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ না দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন প্রবীণ অর্থনীতিবিদ সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে এক বৈঠকে তিনি এ পরামর্শ দিয়েছেন।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, “এমনিতেই দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি তৈরি হয়েছে। নতুন করে টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দিলে, তা আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।”
দেশের অর্থনীতিবিদরা দীর্ঘদিন ধরে পরামর্শ দিলেও তাতে সাড়া না দিয়ে গত অর্থবছরে ডেভেলপমেন্ট ব্যবস্থার মাধ্যমে রেকর্ড পরিমাণ নতুন টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
এতে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে গেছে। তাই এবার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণসহ দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে অর্থনীতিবিদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
তারই অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবার প্রথম দিনের আলোচনায় ছিলেন দেশের বিশিষ্ট ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। পর্যায়ক্রমে দেশের অন্য অর্থনীতিবিদদের সঙ্গেও আলোচনা করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বৈঠক শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক সাংবাদিকের এ তথ্য জানিয়ে বলেন, “ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ডেভেলপমেন্ট ব্যবস্থায় নতুন টাকা ছাপিয়ে সরকারের ঋণ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং সরকারকে বিষয়টি জানানো হয়েছে।”
তিনি বলেন, “চলমান অর্থনৈতিক সংকটে বাংলাদেশ ব্যাংক যেসব নীতি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, সেগুলো জানাতে দেশের অর্থনীতিবিদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রথম দিনে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে।”
“মূল্যস্ফীতি, খেলাপি ঋণ ও ডলারের বিনিময় হারসহ বিভিন্ন বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, সেগুলো সম্পর্কে তাকে জানানো হয়েছে। এসব পদক্ষেপের বিষয়ে ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, পদক্ষেপগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।”
মেজবাউল হক আরও বলেন, ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বিশেষ করে দুটো বিষয়ে নজর দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকে পরামর্শ দিয়েছেন। তা হলো- হাই পাওয়ার মানি সৃষ্টি করে সরকারকে ঋণ না দেয়া। এ প্রক্রিয়াটি ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক বন্ধ করেছে।
“কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন করে টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দিলে হাই পাওয়ার মানি সৃষ্টি হয়, তা সরকারকে জানানো হয়েছে। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতি ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনার কথাও বলেছেন। সে বিষয়টি প্রয়োজন হলে আগামী মুদ্রানীতিতে আনা হবে বলে জানানো হয়েছে।”
সরকারকে টাকা ছাপিয়ে ঋণ দেয়ার ফলে মূল্যস্ফীতি সৃষ্টি হয়েছে বলেও স্বীকার করেন মুখপাত্র।
তিনি বলেন, “মূল্যস্ফীতি এখন বড় চ্যালেঞ্জ। ডলারের বিনিময় হারে নতুন সিদ্ধান্তের ফলে টাকার বড় ধরনের অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। পণ্যমূল্যে সেটার প্রভাব পড়েছে। যেহেতু আমরা আমদানিনির্ভর দেশ। এ ছাড়া গত অর্থবছর সরকারের ঋণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকমুখী ছিল। অনেকটাই নতুন টাকা সৃষ্টি করে দেওয়া হয়েছে, যা মূল্যস্ফীতিতে কিছুটা হিট করেছে।”
“এটি বন্ধ করা হয়েছে। বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডেভেলপমেন্টের মাধ্যমে সরকারকে কোনো ঋণ দেয়া হচ্ছে না। ফলে সরকারকে ব্যাংকিং সিস্টেম থেকেই ঋণ নিতে হবে,” বলেন মেজবাউল হক।
বাংলাদেশের অর্থনীতির উদ্বেগজনক ও স্পর্শকাতর সূচক হচ্ছে মূল্যস্ফীতি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয় মাস আগস্টে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ। খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ।
বিস্ময়কর তথ্য হচ্ছে, শহরের চেয়ে গ্রামে খাবারের দাম বেশি বেড়েছে। আগস্টে গ্রামে খাদ্য মূল্যস্ফীত হয়েছে ১২ দশমিক ৭১ শতাংশ। শহরে খাদ্য মূল্যস্ফীত হয়েছে ১২ দশমিক ১১ শতাংশ।
আগের মাস অর্থাৎ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ। আর খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
আগস্ট মাসে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ সার্বিক মূল্যস্ফীতির অর্থ হলো ২০২২ সালের আগস্ট মাসে দেশের মানুষ যে পণ্য বা সেবা ১০০ টাকায় পেয়েছিল, এই বছরের আগস্টে তা কিনতে ১০৯ টাকা ৯২ পয়সা খরচ করতে হয়েছে।
আর ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ খাদ্য মূল্যস্ফীতির অর্থ হলো ২০২২ সালের আগস্ট মাসে দেশের মানুষ যে খাদ্য ১০০ টাকায় পেয়েছিল, এই বছরের আগস্টে তা কিনতে ১১২ টাকা ৫৪ পয়সা খরচ করতে হয়েছে।
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে গড় মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে আটকে রাখার লক্ষ্য ধরেছে সরকার।
১ জুন বাজেট ঘোষণার পর থেকেই ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদসহ দেশের সব অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা সংস্থাগুলো বলে আসছে বাজারের যে অবস্থা তাতে সরকারের এই লক্ষ্য কখনই পূরণ হবে না।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে অর্থনীতিতে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৯ সালে ইসলামাবাদের কায়েদ-ই-আজম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে রেকর্ড নম্বর পেয়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে এমএসসি পাস করেন।
এরপর ১৯৭৭ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। এর আগে ১৯৬৩ ও ১৯৬৫ সালে ড. মাহমুদ রেকর্ড নম্বর পেয়ে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধাতালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করেন।
তিনি ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপনা শুরু করেন; ১৯৮৪ সালে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পান এবং ২০১১ সালে অবসর নেন। তিনি বর্তমানে ইন্টারন্যাশনাল গ্রোথ সেন্টারের সিনিয়র কান্ট্রি উপদেষ্টা এবং বাংলাদেশ ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন।
তিনি ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশে জাতীয় পর্যায়ে পলিসি প্রণয়নে বিভিন্ন সময়ে তিনি ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি ১৯৯৩-২০০৯ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১৬ বছর বাংলাদেশ ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
এ ছাড়া পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) একজন সহপ্রতিষ্ঠাতা এবং পরবর্তী সময়ে চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেন।
বাংলাদেশের চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং প্রেক্ষিত পরিকল্পনা (২০১৫-২০৩০) সম্পাদনে তিনি অর্থনীতিবিদ প্যানেলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন।
কমেন্ট