রিজার্ভ যেনো আর না কমে: গভর্নরকে আহসান মনসুরের পরামর্শ

রিজার্ভ যেনো আর না কমে: গভর্নরকে আহসান মনসুরের পরামর্শ

বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে বৈঠকে এই পরামর্শ দিয়েছেন আহসান এইচ মনসুর।

বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে আলোচিত, গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ যেনো আর কমে, সেজন্য জরুরিভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারকে পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর।

বুধবার গভর্নরের সঙ্গে এক বৈঠকে এই পরামর্শ দিয়েছেন বলে এআরএইচ ডটকমকে জানিয়েছেন তিনি। বৈঠকে পিআরআইয়ের ভাইস চেয়ারম্যান সাদিক আহমেদও ছিলেন।

গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, মূল্যস্ফীতির চাপ, ডলারের দাম বৃদ্ধি এবং লাগামহীন খেলাপি ঋণ এখন অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এ পরিস্থিতিতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কোনোভাবেই আর কমতে দেওয়া যাবে না । এছাড়া সবার আগে মূল্যস্ফীতি কমাতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

“এই বিষয়গুলোই আমি গভর্নরের কাছে জোরালোভাবে উপস্থাপন করেছি। বলেছি, রিজার্ভ কমতে কমতে অনেক নিচে নেমে এসেছে। এটাকে কোনো অবস্থাতেই কমতে দেওয়া যাবে না। আমি বলেছি, রপ্তানি আয়ের ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকলেও রিজার্ভের অন্যতম প্রধান উৎস প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স অনেক কমে গেছে; ধস নেমেছে বলা যায়।

“এর প্রধান কারণ হুন্ডি। প্রবাসীরা এখন অবৈধ হুন্ডির মাধ্যমে অনেক টাকা দেশে পাঠাচ্ছেন। ব্যাংকিং চ্যানেলের চেয়ে বেশি টাকা পাওয়ার কারণেই তারা এটা করছে। যে করেই হোক এটা বন্ধ করতে হবে। সব রেমিটেন্স যাতে ব্যাংকিং চ্যানেলে আসে সেটা নিশ্চিত করতে হবে।”

“একইসঙ্গে রিজার্ভের আরেক উৎস বিভিন্ন দাতাদেশ ও সংস্থার কাছ থেকে বিদেশি ঋণ-সহায়তা আনতে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে।

রিজার্ভ বাড়ানোর ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলো বিবেচনা করতে গভর্নরকে অনুরোধ করেছেন বলে জানান দীর্ঘদিন আইএমএফের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা আহসান এইচ মনসুর।

তিনি বলেন, “সামনে জাতীয় নির্বাচন। তাই অর্থনীতিতে এখনই বড় ধরনের সংস্কার করতে চাইবে না সরকার। সে কারণে আমি গভর্নরকে অর্থনীতির সংকট থেকে উত্তরণে আপাতত স্বল্পমেয়াদি কিছু পদক্ষেপ নিতে বলেছি। বড় উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে ক্রমান্বয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে আসছে। তবে বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি ধরে রাখার স্বার্থে রিজার্ভ আর কমতে দেওয়া ঠিক হবে না। এ জন্য রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয় বাড়ানোর ওপর জোর দিতে হবে। একইসঙ্গে বিদেশি উৎস থেকে সহজ শর্তে কম সুদের ঋণের জন্য জোর প্রচেষ্টা চালাতে হবে।”

আহসান মনসুর আরও বলেন, “এই মুহূর্তে আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে মূল্যস্ফীতি; এই সূচক নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।”

“বিশেষ করে টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দেওয়া বন্ধ করতে হবে। রাজস্ব আহরণ বাড়িয়ে সরকারকে ব্যয় করতে হবে। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতির স্থিতিশীলতায় কর-জিডিপির অনুপাত বাড়াতে রাজস্ব প্রশাসনে বড় ধরনের সংস্কার করতে হবে। ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে হবে। একইসঙ্গে ব্যাংকিং খাত ও সরকারি অর্থ ব্যয়ে আরও স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।”

এ বিষয়গুলা নিয়েই গভর্নরের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা হয়েছে বলে জানান তিনি।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণসহ দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে অর্থনীতিবিদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

তারই অংশ হিসেবে গত ২১ সেপ্টেম্বর প্রবীণ অর্থনীতিবিদ সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের সঙ্গে প্রথম বৈঠক করেন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।

বুধবার বৈঠক করেন আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে।

বৈঠক শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক সাংবাদিকদের বলেন, মূল্যস্ফীতি, ডলারের দামের অস্থিতিশীলতা এবং খেলাপি ঋণ এ সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তাই সবার আগে মূল্যস্ফীতি কমানোর পরামর্শ দেন আহসান এইচ মনসুর। পাশাপাশি নতুন করে টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ না দেওয়ার ওপর জোর দেন তিনি।

তিনি বলেন, “বৈঠকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে তাকে জানানো হয়, বর্তমানে জমি অধিগ্রহণসহ বিভিন্ন খাতে খরচ কমিয়েছে সরকার। তাই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এখন আর ঋণ নেওয়ার প্রয়োজন হচ্ছে না। সরকারও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এখন ঋণও নিচ্ছে না। তবে প্রয়োজন হলে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারবে সরকার।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সবশেষ তথ্যে দেদখা যায়, গত আগস্টে খাদ্য মূল্যস্ফীতি সাড়ে ১২ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। সার্বিক মূল্যস্ফীতি উঠেছে প্রায় দুই অঙ্কের ঘরে (ডাবল ডিজিট); ৯ দশমিক ৯২ শতাংশে। যা ১২ বছর বা এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ।

রিজার্ভ কমছেই

বুধবার দিনের শুরুতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম৬ অনুযায়ী বাংলাদেশের রিজার্ভ কমে ২১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভ নেমেছে ২৭ দশমিক শূন্য পাঁচ বিলিয়ন ডলারে।

গত সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার বিপিএম৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২১ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’হিসাবে ছিল ২৭ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার।

এ হিসাবে এক সপ্তাহে বিপিএম৬ হিসাবে রিজার্ভ কমেছে ৩০ কোটি ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে কমেছে ২৮ কোটি ডলার।

দুই সপ্তাহ আগে ১৪ সেপ্টেম্বর বিপিএম৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২১ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৭ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলার।

গত ৫ সেপ্টেম্বর বিপিএম৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২৩ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৯ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার।

৭ সেপ্টেম্বর এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) জুলাই-আগস্ট মেয়াদের ১ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলারের আমদানি বিল পরিশোধের পর বিপিএম৬ হিসাবে রিজার্ভ ২১ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভ কমে দাঁড়ায় ২৭ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলারে।

ত ১২ জুলাই থেকে আইএমএফের কথামতো রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ‘গ্রস’ হিসাবের পাশাপাশি বিপিএম৬ পদ্ধতি অসুসরণ করেও রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ওই দিন ‘গ্রস’রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৯ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার। আর বিপিএম৬ পদ্ধতিতে ছিল ২৩ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার।

এর পর থেকে রিজার্ভ কমছেই। হিসাব করে দেখা যাচ্ছে, গত আড়াই মাসে ‘গ্রস’ রিজার্ভ কমেছে ২ দশমিক ৯২ বিলিয়ন ডলার। আর বিপিএম৬ পদ্ধতির হিসাবে কমেছে ২ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার।

সবশেষ গত জুলাই মাসে পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের ৫ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। সে হিসাবে বর্তমানের ২১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ দিয়ে সাড়ে চার মাসের কিছু বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে।

আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুত থাকতে হয়।

অনলাইনে কেনাকাটায় প্রতারণা ঠেকাতে নীতিমালা পরবর্তী

অনলাইনে কেনাকাটায় প্রতারণা ঠেকাতে নীতিমালা

কমেন্ট