খেলাপি ঋণ দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়াল

খেলাপি ঋণ দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়াল

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সব মিলিয়ে প্রকৃত খেলাপি ঋণ চার লাখ কোটি টাকার বেশি। পাহাড়সম এই খেলাপি ঋণ দেশের ব্যাংকিং খাতকে একটি ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে বলে মনে করছেন তারা।

২০১৯ সালের ১০ জানুয়ারি অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই আ হ ম মুস্তফা কামাল সংবাদ সম্মেলন করে ঘোষণা দিয়েছিলেন, “আজকের পর থেকে এক টাকাও খেলাপি ঋণ বাড়বে না।”

অর্থমন্ত্রী যখন ওই ঘোষণা দেন, তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ কোটি টাকার কিছু বেশি। সাড়ে তিন বছর পর অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে সেই খেলাপি ঋণ এখন দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।

তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সব মিলিয়ে প্রকৃত খেলাপি ঋণ চার লাখ কোটি টাকার বেশি। পাহাড়সম এই খেলাপি ঋণ দেশের ব্যাংকিং খাতকে একটি ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন তারা।

বাংলাদেশ ব্যাংক রোববার ব্যাংকিং খাতের প্রধান সমস্যা খেলাপি ঋণের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংক খাতে মোট ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ৪২ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে এক লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকার ঋণ।

অর্থাৎ ব্যাংকিং খাতে বিতরণ করা মোট ঋণের ১০ দশমিক ১১ শতাংশই  খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।

এই অঙ্ক চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের পাঁচ ভাগের এক ভাগ বা ২০ দশমিক ৫০ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের বাজেটের আকার ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০২২ সালের জুন শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরেমাণ ছিল ১ লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের জুনে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা।

এই হিসাব বলছে, এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩০ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা। ছয় মাসে (ডিসেম্বর ২০২২ থেকে জুন ২০২৩) বেড়েছে ৩৫ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা

মার্চ শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি ৮০ লাখ টাকা বা মোট ঋণের ৮ দশমিক ৮০ শতাংশ। মাত্র তিন মাসের (এপ্রিল থেকে জুন) ব্যবধানে ২৪ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা বেড়েছে।

মহামারি করোনার কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালে ঋণ পরিশোধে পুরোপুরি ছাড় দেওয়া হয়েছিল। ঋণ শোধ না করেও গ্রাহককে ‘খেলাপি’ থেকে মুক্ত রাখার সুযোগ করে দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

কম সুদে ঋণ নেওয়া ও ঋণ পরিশোধে কিছুটা ছাড় ছিল ২০২২ সালেও। চলতি বছরও ঋণের কিস্তির অর্ধেক পরিশোধে রয়েছে বিশেষ ছাড়।

এমন সব সুযোগের পরও ব্যাংকের টাকা ফেরত দিচ্ছে না গ্রাহক। যে কারণে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েও খেলাপি ঋণ কমাতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

খেলাপিদের বিশেষ ছাড় বন্ধ না হলে খেলাপি ঋণ কমবে না বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা, তাদের মতে ঢালাওভাবে সুবিধা প্রদানের কারণে ব্যাংকের পাশাপাশি গ্রাহকও বিপদে পড়বে।

বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি বছরের ২০ জুন জানায়, যদি কোনো গ্রাহক চলতি বছরের জুনের মধ্যে ঋণের কিস্তির অর্ধেক টাকা জমা দেয় সে খেলাপি হবে না। ফলে যারা ঋণ নিয়ে কিস্তি শোধ না করে খেলাপি হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছিলেন, তারা কিস্তির অর্ধেক টাকা জমা দিয়েই নিয়মিত গ্রাহক হওয়ার সুযোগ পান।

তবে শুধু মেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে এই সুবিধা দেওয়া হয়। সাধারণত ব্যবসা শুরু করা বা শিল্পকারখানা গড়ে তুলতে মেয়াদি ঋণ নেওয়া হয়।

অর্থনীতির গবেষক বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বিশাল অঙ্কের এই খেলাপি ঋণকে ‘ব্যাংক খাতের জন্য অশনি সংকতে’ উল্লেখ করে বলেন, “আমরা যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবটাকেই মেনে নেই, তাহলেও কিন্তু ভয়ঙ্কর বিপদের মধ্যে আছি আমরা; আমাদের ব্যাংকগুলো। বাজেটের পাঁচ ভাগের এক ভাগ খেলাপি ঋণ। এটা কোনো দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা হতে পারে না।”

“এবার আসা যাক খেলাপি ঋণের প্রকৃত হিসাবে। গত ১৩ আগস্ট কেন্দ্রীয় ব্যাংক আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন (ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্ট) প্রকাশ করেছে। তাতে হিসাব দেওয়া হয়েছে, ২০২২ সাল শেষে পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন করা মোট ঋণের অঙ্ক ২ লাখ ১২ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা। আর রাইট অফ (অবলোপন) করা ঋণের পরিমাণ ৪৪ হাজার ৪৯৩ কোটি টাকা।”

 আহসান মনসুর বলেন, “ধরে নিলাম গত ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন করা ঋণের অঙ্ক বাড়েনি। রাইট অফও করা হয়নি কোনো ঋণ। তার পরও বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকার সঙ্গে পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন করা এবং রাইফ অফ করা ঋণ যোগ করলে ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণ দাঁড়াবে ৪ লাখ ১৩ হাজার ৩১২ কোটি টাকা। যেটা কিন্তু বাজেটের অর্ধেকেরও বেশি, ৫৪ দশমিক ২৫ শতাংশ।”

“পাহাড়সম এই ঝুঁকিপূর্ণ ঋণই প্রমাণ করে যে, আমাদের ব্যাংকিং খাতের অবস্থা কতোটা খারাপ অবস্থায় আছে। এই বিশাল অঙ্কের ঋণ আদৌ আদায় হবে কী না-তা নিয়ে যথেস্ট সংশ্রয় আছে। আর যদি সেটা না হয়, তাহলে এটা বলা যায় যে, আমাদের ব্যাংকিং খাত একটি ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে," বলেন বেসরকারি ব্র্যাক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আহসান মনসুর।

একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ মইনুল ইসলাম বলেন, “ব্যাংকিং খাতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় লুটপাটের অর্থনীতি চালু আছে দেশে। লুটপাটের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে খেলাপি ঋণ। আমার ‘বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে খেলাপি ঋণ’শীর্ষক এক গবেষণায় আমি দেখিয়েছি, ৭৭ শতাংশ খেলাপি ঋণ রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার কারণে হয়েছে। ২০১০ সালে এ গবেষণা বই আকারে বেরিয়েছে।”

৩০ বছর ধরে খেলাপি ঋণ নিয়ে গবেষণা করার অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে মইনুল ইসলাম বলেন, “আমি দেখেছি সরকারের একটা দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে খেলাপিদের লাই দেওয়া, সুবিধা দেওয়া। ২০১৯ সালে আ হ ম মুস্তফা কামাল অর্থমন্ত্রী হয়ে আসার পর থেকে এ প্রবণতা আরও বেড়েছে। একটার পর একটা আইনি সুবিধা দেওয়ার সর্বশেষ সংযোজন হচ্ছে কিছুদিন আগে ব্যাংক কোম্পানি আইনের পরিবর্তন করে তাদের আরও সুবিধা দেওয়া হয়েছে।”

আইএমএফের শর্ত থেকে অনেক দূরে

এদিকে প্রায় দুই বছর ধরে দেশে ডলার সংকট চলছে। সংকট কাটাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের দারস্ত হয় বাংলাদেশ। ঋণের প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। বাকি ছয় কিস্তির মধ্যে আগামী নভেম্বরে দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের কথা রয়েছে।

কয়েক ধাপে ঋণ ছাড়ের ক্ষেত্রে সংস্থাটি ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণও ধাপে ধাপে কমিয়ে আনার শর্ত জুড়ে দেয়। এর মধ্যে রয়েছে ২০২৬ সালের মধ্যে সরকারি ব্যাংকে খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের নিচে এবং বেসরকারি ব্যাংকে ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে হবে।

তবে বর্তমানে সরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে।

১০ ট্রেজারিপ্রধানকে এক লাখ টাকা করে জরিমানা পূর্ববর্তী

১০ ট্রেজারিপ্রধানকে এক লাখ টাকা করে জরিমানা

‘স্মাট’ সুদহার বাড়ছেই, অক্টোবরে ৭.২০ শতাংশ পরবর্তী

‘স্মাট’ সুদহার বাড়ছেই, অক্টোবরে ৭.২০ শতাংশ

কমেন্ট