দেশে দেশে মুদ্রার দরপতন: শ্রীলংকা পাকিস্তানের পরেই বাংলাদেশ
শুধু বাংলাদেশি মুদ্রা টাকা নয়, শ্রীলঙ্কা, জাপান, ভারত,পাকিস্তানের রুপিসহ বিশ্বের অনেক বড় দেশের মুদ্রার মানও ডলারের বিপরীতে কমেছে। অর্থাৎ হার্ড কারেন্সি হিসেবে ডলারের মান বেড়েছে।
দেশের অর্থনীতিতে বড় আতঙ্কের নাম এখন ডলার। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর এই মুদ্রাটির দাপটে বেসামাল হয়ে পড়েছে অর্থনীতি। চাহিদা অনুযায়ী ডলার মিলছে না। বেড়েই চলেছে দাম; কমছে টাকার মান।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, শুধু বাংলাদেশি মুদ্রা টাকা নয়, শ্রীলঙ্কা, জাপান, ভারত,পাকিস্তানের রুপিসহ বিশ্বের অনেক বড় দেশের মুদ্রার মানও ডলারের বিপরীতে কমেছে। অর্থাৎ হার্ড কারেন্সি হিসেবে ডলারের মান বেড়েছে।
পৌনে দুই বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক মন্দার প্রভাবে ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়নে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলংকা ও পাকিস্তানের পরেই রয়েছে বাংলাদেশ।
গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডলারের বিপরীতে সবচেয়ে বেশি মান কমেছে শ্রীলংকান রুপির। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে পাকিস্তানি রুপি। এর পরেই রয়েছে বাংলাদেশি মুদ্রা টাকার অবস্থান।
মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মুদ্রার মান ডলারের বিপরীতে তুলনামূলকভাবে কম কমেছে। ওইসব দেশের মধ্যে জাপানের মুদ্রার মান একটু বেশি কমেছে। সৌদি আরব, ওমানসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের মুদ্রার মান ডলারের বিপরীতে কমেনি, বরং সামান্য বেড়েছে।
তবে ইউরোপের একক মুদ্রা ইউরোসহ ওই অঞ্চলের বিভিন্ন দেশের মুদ্রার মান বেশ কমেছে।
আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনের ডেটাবেজে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশের মুদ্রার মানের তথ্য দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়ে যায়। এতে পণ্যের সরবরাহও বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে বাড়ে পণ্য পরিবহণ ভাড়াসহ জাহাজ ভাড়া। এতে বিভিন্ন দেশের পণ্য আমদানি ব্যয় বেড়ে যায়। এর প্রভাবে বেড়ে যায় স্থানীয় মুদ্রার বিপরীতে ডলারের দাম।
ফলে একদিকে মূল্যস্ফীতির পারদ চড়েছে। অন্যদিকে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। কিছু দেশ মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও ডলারের দাম এখনও নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি।
বাংলাদেশসহ স্বল্প-আয়ের দেশগুলোয় মূল্যস্ফীতিসহ ডলারের দামে ঊর্ধ্বগতি এবং ডলারের তীব্র সংকট অব্যাহত রয়েছে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদশের মুদ্রা টাকার মান গত বছরের এপ্রিল পর্যন্ত স্থিতিশীল ছিল। জুলাইয়ের পর এর দাম বাড়তে থাকে। এর আগে ২০২০ সালে ডলারের বিপরীতে টাকা বরং শক্তিশালী হয়েছিল।
২০২১ সালের জুলাইয়ে প্রতি ডলারের দাম ছিল গড়ে ৮৪ টাকা ৮০ পযসা। লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে গত সেপ্টেম্বরে তা হয়েছে ১১০ টাকা ৫০ পয়সা। আলোচ্য সময়ে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে ৩০ দশমিক ৩১ শতাংশ।
মাস খানেকের বেশি সময় ধরে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার ১১০ টাকা ৫০ পয়সায় বিক্রি হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও এই দরে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ থেকে ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করছে।
তবে গত রোববার থেকে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সে ডলারের দাম বাড়িয়ে ১১২ টাকা ৭৫ পয়সা করা হয়েছে। ফলে টাকার মান আরও কমেছে। এছাড়া বিভিন্ন ব্যাংকে নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে ডলার কিনতে হচ্ছে। এতে ডলারের বিপরীতে টাকার মান আরও কমেছে।
বেসরকারি সিটি ব্যাংক সোমবার ১১৩ টাকা দরে নগদ ডলার বিক্রি করেছে। ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডও (ইবিএল) একই দরে ডলার বিক্রি করেছে। তবে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক ১১২ টাকা দরে নগদ ডলার বিক্রি করেছে। সোনালী ব্যাংক বিক্রি করেছে ১১১ টাকায়।
আইএমএফের প্রতিবেদনে বলা হয়, অর্থনৈতিক সংকটে দেউলিয়া হওয়ার কারণে শ্রীলংকার মুদ্রা রুপির দাম ব্যাপকভাবে কমে যায়। গত বছরের জুলাইয়ে ডলারের বিপরীতে শ্রীলংকান রুপির দাম ছিল ১৯৯ টাকা ৯০ পয়সা। গত সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৬৩ টাকা ৩০ পয়সায়।
আলোচ্য সময়ে এর মান কমেছে ৮১ দশমিক ৭৪ শতাংশ, যা এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। একই সময়ে পাকিস্তানও বেশ অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে। এতে দেশটির মুদ্রা রুপির দামে বড় ধরনের পতন ঘটে।
গত বছরের জুলাইয়ে ডলারের বিপরীতে পাকিস্তানি রুপির দাম ছিল ১৬২ টাকা ৫১ পয়সা। গত সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৯৪ টাকা ২৯ পয়সায়। আলোচ্য সময়ে দেশটির মুদ্রার মান কমেছে ৮১ দশমিক ০৯ শতাংশ।
এর পরেই কমেছে জাপানের মুদ্রা ইয়েনের দাম। তারা মুদ্রাকে প্রতিযোগিতামূলক রাখতে এর বিনিময় হার নমনীয় রেখেছে। আলোচ্য সময়ে জাপানি মুদ্রার মান কমেছে প্রায় ২২ শতাংশ।
ভারতীয় মুদ্রা রুপির মান কমেছে ১১ দশমিক ৮৭ শতাংশ। গত বছরের জুলাইয়ে প্রতি ডলারের দাম ছিল ৭৪ দশমিক ৩৯ রুপি। গত সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৩ দশমিক ২২ রুপি।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে মালদ্বীপ ও ভুটানের মুদ্রার মান তেমন একটা কমেনি। থাইল্যান্ডের মুদ্রা বাথের মান কমেছে সাড়ে ১১ শতাংশ। মালয়েশিয়ার মুদ্রার মান তেমন একটা কমেনি।
মধ্যপ্রাচের দেশগুলোর বেশির ভাগেরই ডলারের বিপরীতে মুদ্রার মান কমেনি। বরং সৌদি আরব ও ওমানের মুদ্রার মান বেড়েছে।
এদিকে গত বছরের ১ জুলাই থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত এক বছরে ডলারের বিপরীতে এশীয় দেশগুলোর মধ্যে স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন বাংলাদেশে হয়েছে ১৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ। অর্থাৎ ওই হারে বাংলাদেশি মুদ্রার মান কমেছে। এর বিপরীতে বেড়েছে ডলারের দাম।
এই এক বছরে ভিয়েতনামের মুদ্রার ২ দশমিক ৯০, ফিলিপাইনের দশমিক ৬২, ইন্দোনেশিয়ার ১ দশমিক ১৮, ভারতে ৩ দশমিক ৭৮, চীনে ৭ দশমিক ৭৯ এবং কোম্বোডিয়ায় শূন্য দশমিক ৮৬ শতাংশ অবমূল্যায়ন হয়েছে।
তবে পাকিস্তান ও শ্রীলংকার মুদ্রার মান আরও বেশি কমেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এ মুহূর্তে ডলারের বিপরীতে অন্যান্য মুদ্রার দামের পতনের বহুবিধ কারণ থাকলেও প্রধান কারণ দুটি।
এক—রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে পেট্রোলিয়াম থেকে রকমারি পণ্য—সবকিছুরই দাম বেড়েছে। অর্থাৎ ডলারের অঙ্কে সেই পণ্যগুলোর দাম বেড়েছে। বহু ক্ষেত্রেই আমদানির পরিমাণ যেহেতু অন্তত স্বল্প মেয়াদে কমানো অসম্ভব, ফলে আমদানি খাতে ব্যয় বেড়েছে। শুধু বাংলাদেশে নয়, সব দেশেরই। তাতে ডলার মূল্যবান হয়েছে, উল্টো দিকে টাকার দাম পড়েছে।
দ্বিতীয় কারণটি হলো—আমেরিকার ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার বাড়িয়েছে। সারা পৃথিবীতে আর্থিক ক্ষেত্রে তুমুল অনিশ্চয়তা চলছে—এ অবস্থায় বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান করেন। সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় মার্কিন ডলার সে দেশেই জমা রাখা লাভজনক, নিরাপদ।
ফলে ভারতের মতো বাজার থেকে বিনিয়োগ তুলে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। গোটা এশিয়াতেই স্থানীয় মুদ্রার বড় দরপতন হয়েছে।
কমেন্ট