আগস্টে মোবাইলে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা লেনদেন

আগস্টে মোবাইলে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা লেনদেন

লেনদেনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে গ্রাকহ সংখ্যা। পাঁচ বছর আগে মোট গ্রাহক সংখ্যা ছিল ৬ কোটি ৭৬ লাখ ৭০ হাজার ৪৬৮। আগস্টে সেই গ্রাহক প্রায় তিন গুণ বেড়ে ২১ কোটি ২৪ লাখ ছাড়িয়েছে।

বিশ্বজুড়ে মোবাইলে আর্থিক লেনদেনের পরিমাণ বাড়ছে। বৈশ্বিক সংস্থা জিএসএমএর প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে দিনে ৩০০ কোটি ডলারের লেনদেন হলেও গত বছর সেটি বেড়ে ৩৪৫ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। ২০২২ সালে বিশ্বে মোবাইলে অর্থ লেনদেন হয়েছে ১ লাখ ২৬ হাজার কোটি ডলারের।

বাংলাদেশেও মোবাইলে আর্থিক সেবা অথবা এমএফএস ব্যবহার প্রত্যাশার চেয়েও দ্রুতগতিতে বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, গত আগস্ট মাসে দেশে মোবাইল ফোনে এক লাখ ৯ হাজার ৫৫৫ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। দৈনিক গড় লেনদেনের পরিমাণ ৩ হাজার ৬৫২ কোটি টাকা।

একক মাসের হিসাবে এই লেনদেন তৃতীয় সর্বোচ্চ লেনদেন।

অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গত জুন মাসে মোবাইলের মাধ্যমে ১ লাখ ৩২ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা লেনদেন হয়। দৈনিক গড় লেনদেনের অঙ্ক ৪ হাজার ৪০৫ কোটি টাকা।

দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লেনদেন হয় এপ্রিল মাসে—এক লাখ ২৪ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা।

গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের শেষ চার মাসেই (মার্চ, এপ্রিল, মে ও জুন) মোবাইলে লাখ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়েছিল। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রথম মাস জুলাইয়ে তা কমে লাখ কোটি টাকার নিচে—৯৮ হাজার ৩০৬ কোটি টাকায় নেমে আসে।

আগস্টে তা বেড়ে ফের লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকায় উঠেছে।

জিএসএমএর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে ব্যাংকিং সেবার বাইরে থাকা জনগোষ্ঠী, বিশেষত নারীদের আর্থিক খাতে অন্তর্ভুক্তির জন্য মোবাইলে আর্থিক সেবা বা এমএফএস বড় ভূমিকা রাখতে পারে। তাদের মধ্যে পরিবর্তন আনা ও ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রেও অবদান রাখতে পারে।

বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে জিএসএমএ প্রতিবছর এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

বাংলাদেশেও গত এক দশকে এমএফএস জনপ্রিয় হয়েছে। গত আগস্টে এমএফএসে সব মিলিয়ে গ্রাহকের সংখ্যা ছিল ২১ কোটি ২৪ লাখ ২০ হাজার ৪৭৬। তবে সক্রিয় গ্রাহক আট কোটির মত।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, গত জানুয়ারিতে এমএফএসের মাধ্যমে লেনদেন হয়েছে ১ লাখ ৫৯৩ কোটি টাকা। ডিসেম্বরে এ খাতে লেনদেন ছিল ৯৬ হাজার ১৩২ কোটি টাকা।

২০১৮ সালের ডিসেম্বরে মোবাইলে লেনদেন হয়েছিল ৩২ হাজার ১১৬ কোটি টাকা। প্রতিদিনের গড় লেনদেন ছিল ১ হাজার ৭০ কোটি টাকা। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, পাঁচ বছরের ব্যবধানে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে লেনদেন বেড়েছে প্রায় সাড়ে তিন গুণ।

লেনদেনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে গ্রাকহ সংখ্যা। পাঁচ বছর আগে মোট গ্রাহক সংখ্যা ছিল ৬ কোটি ৭৬ লাখ ৭০ হাজার ৪৬৮। আগস্টে সেই গ্রাহক প্রায় তিন গুণ বেড়ে ২১ কোটি ২৪ লাখ ছাড়িয়েছে।

এভাবেই ব্যাংকিং সেবায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে মোবাইল ব্যাংকিং। কেবল টাকা পাঠানোই নয়, দেশের অর্থনীতিতে প্রতি মুহূর্তে গতি সঞ্চার করে চলেছে মোবাইল ব্যাংকিং। বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানির বিল অর্থাৎ সেবামূল্য পরিশোধ, বেতন-ভাতা প্রদান, বিদেশ থেকে টাকা পাঠানো অর্থাৎ প্রবাসী-আয় বা রেমিটেন্স পাঠানোর ক্ষেত্রে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা এখন অন্যতম পছন্দের মাধ্যম।

প্রতিদিন নতুন নতুন সেবা যোগ হচ্ছে। এই সেবার হাত ধরেই দেশে আসছে ‘ডিজিটাল ব্যাংক’। দেশের সবচেয়ে বড় মোবাইল আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান বিকাশ ও ডাক বিভাগের মোবাইল সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান নগদ ‘ডিজিটাল ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে।

প্রায় সব বেসরকারি ব্যাংকও ‘ডিজিটাল ব্যাংক’ নিয়ে আসার ঘোষণা দিয়েছে।

  

বাংলাদেশে মোবাইলের মাধ্যমে আর্থিক সেবার যাত্রা শুরু হয় ২০১১ সালের ৩১ মার্চ। বেসরকারি খাতের ডাচ্-বাংলা ব্যাংক প্রথম এ সেবা চালু করে। পরে এটির নাম বদলে হয় রকেট। এরপর ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে এমএফএস সেবা চালু করে বিকাশ।

পরবর্তী সময়ে আরও অনেক ব্যাংক এ সেবায় এসেছে। তবে খুব সুবিধা করতে পারেনি। বর্তমানে বিকাশ, রকেটের পাশাপাশি মাই ক্যাশ, এম ক্যাশ, উপায়, শিওর ক্যাশসহ ১৫টি ব্যাংক এ সেবা দিচ্ছে। এর বাইরে ডাক বিভাগের সেবা নগদও দিচ্ছে এই সেবা।

এখন মোবাইল ব্যাংকিং শুধু টাকা পাঠানোর মাধ্যম না। এর ব্যবহার হচ্ছে সব ধরনের লেনদেনে। বিশেষ করে পরিষেবা বিল পরিশোধ, স্কুলের বেতন, কেনাকাটা, সরকারি ভাতা, টিকিট ক্রয়, বিমার প্রিমিয়াম পরিশোধ, মোবাইল রিচার্জ ও অনুদান প্রদানের অন্যতম মাধ্যম।

আর মোবাইল ব্যাংকিংয়ে টাকা জমা করতে এখন আর এজেন্টদের কাছেও যেতে হচ্ছে না। ব্যাংক বা কার্ড থেকে সহজেই টাকা আনা যাচ্ছে এসব হিসাবে। আবার এসব হিসাব থেকে ব্যাংকেও টাকা জমা শুরু হয়েছে, ক্রেডিট কার্ড বা সঞ্চয়ী আমানতের কিস্তিও জমা দেয়া যাচ্ছে। এর ফলে একটি মুঠোফোনই যেন একেকজনের কাছে নিজের ব্যাংক হয়ে উঠেছে।

এমএফএস লেনদেন বাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে দেশের সবচেয়ে বড় মোবাইল আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ‘বিকাশ’-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কামাল কাদীর এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে এবং আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী মোবাইল আর্থিক সেবা দেশের মানুষের দৈনন্দিন আর্থিক লেনদেনকে প্রযুক্তিনির্ভর করে সহজ, নিরাপদ এবং তাৎক্ষণিক করেছে।”

“সামগ্রিক অর্থনীতি ও জীবনযাত্রার মানের ওপর যার ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে। আগামীর স্মার্ট বাংলাদেশে ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল ইকোসিস্টেম শক্তিশালী করার মাধ্যমে ক্যাশলেস সমাজ নির্মাণেও এই খাত ভূমিকা রাখবে,” বলেন বিকাশ প্রধান।

গ্রাহকও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০১৯ সালের জুন মাসে মোবাইলের মাধ্যমে ৩১ হাজার ৯৫২ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছিল। তখন নিবন্ধিত মোট গ্রাহক সংখ্যা ছিল ৭ কোটি ৩৭ লাখ ৭৮ হাজার ৬১০। এরপর থেকে লেনদেনের অঙ্ক ও গ্রাহক সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

২০২০ সালের জানুয়ারিতে লেনদেনে অঙ্ক বেড়ে দাঁড়ায় ৪৫ হাজার ৬ কোটি টাকা; গ্রাহক সংখ্যা বেড়ে হয় ৯ কোটি ৯ লাখ ২৩ হাজার ৫৪২।

২০২১ সালের জানুয়ারিতে লেনদেন বেড়ে হয় ৬২ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা; গ্রাহক সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১২ কোটি ৫১ লাখ ১৬ হাজার ২২৩।

২০২২ সালের জানুয়ারিতে লেনদেন হয় ৮৪ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা; গ্রাহক সংখ্যা বেড়ে হয় ১৭ কোটি ৩২ লাখ ৬৭ হাজার ৯৭২।

গত বছরের এপ্রিলে লেনদেন হয়েছিল ১ লাখ ৭ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা। গ্রাহক সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৭ কোটি ২৯ লাখ ৩৭ হাজার ২৯৪।

এর পরের মাসগুলোতে অবশ্য লেনদেন কমে আসে; তবে হিসাব বা গ্রাহক সংখ্যা বেড়েই চলেছে। মে মাসে লেনদেন হয় ৭৬ হাজার ৩১২ কোটি টাকা। জুনে তা বেড়ে ৯৪ হাজার ২৯৩ কোটি টাকায় উঠে। জুলাইয়ে লেনদেন হয় ৮৯ হাজার ১৬৯ কোটি টাকা। আগস্টে হয় ৮৭ হাজার ৪৪৬ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বরে লেনদেন হয় যথাক্রমে ৮৭ হাজার ৬৩৫, ৯৩ হাজার ১৩, ৯২ হাজার ১২৫ এবং ৯৬ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা।

চলতি বছরের জানুয়ারিতে মোবাইল আর্থিক সেবার মাধ্যমে ১ লাখ ৫ হাজার ৯৩৪ কোটি টাকা লেনদেন হয়; গ্রাহক সংখ্যা বেড়ে হয় ১৯ কোটি ৪১ লাখ ২৫ হাজার ১৩৭।

পরের মাস ফেব্রুয়ারিতে লেনদেন কমে ৯৭ হাজার ৩০৭ কোটি টাকায় নেমে আসে। তবে গ্রাহক সংখ্যা বেড়ে হয় ১৯ কোটি ৬৭ লাখ ৫৯ হাজার ১৭১।

মার্চ মাসে লেনদেন বেড়ে ১ লাখ ৮ হাজার ৪৬৭ কোটি টাকায় উঠে; মোট হিসাব সংখ্যা বেড়ে হয় ১৯ কোটি ৮০ লাখ ৯১ হাজার ৭৮৩টি।

এপ্রিল মাসে লেনদেন বেড়ে ১ লাখ ২৪ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকায় উঠে। গ্রাহক সংখ্যা বেড়ে হয় ২০ কোটি ৬ লাখ ৮৯২।

মে মাসে লেনদেন কিছুটা কমে ১ লাখ ৮ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকায় নেমে আসে। তবে গ্রাহক সংখ্যা বেড়ে হয় ২০ কোটি ৩৯ লাখ ৭০১।

জুন মাসে লেনদেনের অঙ্ক এক লাফে ১ লাখ ৩২ হাজার ১৭৫ কোটি টাকায় গিয়ে উঠেছ। গ্রাহক সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২০ কোটি ৭২ লাখ ৬৮৬।

২৯ জুন দেশে কোরবানির ঈদ উদযাপিত হয়। এই উৎসবকে ঘিরে মোবাইলে লেনদেনে রেকর্ড হয় বলে জানান এফএমএস কর্মকর্তারা।

পরের মাস জুলাইয়ে অবশ্য লেনদেন কমে ৯৮ হাজার ৩০৮ কোটি টাকায় নেমে আসে। গ্রাহক সংখ্যা ছিল ২০ কোটি ৯৫ লাখ ৬৯৮।

সবশেষ আগস্ট মাসে লেনদেনের অঙ্ক বেড়ে ১ লাখ ৯ হাজার ৫৫৫ কোটি টাকায় উঠেছে। গ্রাহক সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২১ কোটি ২৪ লাখ ২০৪।

বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি এখন এমএফএস। শহর থেকে গ্রামে বা গ্রাম থেকে শহরে তাৎক্ষণিকভাবে টাকা পাঠানোর সুবিধার পাশাপাশি নতুন নতুন নানা সেবা যোগ করে দেশের সব মানুষের জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এই সেবা।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সেবার ওপর মানুষের নির্ভরতা বাড়ছে। তাইতো বাড়ছে গ্রাহক ও লেনদেনের অঙ্ক।

আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এক পরিবারে ১৫ শতাংশের বেশি শেয়ার নয়, মন্ত্রিসভার সায় পরবর্তী

আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এক পরিবারে ১৫ শতাংশের বেশি শেয়ার নয়, মন্ত্রিসভার সায়

কমেন্ট