বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি দুই বছরে সবচেয়ে কম
চলতি অর্থবছরের তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ। যা দুই বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। ২০২১ সালের অক্টোবরে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ।
দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি কমছেই। অর্থনীতির চলমান সংকটের প্রভাব পড়েছে গুরুত্বপূর্ণ এই সূচকে। উদ্যোক্তারা নতুন বিনিয়োগ বা ব্যবসা সম্প্রসারণে সাবধানি হয়েছেন।
আবার ডলার–সংকটে চলমান ব্যবসাও কমিয়ে এনেছেন কেউ কেউ। এ চিত্রই ফুটে উঠেছে বেসরকারি খাতের ঋণের পরিসংখ্যানে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বুধবার বেসরকারি খাতে ঋণের হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ।
যা দুই বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। ২০২১ সালের অক্টোবরে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ।
২১ মাস পর চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচকের প্রবৃদ্ধি এক অঙ্কের (সিঙ্গেল ডিজিট) ঘরে—৯ দশমিক ৮২ শতাংশে নেমে আসে। আগস্টে তা আরও কমে ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশে নেমে আসে।
সবশেষ সেপ্টেম্বরে আরও খানিকটা কমে ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশে নেমে এসেছে।
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের শেষ মাস জুনে এই প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ৫৭ শতাংশ। অর্থাৎ বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহে ১০ দশমিক ৫৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে গত ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষ হয়েছিল।
২০২২-২৩ অর্থবছরের শেষার্ধের (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরেছিল ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ।
লক্ষ্যের অনেক পেছনে থাকায় গত ১৮ জুনে বাংলাদেশ ব্যাংক ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে, তাতে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরেছে ১১ দশমিক ১০ শতাংশ।
এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, সেপ্টেম্বরে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহে যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তা বাংলাদেশ ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১ দশমিক ৪১ শতাংশীয় পয়েন্ট কম।
বেশ কয়েক মাস ধরে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি কমছেই। দুই বছরের করোনা মহামারীর ধকল কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিল বাংলাদেশের অর্থনীতি। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেশ ভালোই বাড়ছিল বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি।
গত বছরের আগস্টে ১৪ শতাংশ ছাড়িয়ে এই প্রবৃদ্ধি ১৪ দশমিক শূন্য সাত শতাংশে উঠেছিল। এরপর থেকে কমছেই।
মে মাসে এই প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১১ দশমিক ১০ শতাংশ। তার আগের মাস এপ্রিলে ছিল ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ। মার্চে ছিল ১২ দশমিক শূন্য তিন শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ দশমিক ১৪ শতাংশ।
জানুয়ারিতে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১২ দশমিক ৬২ শতাংশ। ডিসেম্বরে ছিল ১২ দশমিক ৮৯ শতাংশ। নভেম্বরে ছিল ১৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ। অক্টোবর, সেপ্টেম্বর ও আগস্টে ছিল যথাক্রমে ১৩ দশমিক ৯১ শতাংশ, ১৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ ও ১৪ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, ২০২১ সালের শেষ মাস ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ৬৮ শতাংশ। তার আগের মাস নভেম্বরে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ১১ শতাংশ; অক্টোবরে ৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ আর সেপ্টেম্বরে হয়েছিল ৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ। আগস্ট ও জুলাইয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল যথাক্রমে ৮ দশমিক ৪২ শতাংশ ও ৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ।
করোনা মহামারীর ধাক্কায় কমতে কমতে ওই বছরের মে মাসে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি একেবারে তলানিতে, ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশে নেমে এসেছিল। এরপর থেকে তা ধারাবাহিকভাবে বেড়ে নভেম্বরে দুই অঙ্কের ঘরে পৌঁছায়।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “এক বছর ধরে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি কমছে। অথচ করোনার মধ্যেও এই ঋণ প্রবৃদ্ধি বাড়ছিল। করোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকার যে প্রণোদনা ঘোষণা করেছিল, তাতে এর অবদান ছিল। এ ছাড়া করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় দেশে বিনিয়োগের একটি অনুকূল পরিবেশও দেখা দিয়েছিল।”
তিনি বলেন, “পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু কর্ণফুলী টানেলসহ কয়েকটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলকে ঘিরে উদ্যোক্তারা নতুন পরিকল্পনা সাজিয়ে বিনিয়োগে নেমেছিলেন। ব্যাংকগুলোও তাতে বিনিয়োগ করছিল। সব মিলিয়ে বেসরকারি খাতের ঋণের একটি গতি এসেছিল।”
“কিন্তু পৌনে দুই বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিয়েছে। ডলার সংকটের কারণে উদ্যোক্তারা মূলধনি যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারি), শিল্পের কাঁচামালসহ প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করতে পারছেন না। অন্যদিকে ডলারের দর অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় আমদানিকারকদের এলসি খুলতে বেশি টাকা লাগছে। তাতে ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেছে।”
“বিশ্ববাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম এবং ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধিতে বেসরকারি খাতের ঋণের বড় অংশ চলে যাচ্ছে আমদানি খাতে। এতে করে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি যেটা হচ্ছে— সেটা মূলত অর্থনীতির বহিঃস্থ খাতের অস্থিরতার কারণে হচ্ছে।”
আহসান মনসুর বলেন, “বিশাল অঙ্কের খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোকে নিরাপত্তা সঞ্চিতি বেশি রাখতে হচ্ছে। সুদের হার কম হওয়ায় আশানুরূপ আমানত পাচ্ছে না। অনেক ব্যাংক তারল্য সংকটে রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন সংকটে দেশে উৎপাদন কমেছে। নির্বাচনী বছরে সবাইকে ঋণ দিতে চাচ্ছে না ব্যাংক, আবার রাজনৈতিক উত্তাপের মধ্যে উদ্যোক্তারা নতুন করে বিনিয়োগে আসতে চাচ্ছে না।”
“সব মিলিয়ে যারা ঋণ নিতে চান, তাদের অনেককে ব্যাংক ঋণ দিতে আগ্রহী নয়। আবার যাদের ঋণ দিতে আগ্রহী ব্যাংক, তারা আপাতত ঋণ নিতে চাচ্ছে না। এসব কারণে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ভাটা পড়েছে।
“ফলে আগামী দিনে উৎপাদন এবং কর্মসংস্থানে বড় নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে সরকার চলতি অর্থবছরেও ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের যে লক্ষ্য ধরেছে— সেটা অর্জন কোনোভাবেই সম্ভব নয়।”
তবে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঠিক কাজটিই করছে মন্তব্য করে দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে (আইএমএফ) গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা এই অর্থনীতিবিদ বলেন, “আমদানি ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরাটা খুবই দরকার ছিল। সেটা সুফল হওয়া গেছে বলে আমি মনে করি। এই কৃচ্ছ্রসাধন আরও কিছুদিন চালাতে হবে। তানাহলে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ আরও কমে যাবে।”
“বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) প্রবৃদ্ধির দিকে না তাকিয়ে এখন মূল্যস্ফীতি সহনীয় রাখার দিকেই সবচেয়ে বেশি নজর দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে আগামী কয়েক মাস যদি বেসরকারি খাত ঋণ কমও পায়, তাতেও খুব একটা সমস্যা হবে না।”
“এখন আমাদের সংকট বা চাপ থেকে বের হয়ে আসার সময়। এ অবস্থায় যদি জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশও হয়, তাও আমি যথেষ্ট বলে মনে করি। কিন্তু মূল্যস্ফীতি যাতে কোনো অবস্থাতেই দুই অঙ্কের ঘর (ডাবল ডিজিট) অতিক্রম না করে বৈদিশিক মুদ্রার রিজার্ভ যাতে আর না কমে-সেটার দিকে সজাগ থাকতে হবে,” বলেন মনসুর।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চতুর্থ মাস অক্টোবরে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে আটকে রাখার লক্ষ্য ধরেছে সরকার। বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে যা কোনোভাবেই সম্ভব নয় বলে আহসান মনসুরসহ দেশের অন্য অর্থনীতিবিদরা বলে আসছেন।
এদিকে রিজার্ভ কমতে কমতে উদ্বেগজনক পর্যায়ে নেমে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য বলছে, গত সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম৬ হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলার। আর ‘গ্রস’হিসাবে ছিল ২৬ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার।
আগামী সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মেয়াদের ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি আমদানি বিল পরিশোধ করতে হবে। হিসাব বলছে, তখন রিজার্ভ আরও কমে ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসবে।
কমেন্ট