চড়া সুদে ঋণ নিচ্ছে সরকার, ১০ বছরে সর্বোচ্চ
আহসান এইচ মনসুর বলেন “সরকার নিজেই যদি ১০ শতাংশের বেশি সুদে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়, তাহলে বেসরকারি খাতের ঋণের সুদও বাড়াতে হবে স্মার্ট পদ্ধতি অনুযায়ী। সেক্ষেত্রে কিছুটা বাড়তি সুবিধা পাবে আমানতকারীরা। কারণ ঋণের সুদ বাড়লে তহবিলের জন্য ব্যাংকগুলো আমানত বাড়াতে চেষ্টা করবে।”
সরকারি ট্রেজারি বিলে দশ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ সুদ উঠেছে। সোমবার ৩৬৪ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলে সর্বোচ্চ সুদ উঠেছে ১০ দশমিক ৬০ শতাংশ। ১৮২ দিন মেয়াদি বিল লেনদেন হয়েছে ১০ দশমিক ৪০ শতাংশ সুদে। ২০১৩ সালের মার্চের পর যা সর্বোচ্চ।
গত বছরের নভেম্বর মাসে ১৮২ দিন মেয়াদি বিলে সুদহার ছিল ৩ দশমিক ৫৬ শতাংশ; ৩৬৪ দিন মেয়াদি বিলে ছিল ৩ দশমিক ৯৪ শতাংশ। সরকারি বিলের সুদহার এভাবে বাড়তে থাকায় গ্রাহক পর্যায়ে সুদ আরও বাড়বে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর।
চলতি বছরের জুলাই থেকে ৯ শতাংশ সুদহারের সীমা তুলে দিয়ে নতুন ব্যবস্থা চালু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বর্তমানে ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের ৬ মাসের গড় সুদের (স্মার্ট) সঙ্গে সাড়ে ৩ শতাংশ হলো সর্বোচ্চ সুদের সীমা। গত অক্টোবর মাসে স্মার্ট ছিল ৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ।
আগের মাসে যা ৭ দশমিক ২০ শতাংশ ছিল। গত জুলাই মাসে ছিল ৭ দশমিক ১০ শতাংশ। ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের গড় সুদ বেড়ে যাওয়ায় স্মার্ট বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালের মার্চে ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদহার ছিল ১০ দশমিক ৬০ শতাংশ। ৩৬৪ দিন মেয়াদি বিলের সুদহার ছিল ১১ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। এর পরের মাসে তা কমে ৯ দশমিক ৯৭ শতাংশ এবং ১০ দশমিক ২২ শতাংশে নেমে আসে।
এরপর আবার বাড়া-কমা হলেও কখনও এর ওপরে ওঠেনি। এরপর ২০১৩ সালের অক্টোবরে ১৮২ দিন মেয়াদি বিলের সুদহার ১০ শতাংশের নিচে তথা ৯ দশমিক ৫৩ শতাংশে নেমে আসে। ওই বছরের ডিসেম্বরে ৩৬৪ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদহার কমে দাঁড়ায় ৯ দশমিক ২৫ শতাংশে। এরপর কোনো মাসে ট্রেজারি বিলের সুদহার দুই অঙ্কের ওপরে ওঠেনি।
কিছুদিন আগেও ট্রেজারি বিলে ৩ থেকে ৫ শতাংশ সুদে লেনদেন হতো। সম্প্রতি বাড়তে বাড়তে এ পর্যায়ে এসেছে।
ব্যাংকাররা জানান, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে এমনিতেই মানুষের সঞ্চয় ক্ষমতা কমেছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য এখন বাংলাদেশ ব্যাংক আর সরাসরি সরকারকে ঋণ দিচ্ছে না। সরকারি ঋণ চাহিদা মেটানো হচ্ছে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে।
একই সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির কারণে বাজার থেকে টাকা উঠে আসছে। সব মিলিয়ে অনেক ব্যাংক এখন তারল্য সংকটে পড়েছে। সংকট কাটাতে নানা উপায়ে ধার দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আবার আন্তঃব্যাংক কলমানি থেকেও টাকা ধার করছে ব্যাংকগুলো।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, সোমবার ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের বিপরীতে ৩০৪ কোটি টাকা নিয়েছে সরকার। ৯ দশমিক ৯৯ থেকে ১০ দশমিক ৪০ শতাংশ সুদে এ তহবিল নেওয়া হয়। একই দিন ৩৬৪ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের বিপরীতে ১০ দশমিক ৩০ থেকে ১০ দশমিক ৬০ শতাংশ সুদে নিয়েছে ৫৮২ কোটি টাকা।
চলতি মাসের শুরুতেও ১৮২ দিন ও ৩৬৪ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিট তথা ১০ শতাংশের নিচে ছিল। চলতি মাসে সরকারি ঋণে সর্বোচ্চ সুদ উঠে গত ১৫ নভেম্বর। ওই দিন পাঁচ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বিলের বিপরীতে ১০ দশমিক ৯৯ শতাংশ পর্যন্ত সুদে সরকার ৮১৪ কোটি টাকা ধার করেছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যাংক খাত যেন বিপদে না পড়ে সে জন্য প্রতিদিনই বাংলাদেশ ব্যাংক বড় অঙ্কের ধার দিচ্ছে। রোববার কয়েকটি ব্যাংকে ধারের পরিমাণ ছিল ১৬ হাজার ৯৪২ কোটি টাকা। আর সোমবার আন্তঃব্যাংক ধারের পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ৩২ কোটি টাকা।
এর মধ্যে কলমানিতে ৮ দশমিক ১০ শতাংশ সুদে তিন হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা ধার করে ব্যাংকগুলো। আন্তঃব্যাংক রেপোসহ বিভিন্ন উপায়ে ধারের সুদ দাঁড়ায় ১০ দশমিক ২৫ শতাংশ।
তবে বর্তমানে ব্যাংকগুলো কিছুটা তারল্যের চাপে থাকায় সরকারকে চড়া সুদে ঋণ নিতে হচ্ছে বলে মনে করেন পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর।
দীর্ঘদিন আইএমএফের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্বপালন করে আসা এই অর্থনীতিবিদ আরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “ব্যাংকগুলো যে সুযোগ নিচ্ছে এমন না। তারাও তারল্যের চাপে আছে। টাকার সরবরাহ কম। এ কারণে সরকারকে বেশি সুদে ঋণ নিতে হচ্ছে ব্যাংক থেকে।”
তিনি বলেন, “সরকার নিজেই যদি ১০ শতাংশের বেশি সুদে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়, তাহলে বেসরকারি খাতের ঋণের সুদও বাড়াতে হবে স্মার্ট পদ্ধতি অনুযায়ী। সেক্ষেত্রে কিছুটা বাড়তি সুবিধা পাবে আমানতকারীরা। কারণ ঋণের সুদ বাড়লে তহবিলের জন্য ব্যাংকগুলো আমানত বাড়াতে চেষ্টা করবে।”
কমেন্ট