বেক্সিমকো ও এস আলমের ঋণ পুনঃতফসিলে খেলাপি ঋণ কমল
গত জুন শেষে ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা। যা সেপ্টেম্বর শেষে কমে হয়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা।
রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের বড় দুই খেলাপি শিল্পগোষ্ঠী তাদের ঋণ নিয়মিত বা পুনঃতফসিল করেছে। এতেই তিন মাসের ব্যবধানে এই ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৩০ শতাংশ থেকে কমে ১৮ শতাংশে নেমেছে।
সব মিলিয়ে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ কমেছে ১১ হাজার ৫৩৭ কোটি টাকা। ঋণ নিয়মিত করা বড় দুই শিল্পগোষ্ঠী হলো বেক্সিমকো গ্রুপ ও এস আলম গ্রুপ।
গত জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে গ্রুপ দুটি মোট ১৩ হাজার ৮৪৯ কোটি টাকা ঋণ পুনঃতফসিল করেছে। আর এতে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ কিছুটা কমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক মঙ্গলবার ব্যাংকিং খাতের প্রধান সমস্যা খেলাপি ঋণসংক্রান্ত হালনাগাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, গত জুন শেষে ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা। যা সেপ্টেম্বর শেষে কমে হয়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা।
এর আগে এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছিল ২৪ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা, যা ছিল ব্যাংক খাতের বিতরণ করা মোট ঋণের ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের হার কমে ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশে নেমেছে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে, তখন দেশে মোট খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি ৪১ লাখ টাকা। এখন তা দেড় লাখ কোটি টাকার ওপরে।
এই হিসাব বলছে, গত ১৪ বছরে খেলাপি ঋণ প্রায় ৭ গুণ বেড়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, জনতা ব্যাংকে গত জুলাই–সেপ্টেম্বর ৩ মাসে খেলাপি ঋণ কমেছে ১১ হাজার ৫৩৭ কোটি টাকা। তবে এই তিন মাসে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বেড়েছে। ফলে আলোচ্য সময়ে পুরো ব্যাংক খাতে সব মিলিয়ে খেলাপি ঋণ কমেছে ৬৪২ কোটি টাকা।
তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ৬৫ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা। জুনে এই অঙ্ক ছিল ১৫ লাখ ৪২ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা।
তবে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরের তুলনায় চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২১ হাজার কোটি টাকা। গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, আগামী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। কোনো ঋণ খেলাপি গ্রাহক এই নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারে না। এ কারণে ব্যবসায়ীদের মধ্যে যারা নির্বাচনে অংশ নিতে চান তাদের অনেকেই খেলাপির হাত থেকে বাঁচতে ঋণ পুনঃতফসিল করতে শুরু করেছেন। যে কারণেও সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কিছুটা কমেছে।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের যে হিসাব দিচ্ছে, তা–ও আবার প্রকৃত তথ্য নয়। কারণ, প্রকৃত খেলাপি ঋণ আরও অনেক বেশি। মামলার কারণে অনেক ঋণকে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। আবার অবলোপন করা (রাইট অফ) ঋণও খেলাপির হিসাবে নেই।
মামলার কারণে আটকে থাকা এবং রাইট অফ করা খেলাপি ঋণ যোগ করলে দেশে প্রকৃত খেলাপি ঋণ চার লাখ কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকবে বলে হিসাব দিয়েছেন অর্থনীতির গবেষক বেসরকারি ব্র্যাক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর।
এদিকে চলতি বছরেই জাতীয় সংসদে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করা হয়েছে। এর ফলে খেলাপিদেরও ঋণ নেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। আগে একটি ব্যবসায়ী গ্রুপের কোনো প্রতিষ্ঠান ঋণখেলাপি হলে তাদের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ পাওয়ার সুযোগ ছিল না।
নতুন আইনে সেই সুযোগ রাখা হয়েছে। ফলে সামনের দিনগুলোয় খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে বলে মনে করেন আহসান মনসুর।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ জুনে ছিল ৭৪ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা; যা সেপ্টেম্বর শেষে কমে হয়েছে ৬৫ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকা।
তবে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ৭৩ হাজার ৬৩৫ কোটি থেকে বেড়ে হয়েছে ৮১ হাজার ৫৩৭ কোটি টাকা।
বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ৪ হাজার ৭৫৩ কোটি থেকে বেড়ে হয়েছে ৪ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা।
এ ছাড়া বিদেশি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ৩ হাজার ১৯৭ কোটি থেকে বেড়ে ৩ হাজার ২৮৬ কোটি টাকায় উঠেছে।
জনতা ব্যাংকের নথিপত্র অনুযায়ী, গত জুন শেষে ব্যাংকটিতে খেলাপি ঋণ ছিল ২৮ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকা, যা সেপ্টেম্বরে কমে হয়েছে ১৭ হাজার ১২৮ কোটি টাকা। ফলে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের হার ৩০ দশমিক ৪৩ শতাংশ থেকে কমে ১৭ দশমিক ৯৯ শতাংশ নেমেছে।
এই ব্যাংকে গত জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে বেক্সিমকো গ্রুপের ৮ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ পুনঃ তফসিল করা হয়েছে। একই সময়ে চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপ পুনঃ তফসিল করেছে ৫ হাজার ২৬৯ কোটি টাকার ঋণ।
এই দুই প্রতিষ্ঠানের ঋণ পুনঃতফসিলের ফলে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ কমেছে ১৩ হাজার ৮৪৯ কোটি টাকা। তবে আরও কিছু নতুন প্রতিষ্ঠান ঋণখেলাপির তালিকায় যোগ হওয়ায় জুলাই-সেপ্টেম্বরে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ কমেছে ১১ হাজার ৫৩৭ কোটি টাকা।
গত জুন শেষে জনতা ব্যাংকে বেক্সিমকো গ্রুপের ঋণ ছিল ২৩ হাজার ২২৮ কোটি টাকা ও এস আলম গ্রুপের ঋণ ছিল ৯ হাজার ৬০৯ কোটি টাকা।
আহসান এইচ মনসুর এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “সামগ্রিক হিসাবে জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে খেলাপি ঋণ যে সামান্য কমেছে, সেটা কিন্তু জনতা ব্যাংকে বড় দুটি গ্রুপের বড় অঙ্কের ঋণ পুনঃতফসিল বা নিয়মিত করার কারণে কমেছে। এর বাইরে সব ব্যাংকেই কিন্তু খেলাপি ঋণ বেড়েছে। তাই এতে খুশি হওয়ার মতো কোনো বিষয় আছে বলে আমি মনে করি না।”
কমেন্ট