ডলারের দর কমা শুধু ঘোষণাতেই, রেমিটেন্সে এখনও ১২২ টাকার বেশি
বৃহস্পতিবার কোনো ক্ষেত্রেই ঘোষিত দরে ডলার লেনদেন হয়নি। উল্টো আগের দিনের (বুধবার) চেয়ে ডলারের দর বেড়েছে। প্রবাসী আয় বারেমিটেন্স আহরণের শীর্ষ দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে বৃহস্পতিবার ১২২ টাকা ২৫ পয়সা পর্যন্ত দরে ডলার কিনেছে ব্যাংকগুলো। আগের দিন সর্বোচ্চ দর ১২২ টাকা ছিল।
ডলারের ঘোষিত দরের প্রভাব নেই বাজারে। বুধবার আমদানি, রপ্তানি ও রেমিটেন্স—সব পর্যায়ে ডলারের দর ৫০ পয়সা করে কমানোর ঘোষণা দেয় বিদেশি মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ (এবিবি)। বৃহস্পতিবার থেকে কার্যকর হওয়ার কথা।
কিন্তু বৃহস্পতিবার কোনো ক্ষেত্রেই ঘোষিত দরে ডলার লেনদেন হয়নি। উল্টো আগের দিনের (বুধবার) চেয়ে ডলারের দর বেড়েছে। প্রবাসী আয় বারেমিটেন্স আহরণের শীর্ষ দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে বৃহস্পতিবার ১২২ টাকা ২৫ পয়সা পর্যন্ত দরে ডলার কিনেছে ব্যাংকগুলো। আগের দিন সর্বোচ্চ দর ১২২ টাকা ছিল।
অথচ ব্যাংকগুলোর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রবাসী আয়ে ডলারের দাম সর্বোচ্চ ১১০ টাকা। এর বাইরে সরকার ও ব্যাংকের আড়াই শতাংশ করে মোট ৫ শতাংশ প্রণোদনাসহ দাম দাঁড়ায় ১১৫ টাকা ৫০ পয়সা।
প্রবাসী আয়ে ডলারের দাম বেশি হওয়ায় আমদানিকারকদের কাছ থেকে আমদানি দায় মেটাতে ডলারের বেশি দাম নিচ্ছে ব্যাংকগুলো। এতে আমদানি খরচ বাড়ছে, যার প্রভাব গিয়ে পড়ছে পণ্যমূল্যের দামে। বর্তমানে আমদানিতে ব্যাংকারদের দুই সংগঠনের নির্ধারিত ডলারের দাম ১১০ টাকা ৫০ পয়সা।
বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যস্থতায় এবিবি এবং বাফেদা ৫০ পয়সা কমিয়ে রেমিটেন্সে ডলারের সর্বোচ্চ দর নির্ধারণ করে ১১০ টাকা। এর মানে, নির্ধারিত দরের চেয়ে ব্যাংকগুলো ১২ টাকা বেশি দর দিচ্ছে।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছে, বাজারে সরবরাহ বাড়ায় দর কমানোর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
ডলার সংকট কাটাতে আমদানি নিয়ন্ত্রণ, এলসিতে শতভাগ পর্যন্ত মার্জিন, দর যাচাইসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ থেকে প্রচুর ডলার বিক্রি করা হচ্ছে।
২০২১ সালের আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ২৬ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমে বুধবার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম৬ হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ১৯ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভ নেমেছে ২৫ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলারে।
বৃহস্পতিবার অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর পাশপাশি রিজার্ভের এই তথ্য প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর থেকে ডলারের দর ঘোষণা করে আসছে বাফেদা এবং এবিবি। প্রথমে রেমিট্যান্সে ১০৮ টাকা এবং রপ্তানিতে ৯৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়। পরবর্তী সময়ে ধাপে ধাপে বাড়িয়ে উভয় ক্ষেত্রে ১১০ টাকা ৫০ পয়সা করা হয়। আর আমদানিতে নির্ধারণ করা হয় ১১১ টাকা।
তবে গত বুধবার প্রতি ডলারে ৫০ পয়সা করে কমানোর ঘোষণা দেয় বাফেদা-এবিবি। মূলত যারা ডলার ধরে রেখেছে, তারা যেন দ্রুত ডলার ছেড়ে দেয়, সেজন্য এই কৌশল নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। যদিও এতে কাজ হচ্ছে না।
বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বাফেদার ডলারের দর কমানোর ঘোষণা ঠিকই আছে। কেননা, বৈদেশিক মুদ্রার দর নির্ধারিত হয় ডলারের চাহিদা ও জোগানের ওপর। ইতোমধ্যে ডলারের সরবরাহ বেড়েছে।
নির্ধারিত দরে ডলার না পাওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “ঘোষিত দরের চেয়ে বেশি দিয়ে ডলার কেনায় ইতোমধ্যে কয়েক দফায় বিভিন্ন ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এখনও এ ধরনের প্রমাণ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
সরবরাহ বাড়ার কারণে রিজার্ভ থেকে আর ডলার বিক্রি করা হবে কিনা জানতে চাইলে মেজবাইল হক বলেন, “কেন্দ্রীয় ব্যাংক জ্বালানি, সারসহ বিভিন্ন সরকারি আমদানির বিপরীতে ডলার বিক্রি করে। যে কারণে এখনও বিক্রি না করার পর্যায়ে আসেনি।”
বেসরকারি কয়েকটি ব্যাংকের রেমিটেন্স বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চাহিদা ও জোগানের মধ্যে বড় ধরনের পার্থক্যের কারণে ডলারের দর কমছে না। বৃহস্পতিবার এক্সচেঞ্জ হাউসভেদে ১২০ থেকে ১২২ টাকা ২৫ পয়সা পর্যন্ত দরে রেমিটেন্স কিনতে হয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের অন্যতম বড় এক্সচেঞ্জ হাউস আল-আনসার থেকে বৃহস্পতিবার ১২২ টাকা ২৫ পয়সায় কিনতে হয়েছে। বাহরাইনসহ কয়েকটি দেশের এক্সচেঞ্জ হাউস থেকে ১২১ টাকা ৫০ পয়সায় ডলার পাওয়া গেছে। আগের দিনও (বুধবার) এ রকমই ছিল।
সম্প্রতি ভোজ্যতেল উৎপাদন ও বাজারজাতকারীদের সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন ট্যারিফ কমিশনে পাঠানো চিঠিতে দর বাড়ানোর প্রস্তাবের কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, বর্তমানে তাদের ১২২ থেকে ১২৪ টাকা দরে ডলার কিনতে হচ্ছে। গত সোমবার বাংলাদেশ ব্যবসার পরিবেশ নিয়ে ফরেন চেম্বার আয়োজিত অনুষ্ঠানে এক ব্যবসায়ী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এখানে ব্যবসার পরিবেশ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। অথচ ডলার সংকটের কারণে এখন এলসি খুলতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাফেদার চেয়ারম্যান ও সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল করিম এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “ডলারের দর কমানোর পরও যদি কোনো ব্যাংক সেটা না মানে—সেটা কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেখবে।“
তিনি বলেন, “রেমিটেন্স বাড়ছে। বাণিজ্য ঘাটতি বেশ কমেছে; চার ভাগের এক ভাবে নেমে এসেছে। বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে (ব্যালান্স অফ পেমেন্ট-বিওপি) ১৮ বিলিয়ন ডলার ঘাটতি থেকে ১ বিলিয়ন ডলারের মতো উদ্বৃত্ত হয়েছে। সব মিলিয়ে ডলারের সরবরাহ বেড়েছে। তাই আমরা ৫০ পয়সা করে কমিয়েছি। এই ধারা অব্যাহত থাকলে পর্যায়ক্রমে আরও কমানো হবে। আশা করছি ডলারের বাজার আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে আসবে।”
“ডলার সংকট কেটে যাচ্ছে, স্বস্তি ফিরছে অর্থনীতিতে, রিজার্ভও বাড়বে,” বলেন আফজাল করিম।
দুই বছরের করোনা মহামারির ধাক্কা সামলে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিল বাংলাদেশের অর্থনীতি। প্রধান সূচকগুলো ইতিবাচক ধারায় ফিরছিল। স্বপ্নের পদ্মা সেতু, মেট্টোরেল, বঙ্গবন্ধু টানেল ও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোকে ঘিরে দেশের উদ্যোক্তারা নতুন করে বিনিয়োগের ছক কষছিলেন।
কিন্তু পৌনে দুই বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সব ওলোটপালট করে দেয়। পাল্টে যাচ্ছে সব হিসাব নিকাশ। বিশ্বের ছোট-বড় সব দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও তছনছ হয়ে যেতে থাকে। পাগলা ঘোড়ার মত ছুঁটতে থাকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলার।
দেড় বছর আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় ‘স্থির’ ছিল ডলারের দর। গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেনে হামলার পর বাড়তে থাকে ডলারের দর; টানা বাড়তে বাড়তে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারেই ১১১ টাকায় উঠে যায়। ব্যাংকগুলো ১১৫/১১৬ টাকায় নগদ ডলার বিক্রি করে; প্রবাসীদের কাছ থেকে রেমিটেন্স সংগ্রহে ১২৪ টাকা পর্যন্ত দেয় ব্যাংকগুলো।
খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেটে প্রতি ডলার ১২৮ টাকায় উঠে যায়।
‘অস্থির’ডলারের বাজার ‘সুস্থির’করতে নানা পরীক্ষা-নিরিক্ষা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছিল না। বেড়েই চলে ডলারের দর; দুর্বল হতে থাকে টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, ২০২১ সালের অক্টোবরে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে টাকা-ডলারের বিনিময় হার ছিল ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা। অর্থাৎ দুই বছর আগে এক ব্যাংক আরেক ব্যাংক থেকে ডলার কিনতে প্রতি ডলারের জন্য ৮৪ টাকা ৮০ খরচ করতে হতো। বৃহস্পতিবার লেগেছে ১১০ টাকা ৫০ পয়সা।
এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এই দুই বছরে ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশের মুদ্রা টাকার মান কমেছে ৩০ দশমিক ৪১ শতাংশ।
দুই বছরের করোনা মহামারীর পর বাড়তি চাহিদা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং হুন্ডি বেড়ে যাওয়ায় ডলারের ব্যাপক সংকটের সৃষ্টি হয়। ডলারের দর হুহু করে বাড়তে থাকে।
কমেন্ট