সুদহার আরও বাড়ল, আমানত ও ঋণের সুদও বাড়বে

সুদহার আরও বাড়ল, আমানত ও ঋণের সুদও বাড়বে

চলতি বছর এ নিয়ে রেপো ও স্পেশাল রেপোর সুদহার চার দফায় ২ শতাংশীয় পয়েন্ট করে বাড়ানো হলো। আর রিভার্স রেপো তথা ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকে টাকা রাখার সুদহার এ দফায় ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর এ ক্ষেত্রে সুদ বাড়ল ১ দশমিক ৭৫ শতাংশীয় পয়েন্ট।

মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে সব ধরনের নীতি সুদহার আরেক দফা বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর ধারের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত রেপো ও স্পেশাল রেপোর সুদহার ৫০ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৭৫ এবং ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ করা হয়েছে।

গত মাসে উভয় ক্ষেত্রে শতাংশীয় ৭৫ পয়েন্ট বাড়ানো হয়। এ নিয়ে চলতি বছর চার দফায় বাড়ল ২ শতাংশীয় পয়েন্ট। গ্রাহক পর্যায়েও সুদহার বাড়াতে স্মার্ট রেটের সঙ্গে মার্জিনের হার সাড়ে ৩ শতাংশ থেকে ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ করা হয়েছে।

সোমবার সন্ধ্যায় রোববার সন্ধ্যায় এক সংবাদ সম্মেলন করে নীতি সুদহার পরিবর্তনের এ সিদ্ধান্ত জানায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পরে সার্কুলারও জারি করা হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সভাকক্ষে সংবাদ সম্মেলনে প্রধান অর্থনীতিবিদ হাবিবুর রহমান এবং নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। চলমান সংকট মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বাইরে তিন অর্থনীতিবিদের সমন্বয়ে গঠিত মুদ্রানীতি কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানান তারা।

নতুন সুদহার কার্যকর হবে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত মেনে চলতি বছরের জুলাই থেকে সুদহারের নতুন ব্যবস্থা চালু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে গত জুন পর্যন্ত সুদহারের সর্বোচ্চ সীমা ছিল ৯ শতাংশ।

নতুন ব্যবস্থা চালুর পর থেকে সুদহার একটু একটু করে বাড়ছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোর ধার নেওয়ার সুদহার বাড়ানো হচ্ছে। চলতি বছর এ নিয়ে রেপো ও স্পেশাল রেপোর সুদহার চার দফায় ২ শতাংশীয় পয়েন্ট করে বাড়ানো হলো। আর রিভার্স রেপো তথা ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকে টাকা রাখার সুদহার এ দফায় ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর এ ক্ষেত্রে সুদ বাড়ল ১ দশমিক ৭৫ শতাংশীয় পয়েন্ট।

সংবাদ সম্মেলনে প্রধান অর্থনীতিবিদ হাবিবুর রহমান বলেন, ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদহার দ্রুত বেড়ে এরই মধ্যে ১০ শতাংশের ওপরে উঠেছে। এতে করে সিক্স মান্থ মুভিং এভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল (স্মার্ট) আরও বাড়বে। একই সঙ্গে স্মার্টের সঙ্গে বিদ্যমান মার্জিনের হার ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ হবে। দুইয়ে মিলে গ্রাহক পর্যায়ে সুদহার ১২ শতাংশের কাছাকাছি উঠতে পারে।

চলতি মাস অক্টোবরে যা ১০ দশমিক ৯৩ শতাংশ রয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদহার বাড়ানোর পাশাপাশি বিনিময় হার বাজারমুখী করার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে বলে জানান তিনি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার নেওয়ার ক্ষেত্রে রেপো ও স্পেশাল রেপোর ব্যবহার হয়। বর্তমানে ব্যাংকগুলো প্রতিদিন গড়ে ১৫ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা ধার নিচ্ছে।

হাবিবুর রহমান বলেন, “চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশের ঘরে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ জন্য সুদহার ও বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা হচ্ছে। এতে করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়তো কিছুটা কম হবে। শুরুতে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য সাড়ে ৭ শতাংশ ধরা হলেও এখন তা সাড়ে ৬ শতাংশের আশপাশে থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।”

“কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার নেওয়ার খরচ বাড়লে স্বাভাবিকভাবে ব্যাংকগুলো আমানত বাড়ানোর ওপর জোর দেবে। এ ক্ষেত্রে আমানতের সুদহার আরও বাড়বে। তখন মানুষ ব্যাংকে বেশি টাকা রাখবে। এভাবে চাহিদা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে। আরেকদিকে সরবরাহ ঠিক রাখতে কৃষি ও সিএমএসএমই উৎপাদন বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।”

নির্বাচনের আগে এভাবে সুদহার বৃদ্ধি ব্যাংক থেকে টাকা বের করা ঠেকাতে পারবে কিনা– এমন প্রশ্নের উত্তরে হাবিবুর রহমান বলেন, “সুদহার বাড়লে স্বাভাবিকভাবে ঋণ নেওয়ার প্রবণতা কমে।”

ফেরত না দেওয়ার উদ্দেশ্যে যারা ঋণ নেন, তাদের কাছে সুদহার কোনো বিষয় নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের ক্ষেত্রে কী করবে– এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “ফেরত না দেওয়ার উদ্দেশ্যে ঋণ না নেওয়ার কোনো সুযোগ ব্যাংকিং সিস্টেমে নেই। কেউ এমন করে থাকলে তার বিরুদ্ধে ব্যাংক ব্যবস্থা নেবে।”

মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির জন্য এত দিন মূলত ডলারের মূল্যবৃদ্ধিকে দায়ী করে আসছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কমানোর চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সুদের হার বাড়লে মানুষ সাধারণত ব্যাংকে আমানত রাখতে উৎসাহিত হন।

গত তিন মাস ধরেই খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশের ওপরে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে, গত অক্টোবর মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ, যা গত ১১ বছর ৯ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। অক্টোবরে সার্বিক মূল্যস্ফীতিও বেড়ে ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক রোববার এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, পুনর্গঠিত মুদ্রানীতি কমিটির প্রথম সভা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সভাপতিত্বে অনলাইনে অনুষ্ঠিত হয়। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর কাজী ছাইদুর রহমান, প্রধান অর্থনীতিবিদ হাবিবুর রহমান, অর্থনীতিবিদ সাদিক আহমেদ, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক বিনায়ক সেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মাসুদা ইয়াসমিন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক এজাজুল ইসলাম অংশ নেন।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সভায় অভ্যন্তরীণ এবং বৈশ্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বর্তমান সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যৎ গতি-প্রকৃতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এ ছাড়া বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি, বিনিময় হার, তারল্য ও সুদহার পরিস্থিতি এবং নীতি সুদহারের গতিবিধি নিয়ে বিশদ পর্যালোচনা হয়েছে।

“ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের গৃহীত পদক্ষেপসমূহ, যেমন নীতি সুদহার বৃদ্ধি, আমানত ও ব্যাংকঋণের সুদহারের সীমা তুলে দিয়ে তা বাজারমুখী করা, টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ প্রদান স্থগিতকরণ, আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণ এবং রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বৃদ্ধির কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারকে বাজারমুখী করা, আমদানি মূল্য যাচাইসহ বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে তদারকি বৃদ্ধি এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ থেকে অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যের আমদানি ব্যয় মেটানোর ব্যবস্থা ইত্যাদি সম্পর্কে কমিটির সদস্যদের অবহিত করে। 

কমিটির সদস্যরা সভায় এসব বিষয়ে তাদের মতামত তুলে ধরেন। বাজারভিত্তিক বিনিময় হার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতে এবং ব্যাংকিং খাতে ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণের সমস্যা মোকাবিলায় বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেওয়ার পক্ষে সভায় গুরুত্বারোপ করা হয়।

এ ছাড়াও বর্তমানে বিরাজমান উচ্চ মূল্যস্ফীতিসহ বিনিময় হার এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ প্রশমনে বাংলাদেশ ব্যাংকের চলমান প্রচেষ্টাকে অব্যাহত রাখার ব্যাপারে সভায় ঐকমত্য পোষণ করা হয়।

সভায় সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গৃহীত নীতি পদক্ষেপ, বিশ্ববাজারের পণ্য মূল্যে নিম্নমুখী ধারা, আসন্ন আমন ধানের ফলন ভালো হওয়ার সম্ভাবনা এবং শীতকালীন ফসল সরবরাহ বৃদ্ধি পেলে আগামী দিনে মূল্যস্ফীতি সহনীয় মাত্রায় নেমে আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়।

আলোচনা ও পর্যালোচনা শেষে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি ডিসেম্বরে ৮ শতাংশে এবং আগামী জুন শেষে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য ঠিক করা হয়। পাশাপাশি বিনিময় হার ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে নীতি সুদহার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

কৃষি ঋণের সুদহার ১০% ছাড়াল পূর্ববর্তী

কৃষি ঋণের সুদহার ১০% ছাড়াল

ডলারের দর কমা শুধু ঘোষণাতেই, রেমিটেন্সে এখনও ১২২ টাকার বেশি পরবর্তী

ডলারের দর কমা শুধু ঘোষণাতেই, রেমিটেন্সে এখনও ১২২ টাকার বেশি

কমেন্ট