ডলারের দাম বাজারের ওপর ছাড়া হবে না: গভর্নর

ডলারের দাম বাজারের ওপর ছাড়া হবে না: গভর্নর

গভর্নর বলেন, “চলতি হিসাবে আগে ঘাটতি থাকলেও ইতিমধ্যে এই হিসাবে উদ্বৃত্ত হয়েছে। মূল সমস্যা এখন আর্থিক হিসাব নিয়ে। এই সমস্যা এসেছে বহিঃস্থ খাত থেকে। বিদেশি বিনিয়োগ ও স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ কমে যাওয়ায় এবং ঋণ পরিশোধ বেড়ে যাওয়ায় এই সমস্যা হয়েছে।

ডলারের দাম বাজারের ওপর ছাড়া হবে না বলে পরিস্কার জানিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।

তিনি বলেছেন, “ডলারের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা হবে না। তবে ডলারের আনুষ্ঠানিক দাম বাজারের প্রকৃত দামের কাছাকাছি রাখার জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে। ডলারের দাম যাতে একটা সীমার মধ্যে ওঠানামা করে, এ জন্য একটা পদ্ধতি বের করতে কাজ চলছে। দেশীয় অর্থনীতিবিদের পাশাপাশি এতে বিদেশি অর্থনীতিবিদদেরও সহায়তা নেওয়া হচ্ছে। আশা করছি, দু-তিন মাসের মধ্যে এই পদ্ধতি চালু করা সম্ভব হবে।”

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) তিন দিনব্যাপী উন্নয়নবিষয়ক সম্মেলনের শেষ দিনে শনিবার অর্থনৈতিক নীতিসংক্রান্ত এক অধিবেশনে গভর্নর এই মন্তব্য করেন।

অধিবেশনটি সঞ্চালনা করেন বিআইডিএসের মহাপরিচালক বিনায়ক সেন। প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম।

গভর্নর বলেন, “চলতি হিসাবে আগে ঘাটতি থাকলেও ইতিমধ্যে এই হিসাবে উদ্বৃত্ত হয়েছে। মূল সমস্যা এখন আর্থিক হিসাব নিয়ে। এই সমস্যা এসেছে বহিঃস্থ খাত থেকে। বিদেশি বিনিয়োগ ও স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ কমে যাওয়ায় এবং ঋণ পরিশোধ বেড়ে যাওয়ায় এই সমস্যা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের শেষ নাগাদ এটা উদ্বৃত্ত হলে ডলারের দামের ওপর চাপ কমে আসবে।”

ডলার সংকট কাটাতে আমদানি নিয়ন্ত্রণ, এলসিতে শতভাগ পর্যন্ত মার্জিন, দর যাচাইসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ থেকে প্রচুর ডলার বিক্রি করা হচ্ছে।

২০২১ সালের আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ২৭ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমে গত বুধবার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম৬ হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ১৯ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘গ্রস’হিসাবে রিজার্ভ নেমেছে ২৪ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর থেকে ডলারের দর ঘোষণা করে আসছে বিদেশি মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ (এবিবি)।

প্রথমে রেমিট্যান্সে ১০৮ টাকা এবং রপ্তানিতে ৯৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়। পরবর্তী সময়ে ধাপে ধাপে বাড়িয়ে উভয় ক্ষেত্রে ১১০ টাকা ৫০ পয়সা করা হয়। আর আমদানিতে নির্ধারণ করা হয় ১১১ টাকা।

তবে সম্প্রতি দুই দফায় ৫০ পয়সা ও ২৫ পয়সা করে প্রতি ডলারে ৭৫ পয়সা কমিয়েছে বাফেদা-এবিবি। মূলত যারা ডলার ধরে রেখেছে, তারা যেন দ্রুত ডলার ছেড়ে দেয়, সেজন্য এই কৌশল নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। যদিও এতে কাজ হচ্ছে না। ব্যাংকগুলো বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে ৭/৮ টাকা বেশি দামে ডলার সংগ্রহ করছে। ঋণপত্র বা এলসি খুলতে একই পরিমাণ টাকা বেশি নিচ্ছে।

প্রায় দুই বছর ধরে ডলারের বাজার অস্থির। দেড় বছর আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় ‘স্থির’ ছিল ডলারের দর। গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেনে হামলার পর বাড়তে থাকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের দর; টানা বাড়তে বাড়তে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারেই ১১১ টাকায় উঠে যায়। এখন অবশ্য কিছুটা কমে ১১০ টাকা ২৫ পয়সায় নেমে এসেছে।

এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, গত দুই বছরে টাকার বিপরীতে ডলারের দর বেড়েছে ৩০ শতাংশের বেশি।

এ পরিস্থিতিতে ‘অস্থির’ ডলারের বাজার ‘সুস্থির’করতে বেশ কিছুদিন ধরেই ডলারের দর বাজারের উপর ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন অর্থনীতিবিদরা। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফও একই কথা বলছিল।

কিন্তু শনিবার গভর্নর ডলারের দাম বাজারের ওপর ছাড়া হবে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন।

বিআইডিএসের অনুষ্ঠানে আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতিতে কাঠামোগত পরিবর্তন আনা হয়েছে। সুদের হার বিবেচনায় নিয়ে মুদ্রানীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। ৫২ বছর পর মুদ্রানীতি কমিটির পরিবর্তন করা হয়েছে। এখন অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ হলো—মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বিনিময় হার ঠিক করা ও খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনা।”

আর্থিক খাত ঠিক করতে সরকারের সায় আছে উল্লেখ করে গভর্নর বলেন, “আমি দেখছি, আর্থিক খাত ঠিক করতে শক্ত রাজনৈতিক অঙ্গীকার আছে। এটা ব্যাংক কোম্পানি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইনে দেখা গেছে। সরকারি ব্যাংক নিয়ন্ত্রণের পূর্ণ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এখন এক পরিবার থেকে সর্বোচ্চ তিনজন পরিচালক হতে পারবেন। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান একীভূত করার ক্ষমতা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে রাজনৈতিক অঙ্গীকারের বহিঃপ্রকাশ দেখতে পাচ্ছি, কোনো ঘাটতি দেখছি না।”

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতার প্রশ্নে গভর্নর বলেন, “জাতীয় সংসদ আমাকে যে ক্ষমতা দিয়েছে, সেটার ব্যবহার আমি করছি কি না, সেটাই বড় বিষয়। যে ক্ষমতা দেওয়া হয়নি, সেটা নিয়ে চিৎকার করে লাভ নেই। আমাকে আইনে যথেষ্ট স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়েছে। এটা প্রয়োগ করছি কি না, সেটা পর্যালোচনা করা যেতে পারে।”

আর্থিক খাতের সমস্যা নিয়েও কথা বলেন আব্দুর রউফ তালুকদার। বলেন, “আর্থিক খাতে যেসব ইস্যু আছে, সেগুলোর মধ্যে সুশাসন একটি বড় সমস্যা। পাশাপাশি বড় সমস্যা খেলাপি ঋণ ও অপর্যাপ্ত মূলধন।”

“খেলাপি ঋণ তৈরি হয় সুশাসন না থাকায়। এ ছাড়া পুরোনো ঋণ টেনে আনা হচ্ছে। রাষ্ট্র খাতের ব্যাংক কিছু সরকারি সেবা দিতে গিয়ে ঝুঁকিতে পড়েছে। এর সঙ্গে তৈরি হয়েছে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার সংস্কৃতি। ফলে ঋণ খেলাপি হচ্ছে। বছরের পর বছর নানা ছাড় দেওয়া হলেও খেলাপি ঋণ শুধু বাড়ছে। এখন মনে হচ্ছে—এসব ছাড় কোনো কাজে আসেনি। এখন শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে।”

খেলাপি ঋণ কমাতে শিগগির রোডম্যাপ ঘোষণা করা হবে বলে অনুষ্ঠানে ঘোষণা দেন গভর্নর।

তিনি বলেন, “ঋণের সুদহারকে বাজারের সঙ্গে সম্পর্কিত করা হয়েছে। সুদের হার গত পাঁচ মাসে আড়াই শতাংশ বেড়েছে। এর ফলে আমানতের সুদহার বেড়েছে। এতে ৫ মাসে বাজার থেকে ৪৫ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকে চলে এসেছে।”

“গত আগস্ট থেকে টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দেওয়া হচ্ছে না। নীতি সুদহার ধারাবাহিক বাড়ানো হয়েছে। ঋণের সুদ ৯ শতাংশ থেকে সাড়ে ১১ শতাংশ হয়েছে। ব্যাংকগুলো এখন সতর্কতার সঙ্গে ঋণ দিচ্ছে। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোকে বলা হয়েছে, আগের মতো আর নীতি ছাড় দেওয়া হবে না।”

‘মূল্যস্ফীতির পেছনে অর্থনীতির পাশাপাশি অ-অর্থনৈতিক বিষয়ও আছে’ মন্তব্য করে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, “প্রতিদিন বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ থেকে সাত-আট কোটি ডলার বিক্রি করা হচ্ছে। এতে ৭০০-৮০০ কোটি টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে চলে আসছে। সুদের হার বাড়ানো ও টাকা ছাপানো বন্ধের মাধ্যমে টাকাকে ইতিমধ্যে মূল্যবান করা হয়েছে।”

“এর প্রভাব আমরা মূল্যস্ফীতি কমে যাওয়ার ক্ষেত্রে দেখেছি। এই হার আরও কমবে। মূল্যস্ফীতি ডিসেম্বরে ৮ শতাংশের ঘরে ও আগামী বছরের জুনে ৬ শতাংশের নিচে নেমে আসবে,” বলেন রউফ তালুকদার।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হালনাগাদ যে তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের পঞ্চম মাস নভেম্বরে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসভিত্তিক বা মাসওয়ারি) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ। এর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ।

আগের মাস অক্টোবরে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ; খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। খাদ্যবহির্ভূত ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ।

সেপ্টেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয় ৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ। আগস্টে হয়েছিল ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ।

ব্যাংক ঋণের সুদহার সাড়ে ১১ শতাংশে উঠল পরবর্তী

ব্যাংক ঋণের সুদহার সাড়ে ১১ শতাংশে উঠল

কমেন্ট