অক্টোবরে মোবাইলে ১ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকা লেনদেন
একক মাসের হিসাবে এই লেনদেন তৃতীয় সর্বোচ্চ। আর চার মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। অক্টোবরে দৈনিক গড় লেনদেন হয়েছে ৪ হাজার ১৯ কোটি টাকা।
বিশ্বজুড়ে মোবাইলে আর্থিক লেনদেনের পরিমাণ বাড়ছে। বৈশ্বিক সংস্থা জিএসএমএর প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে দিনে ৩০০ কোটি ডলারের লেনদেন হলেও গত বছর সেটি বেড়ে ৩৪৫ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। ২০২২ সালে বিশ্বে মোবাইলে অর্থ লেনদেন হয়েছে ১ লাখ ২৬ হাজার কোটি ডলারের।
বাংলাদেশেও মোবাইলে আর্থিক সেবা বা এমএফএস ব্যবহার প্রত্যাশার চেয়েও দ্রুতগতিতে বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, গত অক্টোবর মাসে দেশে মোবাইল ফোনে এক লাখ ২০ হাজার ৫৯৬ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে।
একক মাসের হিসাবে এই লেনদেন তৃতীয় সর্বোচ্চ। আর চার মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। অক্টোবরে দৈনিক গড় লেনদেন হয়েছে ৪ হাজার ১৯ কোটি টাকা।
আগের মাস সেপ্টেম্বরে মাসে মোবাইল ফোনে এক লাখ ৮ হাজার ৩৭৮ কোটি ২৩ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে। দৈনিক গড় লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৬১৩ কোটি টাকা।
আগস্টে লেনদেনের অঙ্ক ছিল এক লাখ ৯ হাজার ৫৫৫ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। দৈনিক গড় লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৬৫২ কোটি টাকা।
অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গত জুন মাসে মোবাইলের মাধ্যমে ১ লাখ ৩২ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা লেনদেন হয়। দৈনিক গড় লেনদেনের অঙ্ক ৪ হাজার ৪০৫ কোটি টাকা।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লেনদেন হয় এপ্রিল মাসে—এক লাখ ২৪ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা।
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের শেষ চার মাসেই (মার্চ, এপ্রিল, মে ও জুন) মোবাইলে লাখ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়েছিল। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রথম মাস জুলাইয়ে তা কমে লাখ কোটি টাকার নিচে—৯৮ হাজার ৩০৬ কোটি টাকায় নেমে আসে।
জিএসএমএ’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে ব্যাংকিং সেবার বাইরে থাকা জনগোষ্ঠী, বিশেষত নারীদের আর্থিক খাতে অন্তর্ভুক্তির জন্য মোবাইলে আর্থিক সেবা বড় ভূমিকা রাখতে পারে। তাদের মধ্যে পরিবর্তন আনা ও ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রেও অবদান রাখতে পারে।
বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে জিএসএমএ প্রতিবছর এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
বাংলাদেশেও গত এক দশকে এমএফএস জনপ্রিয় হয়েছে। অক্টোবর মাসে এমএফএসে সব মিলিয়ে গ্রাহকের সংখ্যা ছিল ২১ কোটি ৭৭ লাখ ১০ হাজার ৮৩০। তবে সক্রিয় গ্রাহক আট কোটির কিছু বেশি।
সেপ্টেম্বরে মাসে গ্রাহক সংখ্যা ছিল ২১ কোটি ৫০ লাখ ৪১ হাজার ৭৪৬। আগস্টে এই সংখ্যা ছিল ২১ কোটি ২৪ লাখ ২০ হাজার ৪৭৬।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, গত জানুয়ারিতে এমএফএসের মাধ্যমে লেনদেন হয় ১ লাখ ৫৯৩ কোটি টাকা। ২০২২ সালের শেষ মাস ডিসেম্বরে লেনদেনের অঙ্ক ছিল ৯৬ হাজার ১৩২ কোটি টাকা।
২০১৮ সালের ডিসেম্বরে মোবাইলে লেনদেন হয়েছিল ৩২ হাজার ১১৬ কোটি টাকা। প্রতিদিনের গড় লেনদেন ছিল ১ হাজার ৭০ কোটি টাকা। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, পাঁচ বছরের ব্যবধানে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে লেনদেন বেড়েছে প্রায় চার গুণ।
লেনদেনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে গ্রাকহ সংখ্যা। পাঁচ বছর আগে মোট গ্রাহক সংখ্যা ছিল ৬ কোটি ৭৬ লাখ ৭০ হাজার ৪৬৮। অক্টোবরে সেই গ্রাহক প্রায় তিন গুণ বেড়ে প্রায় ২২ কোটি ছুঁয়েছে।
এভাবেই ব্যাংকিং সেবায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে মোবাইল ব্যাংকিং। কেবল টাকা পাঠানোই নয়, দেশের অর্থনীতিতে প্রতি মুহূর্তে গতি সঞ্চার করে চলেছে মোবাইল ব্যাংকিং। বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানির বিল অর্থাৎ সেবামূল্য পরিশোধ, বেতন-ভাতা প্রদান, বিদেশ থেকে টাকা পাঠানো অর্থাৎ প্রবাসী-আয় বা রেমিটেন্স পাঠানোর ক্ষেত্রে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা এখন অন্যতম পছন্দের মাধ্যম।
প্রতিদিন নতুন নতুন সেবা যোগ হচ্ছে। এই সেবার হাত ধরেই দেশে আসছে ‘ডিজিটাল ব্যাংক’। দেশের সবচেয়ে বড় মোবাইল আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান বিকাশ ও ডাক বিভাগের মোবাইল সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান নগদ ‘ডিজিটাল ব্যাংক’প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে।
এছাড়া প্রায় সব ব্যাংকও ‘ডিজিটাল ব্যাংক’নিয়ে আসার ঘোষণা দিয়েছে।
বাংলাদেশে মোবাইলের মাধ্যমে আর্থিক সেবার যাত্রা শুরু হয় ২০১১ সালের ৩১ মার্চ। বেসরকারি খাতের ডাচ্-বাংলা ব্যাংক প্রথম এ সেবা চালু করে। পরে এটির নাম বদলে হয় রকেট। এরপর ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে এমএফএস সেবা চালু করে বিকাশ।
পরবর্তী সময়ে আরও অনেক ব্যাংক এ সেবায় এসেছে। তবে খুব সুবিধা করতে পারেনি। বর্তমানে বিকাশ, রকেটের পাশাপাশি মাই ক্যাশ, এম ক্যাশ, উপায়, শিওর ক্যাশসহ ১৫টি ব্যাংক এ সেবা দিচ্ছে। এর বাইরে ডাক বিভাগের সেবা নগদও দিচ্ছে এই সেবা।
এখন মোবাইল ব্যাংকিং শুধু টাকা পাঠানোর মাধ্যম না। এর ব্যবহার হচ্ছে সব ধরনের লেনদেনে। বিশেষ করে পরিষেবা বিল পরিশোধ, স্কুলের বেতন, কেনাকাটা, সরকারি ভাতা, টিকিট ক্রয়, বিমার প্রিমিয়াম পরিশোধ, মোবাইল রিচার্জ ও অনুদান প্রদানের অন্যতম মাধ্যম।
আর মোবাইল ব্যাংকিংয়ে টাকা জমা করতে এখন আর এজেন্টদের কাছেও যেতে হচ্ছে না। ব্যাংক বা কার্ড থেকে সহজেই টাকা আনা যাচ্ছে এসব হিসাবে। আবার এসব হিসাব থেকে ব্যাংকেও টাকা জমা শুরু হয়েছে, ক্রেডিট কার্ড বা সঞ্চয়ী আমানতের কিস্তিও জমা দেয়া যাচ্ছে। এর ফলে একটি মুঠোফোনই যেন একেকজনের কাছে নিজের ব্যাংক হয়ে উঠেছে।
এমএফএস লেনদেন বাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে দেশের সবচেয়ে বড় মোবাইল আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ‘বিকাশ’-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কামাল কাদীর এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে এবং আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী মোবাইল আর্থিক সেবা দেশের মানুষের দৈনন্দিন আর্থিক লেনদেনকে প্রযুক্তিনির্ভর করে সহজ, নিরাপদ এবং তাৎক্ষণিক করেছে।”
“সামগ্রিক অর্থনীতি ও জীবনযাত্রার মানের ওপর যার ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে। আগামীর স্মার্ট বাংলাদেশে ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল ইকোসিস্টেম শক্তিশালী করার মাধ্যমে ক্যাশলেস সমাজ নির্মাণেও এই খাত ভূমিকা রাখবে,” বলেন বিকাশ প্রধান।
বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি এখন এমএফএস। শহর থেকে গ্রামে বা গ্রাম থেকে শহরে তাৎক্ষণিকভাবে টাকা পাঠানোর সুবিধার পাশাপাশি নতুন নতুন নানা সেবা যোগ করে দেশের সব মানুষের জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এই সেবা।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সেবার ওপর মানুষের নির্ভরতা বাড়ছে। তাইতো বাড়ছে গ্রাহক ও লেনদেনের অঙ্ক।
কমেন্ট