১৫ বছরে ব্যাংক থেকে ৯২ হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে: সিপিডি

১৫ বছরে ব্যাংক থেকে ৯২ হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে: সিপিডি

সিপিডি বলছে, সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে ২৪টি ছোট-বড় অনিয়মের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে এসব অর্থ বের করে নেওয়া হয়েছে।

১৫ বছরে ব্যাংক খাত থেকে অনিয়মের মাধ্যমে ৯২ হাজার কোটি টাকার বেশি লুটপাট করা হয়েছে বলে এক তথ্য দিয়েছে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।

দেশের মূলধারার বিভিন্ন গণমাধ্যমে ব্যাংক খাতের অনিয়ম নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে এ তথ্য তুলে ধরেছে সংস্থাটি।

শনিবার সিপিডি আয়োজিত অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা পর্যালোচনাবিষয়ক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ২০০৮ থেকে ২০২৩—এ ১৫ বছরে ব্যাংক খাত থেকে অনিয়মের মাধ্যমে ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে। ব্যাংক খাত থেকে অনিয়মের মাধ্যমে বের করে নেওয়া এ অর্থ চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের ১২ শতাংশের বেশি। ফলে এ অর্থে অনায়াসে বাজেট ঘাটতি মেটানো সম্ভব হতো।

সিপিডি বলছে, সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে ২৪টি ছোট-বড় অনিয়মের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে এসব অর্থ বের করে নেওয়া হয়েছে।

রাজধানীর ধানমন্ডিতে সিপিডি অফিসে আয়োজিত অর্থনীতির চলমান সংকট ও করণীয়–বিষয়ক ব্রিফিংয়ের অর্থনীতির বিভিন্ন খাতের চিত্র তুলে ধরেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। আর সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান, গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান প্রমুখ।

ফাহমিদা খাতুন বলেন, ২০০৮ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে ব্যাংক খাতের সূচকগুলোর অবনমন হচ্ছে। খেলাপি ঋণের পাশাপাশি অন্যান্য সূচকে অবস্থার অবনতি হচ্ছে। গত ১৫ বছরের ব্যাংক থেকে যে অর্থ বের করে নেওয়া হয়েছে, তা বর্তমান মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ।

এক সাংবাদিক জানতে চান, ব্যাংক থেকে যে অর্থ লুট করা হয়েছে, তার কতটা অর্থনীতিতে যুক্ত হয়েছে, আর কতটা পাচার হয়েছে? জবাবে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক বলেন, “এ বিষয়ে আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক এসব বিষয়ে কোনো তথ্য প্রকাশও করে না। তবে ধারণা করা যায়, এ অর্থের একটি অংশ পাচার হয়েছে, কিছু অংশ হয়তো অর্থনীতিতে যুক্ত হয়েছে।”

‘বর্তমানে ব্যাংক খাত বৈকল্য অবস্থায় রয়েছে’ মন্তব্য করে সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, বলেন, “অর্থনীতি ক্রমে ভঙ্গুর থেকে ভঙ্গুরতা হচ্ছে। অর্থনীতির চার খাতের মধ্যে ব্যাংক খাত বৈকল্য দশায় পড়েছে। মূল্যস্ফীতির পাগলা ঘোড়ার ছুটে চলা অব্যাহত রয়েছে, বহিঃখাত পঙ্গুত্বের ভেতরে পড়ছে আর শ্রম খাতে অন্ধত্ব বা স্থবিরতা বিরাজ করছে।”

সিপিডি বলছে, দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি এখন বড় ধরনের চাপ বা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। অতীতে অর্থনীতিতে এত ধরনের চাপ কখনো তৈরি হয়নি। রাজনৈতিক নেতৃত্বের সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা। এ জন্য বড় ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক সংস্থার দরকার। এ ধরনের সংস্কারের জন্য যে রাজনৈতিক ও নির্বাচনব্যবস্থা দরকার, সেটি দেখা যাচ্ছে না। ফলে নির্বাচনের পরও অর্থনীতিতে কোনো সংস্কার হবে কি না, এটি প্রশ্নসাপেক্ষ।

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, “দেশের ব্যাংক খাত এখন ব্যক্তিস্বার্থের হাতে কুক্ষিগত হয়ে গেছে। এ কারণে এই খাতে সংকট আরও বাড়ছে। যারা এ খাত থেকে বড় বড় ঋণ নিচ্ছে, তারাই আবার ঋণ পুনঃ তফসিলের নানা নিয়মকানুন তৈরিতে প্রভাব বিস্তার করছে। শুধু ব্যাংক খাত নয়, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এখন স্বার্থান্বেষী মহলের হাতে জিম্মি।”

“ফলে এসব খাতে কতটা সংস্থার করা যাবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।”

সংস্থাটির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “উচ্চ মূল্যস্ফীতি কারণে দেশে বৈষম্য আরও প্রকট হচ্ছে। এতে আমরা আবারও এক দেশে দুই অর্থনীতির পথে চলে যাচ্ছি। অথচ দুই অর্থনীতির বিরুদ্ধেই বঙ্গবন্ধু লড়াই-সংগ্রাম করে গেছেন। যার হাত ধরে দেশের স্বাধীনতা এসেছে।”

“কিন্তু এখন সম্পদের বণ্টনব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে আবারও দুই সমাজ বা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠছে। এ ব্যবস্থা রোধ করতে হলে সম্পদ বণ্টনের ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে হবে।”

কোন ব্যাংকে কত টাকা লোপাট

>> সিপিডির তথ্য অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালি ব্যাংক থেকে হলমার্ক গ্রুপ নিয়ে গেছে ৪ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা।

>> জনতা, প্রাইম, যমুনা, শাহজালাল ও প্রিমিয়ার ব্যাংক থেকে বিসমিল্লাহ গ্রুপ নিয়ে গেছে ১ হাজার ১৭৪ কোটি ৪৬ লাখ টাকা।

>> বেসিক ব্যাংক থেকে ২০১৫ সালে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার ঋণ নেওয়া হয় জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এ ঘটনায় ৬০টি মামলা করেছে ১২০ জনের বিরুদ্ধে।

>> এননটেক্স জালিয়াতির মাধ্যমে জনতা ব্যাংক থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়েছে। এই অর্থ ব্যাংকটির মোট মূলধনের ২৫ শতাংশ।

>> ২০১৬ সালে থার্মেক্স গ্রুপ এলসি জালিয়াতির মাধ্যমে জনতা ব্যাংক থেকে ৮১৬ কোটি টাকা ঋণ নেয়, যদিও জনতা ব্যাংকে ওই কোম্পানির ঋণ সীমা ছিল ২৬৪ কোটি টাকা।

>> জনতা ব্যাংক থেকে ২০২০ সালে ঋণ সীমা লঙ্ঘন করে এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ ১ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা এবং ২০২৩ সালে গ্লোবাল ট্রেডিং ১ হাজার ৭০ কোটি টাকা ঋণ নেয়।

>> এবি ব্যাংকে ১৬৫ কোটি টাকার মানিলন্ডারিংয়ের ঘটনায় ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ও কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ত করে দুদক মামলা করেছে।

>> গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক পিকে হালদার ২০২১ সালে ৩ হাজার কোটি টাকার ঋণ অনিয়ম করেন। এ ঘটনায় দুদক ৩৭টি মামলা করেছে তার বিরুদ্ধে।

>> এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকে ২০১৬ সালে ৭০১ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয় অনিয়মের মাধ্যমে।

>> ইসলামী ব্যাংক থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে এস আলম গ্রুপ বেনামি কোম্পানির মাধ্যমে। এ বিষয়ে ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে ঋণ অনিয়মের অনুসন্ধানের জন্য উচ্চ আদালতে পিটিশন দাখিল করেন এক আইনজীবী।

>> ইসলামী ব্যাংকে ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে অপরিচিত নয়টি কোম্পানিকে নিয়ম লঙ্ঘন করে ৭ হাজার ২৪৬ কোটি টাকার ‍দেওয়া হয়। মিথ্যা তথ্যে রাজশাহীর নাবিল গ্রুপের বিভিন্ন কোম্পানিকে এই ঋণ দেওয়া হয়।

>> এছাড়া ভুয়া কোম্পানিকে ২ হাজার ৩২০ কোটি টাকার ঋণ দেয় সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক।

অনিয়ম-খেলাপির প্রধান এই ঘটনাগুলোর বাইরেও অনেক ঋণ খেলাপির ঘটনা রয়েছে।

ভোটের ডামাডোলে চড়ছে কল মানি রেট পরবর্তী

ভোটের ডামাডোলে চড়ছে কল মানি রেট

কমেন্ট