বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে ফের এক অঙ্কের ঘরে

বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে ফের এক অঙ্কের ঘরে

ব্যাংকপাড়া হিসেবে পরিচিত মতিঝিলের শাপলা চত্বর। ফাইল ছবি

দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি কমে ফের এক অঙ্কের (সিঙ্গেল ডিজিট) ঘরে নেমে এসেছে। অর্থনীতির চলমান সংকটের প্রভাব পড়েছে গুরুত্বপূর্ণ এই সূচকে। উদ্যোক্তারা নতুন বিনিয়োগ বা ব্যবসা সম্প্রসারণে সাবধানি হয়েছেন।

আবার ডলার–সংকটে চলমান ব্যবসাও কমিয়ে এনেছেন কেউ কেউ। এ চিত্রই ফুটে উঠেছে বেসরকারি খাতের ঋণের পরিসংখ্যানে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সোমবার বেসরকারি খাতে ঋণের হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের পঞ্চম মাস নভেম্বরে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ৯০ শতাংশ।

আগের মাস অক্টোবরে এই প্রবৃদ্ধি হয়েছিল দুই অঙ্কের (ডাবল ডিজিট) ঘরে–১০ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ।

গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের শেষ মাস জুনে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ৫৭ শতাংশ। অর্থাৎ ১০ দশমিক ৫৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষ হয়েছিল।

২১ মাস পর ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচকের প্রবৃদ্ধি এক অঙ্কের (সিঙ্গেল ডিজিট) ঘরে—৯ দশমিক ৮৯ শতাংশে নেমে আসে। আগস্টে তা আরও কমে ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশে নেমে আসে। সেপ্টেম্বরে আরও খানিকটা কমে ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশে নেমে আসে।

পরের মাস অক্টোবরে এই সূচক বেড়ে দুই অঙ্কের (ডাবল ডিজিট) ঘরে–১০ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশে ওঠে। সবশেষ নভেম্বরে তা ফের এক অঙ্কের ঘরে—৯ দশমিক ৯০ শতাংশে নেমে এসেছে।

২০২২-২৩ অর্থবছরের শেষার্ধের (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরেছিল ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ।

লক্ষ্যের অনেক পেছনে থাকায় গত ১৮ জুন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছিল, তাতে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরেছিল ১১ দশমিক ১০ শতাংশ।

এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, নভেম্বর মাসে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহে যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তা বাংলাদেশ ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১ দশমিক ২ শতাংশীয় পয়েন্ট কম।

বেশ কয়েক মাস ধরে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহে মন্থরগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দুই বছরের করোনা মহামারীর ধকল কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিল বাংলাদেশের অর্থনীতি। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেশ ভালোই বাড়ছিল বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি।

২০২২ সালের আগস্টে ১৪ শতাংশ ছাড়িয়ে এই প্রবৃদ্ধি ১৪ দশমিক শূন্য সাত শতাংশে উঠেছিল। এরপর থেকে কমছেই।

২০২৩ সালের মে মাসে এই প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১১ দশমিক ১০ শতাংশ। তার আগের মাস এপ্রিলে ছিল ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ। মার্চে ছিল ১২ দশমিক শূন্য তিন শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ দশমিক ১৪ শতাংশ।

জানুয়ারিতে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১২ দশমিক ৬২ শতাংশ।

২০২২ সালের ডিসেম্বরে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ দশমিক ৮৯ শতাংশ। নভেম্বরে ছিল ১৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ। অক্টোবর, সেপ্টেম্বর ও আগস্টে ছিল যথাক্রমে ১৩ দশমিক ৯১ শতাংশ, ১৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ ও ১৪ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, ২০২১ সালের শেষ মাস ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ৬৮ শতাংশ। তার আগের মাস নভেম্বরে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ১১ শতাংশ; অক্টোবরে ৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ আর সেপ্টেম্বরে হয়েছিল ৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ। আগস্ট ও জুলাইয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল যথাক্রমে ৮ দশমিক ৪২ শতাংশ ও ৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ।

করোনা মহামারীর ধাক্কায় কমতে কমতে ওই বছরের মে মাসে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি একেবারে তলানিতে, ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশে নেমে এসেছিল। এরপর থেকে তা ধারাবাহিকভাবে বেড়ে নভেম্বরে দুই অঙ্কের ঘরে পৌঁছায়।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “মূলত দুটি কারণে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমেছে। এর একটি হচ্ছে— ব্যাংকগুলোতে আমানতের প্রবৃদ্ধি ক্রমান্বয়ে কমছে এবং এর ফলে ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে ভুগছে। আর আরেকটি কারণ হলো— বেসরকারি ব্যাংক থেকে সরকারি ঋণ নেওয়া, যা বেসরকারি খাতে সরাসরি প্রভাব ফেলেছে।"

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম মাস মাসে অর্থাৎ জুলাই-নভেম্বর সময়ে তফসিলি ব্যাংকগুলো থেকে ৩১ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে সরকার। অথচ গত অর্থবছরের (২০২২-২৩) এই সময়ে সরকার ২৭ হাজার ৬৩৫ কোটি টাকা পরিশোধ করেছিল।

আহসান মনসুর বলেন, “এক বছর ধরে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি কমছে। অথচ করোনার মধ্যেও এই ঋণ প্রবৃদ্ধি বাড়ছিল। করোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকার যে প্রণোদনা ঘোষণা করেছিল, তাতে এর অবদান ছিল। এ ছাড়া করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় দেশে বিনিয়োগের একটি অনুকূল পরিবেশও দেখা দিয়েছিল।”

তিনি বলেন, “পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু কর্ণফুলী টানেলসহ কয়েকটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলকে ঘিরে উদ্যোক্তারা নতুন পরিকল্পনা সাজিয়ে বিনিয়োগে নেমেছিলেন। ব্যাংকগুলোও তাতে বিনিয়োগ করছিল। সব মিলিয়ে বেসরকারি খাতের ঋণের একটি গতি এসেছিল।”

“কিন্তু প্রায় দুই বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিয়েছে। ডলার সংকটের কারণে উদ্যোক্তারা মূলধনি যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারি), শিল্পের কাঁচামালসহ প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করতে পারছেন না। অন্যদিকে ডলারের দর অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় আমদানিকারকদের এলসি খুলতে বেশি টাকা লাগছে। তাতে ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেছে।”

“বিশ্ববাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম এবং ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধিতে বেসরকারি খাতের ঋণের বড় অংশ চলে যাচ্ছে আমদানি খাতে। এতে করে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি যেটা হচ্ছে— সেটা মূলত অর্থনীতির বহিঃস্থ খাতের অস্থিরতার কারণে হচ্ছে।”

আহসান মনসুর বলেন, “বিশাল অঙ্কের খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোকে নিরাপত্তা সঞ্চিতি বেশি রাখতে হচ্ছে। আশানুরূপ আমানত পাচ্ছে না। অনেক ব্যাংক তারল্য সংকটে রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন সংকটে দেশে উৎপাদন কমেছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে সবাইকে ঋণ দেয়নি ব্যাংক; আবার রাজনৈতিক উত্তাপের মধ্যে উদ্যোক্তারা নতুন করে বিনিয়োগে আসতে চাচ্ছে না।”

“সব মিলিয়ে যারা ঋণ নিতে চান, তাদের অনেককে ব্যাংক ঋণ দিতে আগ্রহী নয়। আবার যাদের ঋণ দিতে আগ্রহী ব্যাংক, তারা আপাতত ঋণ নিতে চাচ্ছে না। এসব কারণে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ভাটা পড়েছে।

“ফলে আগামী দিনে উৎপাদন এবং কর্মসংস্থানে বড় নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে সরকার চলতি অর্থবছরেও ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের যে লক্ষ্য ধরেছে— সেটা অর্জন কোনোভাবেই সম্ভব নয়,” দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা আহসান মনসুর।

৬ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স ডিসেম্বরে পূর্ববর্তী

৬ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স ডিসেম্বরে

ভোটের দিন ব্যাংক-পুঁজিবাজার বন্ধ পরবর্তী

ভোটের দিন ব্যাংক-পুঁজিবাজার বন্ধ

কমেন্ট