খেলাপি ঋণ ৮ শতাংশে নামাতে ‘রোডম্যাপ’ ঘোষণা
২০২৬ সালের জুনের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে খেলাপি ঋণ কমিয়ে ১০ শতাংশ ও বেসরকারি খাতে ৫ শতাংশে নামানোর লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে।
ব্যাংকিং খাতে প্রধান সমস্যা খেলাপি ঋণের হার ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে ৮ শতাংশে নামিয়ে আনতে ১৭ দফার রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এই সময়ের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে খেলাপি ঋণ কমিয়ে ১০ শতাংশ ও বেসরকারি খাতে ৫ শতাংশে নামানোর লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে।
ব্যাংকিং খাতে করপোরেট সুশাসন নিশ্চিত করার মাধ্যমে সীমাতিরিক্ত, বেনামি স্বার্থ সংশ্লিষ্ট এবং জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে ঋণ বিতরণ শূন্যে নামিয়ে আনার কথাও বলা হয়েছে।
রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে ‘রোডম্যাপের’ বিভিন্ন দিক নির্ধারণ করা হয়। উদ্দেশ্য অর্জন করতে পুরনোর পাশাপাশি নতুন কিছু সিদ্ধান্তও স্থান পায় এতে।
ঋণ অবলোপন করার সময় কামিয়ে আনা, আদায় বাড়াতে বিশেষ ভাতা দেওয়া, ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিভিন্ন সুবিধা নিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার মতো সিদ্ধান্তও হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনে ডেপুটি গভর্নর আবু ফরাহ মো. নাছের বলেন, “গত তিন বছরের শ্রেণিকৃত (খেলাপি) হওয়া ঋণের গতি প্রকৃতি আমরা বিশ্লেষণ করেছি। খেলাপি ঋণের গতি যে দিকে যাচ্ছে-তা দেখে আমরা মনে করছি তা ৮ শতাংশে নামিয়ে আনা যাবে।”
ব্যাংকিং খাতের বেনামি ঋণ কীভাবে শনাক্ত ও এর সমাধান কীভাবে হবে- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘‘ব্যাংকিং খাতে বেনামি স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ঋণ আছে তা আমরাও স্বীকার করি। এর পরিমাণ কত, তার তথ্য নেই। রোডম্যাপ বাস্তবায়নের সময়ে আমরা অনেক তথ্যই পাব।”
ব্যাংকের পরিচালকরা অন্য ব্যাংক থেকে প্রভাব খাটিয়ে ঋণ নিচ্ছে এবং এসব ঋণের জামানত পর্যাপ্ত নেই। আবার ঝুঁকিপূর্ণ এসব ঋণের একটি অংশ বেনামি।
সেসব ঋণের পরিণতি বিষয়ে আরেক প্রশ্নে আবু ফরাহ বলেন, “বিভিন্ন ব্যাংক থেকে পরিচালকদের নেওয়া ঋণের পরিমাণ এখন দুই লাখ কোটি টাকার উপরে। সঠিক তথ্য এই মুহূর্তে আমার মনে নেই। আমরা তাও দেখব।”
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর শেষে মোট বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ১৫ লাখ ৬৫ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা। তাতে খেলাপির হার দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
সেপ্টেম্বর শেষে এই ঋণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা।
বর্তমানে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক খাতে খেলাপির হার ২১ দশমিক ৭০ শতাংশ, রাষ্ট্রায়ত্ত দুই বিশেষায়িত ব্যাংকে ১২ দশমিক ১০ শতাংশ ও বেসরকারি ব্যাংকে ৫ দশমিক ৮২ শতাংশ ও বিদেশি ব্যাংকে চার দশমিক ১৯ শতাংশ।
অবলোপনের সময় কমল
এখন থেকে মন্দমানের যে কোনো ঋণ দুই বছর পার করলে অবলোপন (রাইট অফ) করা যাবে, এতদিন তা ছিল তিন বছর।
অবলোপন করার আগে এসব ঋণের বিপরীতে শতভাগ নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) রাখতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণ বলছে, এতে খেলাপির পরিমাণ এক ধাক্কায় কমে যাবে ৪৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা।
অবলোপন হচ্ছে মন্দ মানের ঋণকে ব্যাংকের স্থিতিপত্র থেকে (ব্যালেন্স শিট) বাদ দিয়ে আলাদা হিসাবে রাখা। বর্তমানে অবলোপন করা ঋণের পরিমাণ ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি।
এই অর্থ আদায়ে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের অধীনে ‘অবলোপনকৃত ঋণ আদায় ইউনিট’ নামে আলাদা ইউনিট গঠন করতে বলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কর্মদক্ষতা মূল্যায়ন প্রতিবেদনে এই ঋণ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বিষয়টিও যোগ করতে হবে এখন থেকে।
এই মূল্যায়ন প্রতিবেদন পুনরায় ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ বা মেয়াদ বাড়ানোর সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করবে।
ঝুঁকিযুক্ত ঋণ সম্পদের বিপরীতে আরোপিত সুদ আদায় আদায় হওয়া সাপেক্ষে আয় খাতে যোগ করার উপর আগের সিদ্ধান্ত অনুসরণ করতে গুরুত্ব দেয়া হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যবেক্ষণ দিয়ে বলেছে, ঝুঁকিপূর্ণ হওয়া এসব ঋণ খেলাপিতে পরিণত হতে পারে ভবিষ্যতে।
ঋণ পুনঃতফসিল আর নয়
খেলাপি হওয়া ঋণ নমনীয়ভাবে পুনঃতফসিল করাসহ বিভিন্ন সুবিধার মেয়াদ আর না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ঋণ পরিশোধ হলে ব্যাংকের তারল্য সংকট কমে যাবে।
পুরোনো ঋণ আদায়ের মাধ্যমে নতুন ঋণ প্রবাহ বৃদ্ধি করা যাবে মনে করছে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।
খেলাপি ঋণ আদায়ে বিচারাধীন মামলা দ্রুত পরিচালনা করতে ব্যাংকের আইন বিভাগকে শক্তিশালী করা, আদালতের বাইরে গিয়ে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি পদ্ধতিতে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে দেওয়া, ইচ্ছেকৃত খেলাপির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নীতিমালা প্রণয়ণ করার সিদ্ধান্তও হয় পর্ষদের বৈঠকে।
আবু ফরাহ বলেন, “ব্যাংক কোম্পানি আইনে ইচ্ছেকৃত খেলাপির বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে এবার। এখন খেলাপিদের নতুন সম্পত্তি ক্রয়সহ আর্থিক খাতের বিভিন্ন সেবা নিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার মতো বিষয়ে আইনগত সুযোগগুলো কাজে লাগানোর দুয়ার খুলেছে।”
ঋণ আদায়ে বিশেষ ভাতা
খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যাংক কর্মকর্তাদের উৎসাহ দিতে বিশেষ ভাতা প্রচলনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সংস্থাটি মনে করছে এতে আদায়ের গতি বাড়বে।
ঋণগ্রহীতার সম্পদ ও জামানত মূল্যায়নে ব্যাংকের পাশাপাশি মূল্যায়নকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যাচাই বাধ্যতামূলক করার আগের সিদ্ধান্তও রোডম্যাপে আনা হয়েছে।
গত ২০২৩ সালে সম্পদ মূল্যায়নকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মূল্যায়ন করতে বাংলাদেশ ব্যাংক নীতিমালা করে। মূল্যায়নকারী প্রতিষ্ঠান হতে দরখাস্তও আহ্বান করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সংশোধন হবে পরিচালক হওয়ার নীতিমালা
বাণিজ্যিক ব্যাংকে পরিচালক হওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ‘ফিট অ্যান্ড প্রোপার টেস্ট’ প্রক্রিয়া মানতে বর্তমান নীতিমালায় সংশোধন আনবে। এতে পরিচালকদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের বিষয়গুলো আরো স্পষ্ট করে দেওয়া হবে। ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ ও তাদের সম্মানী আরো ‘যৌক্তিক করতেও’ উদ্যোগ নেওয়া হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে, এতে ব্যাংকের সুশাসন বৃদ্ধির পাশাপাশি সামগ্রিক ঋণ ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী হবে।
একক গ্রাহক ঋণ সীমা কোনো অবস্থাতেই অতিক্রম না করা, কর্মকর্তাদের পদোন্নতিতে মৌলিক ও পেশাগত প্রশিক্ষণের পাশাপাশি পরীক্ষায় পাস হওয়াও বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্ত হয় রোডম্যাপে।
চাকরিচ্যুত হবে না ‘মার্জার’ হওয়া ব্যাংকের কর্মচারী
দুর্বল কয়েকটি ব্যাংককে অপেক্ষাকৃত সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত (মার্জার) করার সিদ্ধান্ত হয় পর্ষদের বৈঠকে। আবু ফরাহ জানিয়েছেন, একীভূত হওয়ার পরবর্তী তিন বছর কোনো কর্মচারী চাকরিচ্যুত হবে না বলে শর্ত যোগ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
খেলাপি আসলে কত?
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে, তখন দেশে মোট খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি ৪১ লাখ টাকা, এখন তা বেড়ে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা হয়েছে, যা বিতরণ করা ঋণের ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
খেলাপি ঋণ সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করে আসছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ।
কোনো গ্রাহক উচ্চ আদালতে গিয়ে স্থিতাবস্থা নিয়ে এলে ওই ঋণকে খেলাপি দেখানো হয় না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি শেষে বিভিন্ন ব্যাংকের ঋণ আদায়ে অর্থঋণ আদালতে করা মামলার মধ্যে নিস্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে ৭২ হাজার ৫৪৩টি। এসব মামলায় আটকা আছে এক লাখ ৭৮ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা।
পুনঃতফসিল করা ঋণকে বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি হিসেবে দেখায় না। এসব ঋণের তথ্য যোগ করলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরো বাড়বে বলে পর্যবেক্ষণ রয়েছে আইএমএফ এর।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “সব কিছু মিলিয়ে যোগ করলে খেলাপি ঋণের অঙ্ক চার লাখ কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকবে।”
সুশাসন ফেরাতে যে পরিকল্পনা
ব্যাংকিং খাতের সুশাসন নিশ্চিতে ব্যাংকের শেয়ারধারী পরিচালকদের যোগ্যতা ও দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কিত নীতিমালা সংশোধন করা হবে বলে উল্লেখ করা হয় পথনকশায়। তাতে ব্যাংকের সামগ্রিক ঋণ ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী হবে বলে মনে করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ, তাদের সম্মানী নির্ধারণ এবং দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কিত নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে। এতে স্বতন্ত্র পরিচালকেরা আমানতকারী ও শেয়ারধারীদের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে সক্ষম হবে। এখন দুই-তিনটি ব্যাংক ছাড়া সব ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালকেরা শেয়ারধারী পরিচালকদের অনুগত। ফলে তাঁরা পরিচালনা পর্ষদের স্বার্থই বেশি দেখছেন।
ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা এমডি নিয়োগ ও পুনঃ নিয়োগে বাছাই প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনা হয়েছে, যা আরও কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা হবে। পারদর্শিতার সূচকের ভিত্তিতে এমডিদের কাজের মূল্যায়ন করা হবে। এখন একাধিক ব্যাংকের এমডিদের শিক্ষাগত সনদ নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে অনেকের অনিয়ম ধরা পড়লেও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিকল্পনা এখন একজন গ্রাহক যে ঋণ নিতে পারে, তার বেশি ঋণ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে না। কয়েকটি দুর্বল ব্যাংককে অপেক্ষাকৃত ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা হবে। এতে একীভূত হওয়ার তিন বছর পর্যন্ত কাউকে চাকরিচ্যুত করা যাবে না। এর মাধ্যমে দুর্বল ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ শক্তিশালী হবে, মূলধন ঘাটতি দূর হবে ও খরচ কমে আসবে। ব্যাংক কর্মকর্তাদের পদোন্নতিতে মৌলিক প্রশিক্ষণ ও ব্যাংকিং প্রফেশনাল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ বাধ্যতামূলক করা হবে।
কমেন্ট