বয়স ৩০ বছর না হলে ব্যাংক পরিচালক নয়

বয়স ৩০ বছর না হলে ব্যাংক পরিচালক নয়

রবিবার ব্যাংক-কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ গঠন এবং পরিচালকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য-সংক্রান্ত এক নীতিমালায় এই নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

দেশে এখন থেকে কোনও ব্যাংকের পরিচালক হতে ন্যূনতম বয়স লাগবে ৩০ বছর। আর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অন্যূন ১০ বছরের ব্যবস্থাপনা বা ব্যবসায়িক পেশাগত অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। কোনও ব্যক্তির বয়স ১৮ বছর পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত তার কোনও কাজের অভিজ্ঞতাকে বিবেচনায় নেওয়া হবে না।

রবিবার ব্যাংক-কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ গঠন এবং পরিচালকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য-সংক্রান্ত এক নীতিমালায় এই নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

সংস্থাটির ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের জারি করা ২৪ পৃষ্ঠার এই নীতিমালায় পরিচালকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে বিশদ বিবরণ দেওয়া হয়েছে।

কোনও কোনও ব্যাংকে ২২ বছর বয়সেও পরিচালক পদে নিয়োগ পেয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে ব্যাংক খাতে বেশ আলোচনা আছে। বিশেষ করে ২০২০ সালের এপ্রিলে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলমের ছেলে আহসানুল আলম ইউনিয়ন ব্যাংকের নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই বিষয়টি নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে।

২০২১ সালের নভেম্বরে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির সময়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) অনুমোদিত আইপিওর (প্রাথমিক গণ প্রস্তাব) প্রসপেক্টাসে ইউনিয়ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে আহসানুল আলমের বয়স দেখান হয়েছিল ২৭ বছর।

২০২৩ সালে জুনে আহসানুল আলম ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান হন। তার বয়স এখন ৩০ বছরের বেশি। আহসানুল আলমের বয়স ৩০ বছর পূর্ণ হওয়ার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ সংক্রান্ত নীতিমালা জারি করল। 

গত বছরের জানুয়ারিতে আলোচিত ব্যবসায়ী চৌধুরী নাফিজ সরাফতের ছেলে চৌধুরী রাহিব সরাফতকে সাউথইস্ট ব্যাংকের পরিচালক পদে নিয়োগের অনুমোদন বাতিল করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। পুঁজিবাজারে মিউচুয়াল ফান্ড পরিচালনাকারী সম্পদ ব্যবস্থাপক প্রতিষ্ঠান রেইস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের প্রতিনিধি হিসেবে তাকে ব্যাংকটির পরিচালক নিয়োগের অনুমোদন চাওয়া হয়েছিল।

কিন্তু মাত্র ১৮ বছর বয়স হওয়ায় চৌধুরী রাহিবকে পরিচালক পদে নিয়োগ দেয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চৌধুরী নাফিজ সরাফত পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন। সম্প্রতি তিনি পদত্যাগ করেছেন।

ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ গঠন এবং পরিচালকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য-সংক্রান্ত নীতিমালায় বলা হয়েছে, ব্যাংকে সুশাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এ-সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন এবং ব্যবসায়িক কার্যক্রম যথাযথ ও সুচারুভাবে সম্পন্ন করার জন্য উপযুক্ত ও পেশাগতভাবে দক্ষ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ গঠিত হওয়া আবশ্যক।

ব্যাংকের কর্মকাণ্ড প্রধানত আমানতকারীদের অর্থে পরিচালিত হয় এবং এ ক্ষেত্রে আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা করা অপরিহার্য বিধায় ব্যাংক-কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের দায়িত্ব অপরাপর কোম্পানির তুলনায় অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ।

ব্যাংকিং খাতে সুশাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ২০২৩ সালে ব্যাংক-কোম্পানি আইনে অধিকতর সংশোধনী আনা হয়েছে।

ওই সংশোধনের ফলে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের গঠন এবং পরিচালকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য, যোগ্যতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে নতুনভাবে নীতিমালা প্রণয়নের আবশ্যকতা দেখা দিয়েছে।

এ প্রেক্ষিতে ব্যাংক খাতে সুশাসনের নিশ্চয়তা বিধানের লক্ষ্যে পরিচালনা পর্ষদের গঠন, পরিচালকের দায়িত্ব ও কর্তব্যসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে এই নীতিমালা অনুসরণের জন্য নির্দেশনা জারি করা হলো—

ব্যাংক-কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ গঠন

>> ব্যাংক-কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ শেয়ারধারক পরিচালক, শেয়ারধারক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে প্রতিনিধি পরিচালক এবং স্বতন্ত্র পরিচালক এর সমন্বয়ে গঠিত হবে। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে বিকল্প পরিচালকও পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হবেন।

>> পরিচালনা পর্ষদের পরিচালক সংখ্যা হবে সর্বোচ্চ ২০ জন।

>> পরিচালনা পর্ষদের পরিচালক সংখ্যা ২০ জন হলে স্বতন্ত্র পরিচালকের সংখ্যা হবে অন্যূন ৩ জন। আর পর্ষদের পরিচালক সংখ্যা ২০ জনের কম হলে স্বতন্ত্র পরিচালকের সংখ্যা হবে অন্যূন ২ জন।

>> কোনও একক পরিবার থেকে ৩ জনের বেশি সদস্য একই সময়ে কোনও ব্যাংকের পরিচালক থাকতে পারবেন না।

>> পরিচালনা পর্ষদে কোনও একক পরিবারের সদস্যের অতিরিক্ত ওই পরিবারের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বা নিয়ন্ত্রণাধীন অনধিক ২টি প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির পক্ষে প্রতিনিধি পরিচালক থাকতে পারবেন।

>> পরিচালনা পর্ষদে কোনও প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির পক্ষে একের বেশি ব্যক্তি প্রতিনিধি পরিচালক নিযুক্ত হতে পারবেন না।

>> পরিচালনা পর্ষদে কোনও প্রাকৃতিক ব্যক্তিসত্তা বিশিষ্ট ব্যক্তি শেয়ারধারকের পক্ষে অন্য কোনও ব্যক্তি প্রতিনিধি পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত হতে পারবেন না।

>> ব্যাংক-কোম্পানি আইন, ১৯৯১ এর ১৫ ক ধারা অনুযায়ী ২৮ জানুয়ারি ২০১৮ তারিখ থেকে কোনও ব্যক্তি কোনও ব্যাংক-কোম্পানির পরিচালক পদে একাদিক্রমে ১২ বছরের অধিক সময় অধিষ্ঠিত থাকতে পারবেন না। ওই মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ৩ বছর অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত তিনি ওই ব্যাংকের পরিচালক পদে পুনঃনিযুক্ত হওয়ার যোগ্য হবেন না।

এবং

>> ব্যাংক-কোম্পানির প্রথম বার্ষিক সাধারণ সভায় সব পরিচালক অবসর গ্রহণ করবেন। পরবর্তী সময়ে প্রতি বার্ষিক সাধারণ সভায় জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে এক-তৃতীয়াংশ পরিচালক অবসর গ্রহণ করবেন। এক্ষেত্রে কোম্পানি আইন, ১৯৯৪ এর তফসিল-১ এর ৮০ নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত বিধান অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অবসরগ্রহণকারী পরিচালক পুনরায় নিযুক্তির জন্য নির্বাচিত হওয়ার যোগ্য হবেন।

পরিচালক নিযুক্ত হওয়ার যোগ্যতা

ব্যাংক-কোম্পানির পরিচালক পদে নিযুক্ত হওয়ার জন্য যেসব যোগ্যতা ও উপযুক্ততা থাকতে হবে—

>> সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অন্যূন ১০ বছরের ব্যবস্থাপনা বা ব্যবসায়িক বা পেশাগত অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। কোনও ব্যক্তির বয়স ১৮ বছর পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত তার কোনও কাজের অভিজ্ঞতাকে বিবেচনায় নেওয়া হবে না।

>> সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ন্যূনতম বয়স ৩০ বছর হতে হবে।

>> তিনি ফৌজদারী অপরাধে দণ্ডিত হননি কিংবা কোনও জাল-জালিয়াতি, আর্থিক অপরাধ বা অন্যবিধ অবৈধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না বা জড়িত নন।

>> তার সম্পর্কে কোনও দেওয়ানী বা ফৌজদারী মামলায় আদালতের রায়ে কোনও বিরূপ পর্যবেক্ষণ / মন্তব্য নেই।

>> তিনি আর্থিক খাত সংশ্লিষ্ট কোনও নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের বিধিমালা, প্রবিধান,নীতিমালা বা নিয়মাচার লঙ্ঘনজনিত কারণে দণ্ডিত হননি।

>> তিনি এমন কোনও কোম্পানি / প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, যার নিবন্ধন / লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে বা প্রতিষ্ঠানটি অবসায়িত হয়েছে।

>> তার নিজের কিংবা স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে কোনও ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে গৃহীত ঋণের জন্য খেলাপী নন।

>> তিনি অন্যকোনো ব্যাংক-কোম্পানি, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিমা কোম্পানি বা এ ধরনের কোম্পানিগুলোর কোনও সাবসিডিয়ারি কোম্পানির পরিচালক বা উপদেষ্টা / পরামর্শক বা অন্য কোনোভাবে লাভজনক পদে নিয়োজিত নন।

>> তিনি একই ব্যাংক-কোম্পানির বহিঃহিসাব নিরীক্ষক, আইন উপদেষ্টা, উপদেষ্টা, পরামর্শক বা অন্য কোনোভাবে লাভজনক পদে নিয়োজিত নন।

>> কোনও সময়ে আদালত কর্তৃক দেউলিয়া ঘোষিত হননি।

>> ব্যক্তিগতভাবে অথবা তার ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান বা অংশীদারী প্রতিষ্ঠানের জন্য কর খেলাপি নন।

>> সংশ্লিষ্ট ব্যাংক-কোম্পানিতে কোনও পদে চাকরিরত থাকলে চাকরির অবসায়নের ৫ বছর অতিক্রম না হলে।

>> কোনও ব্যাংক-কোম্পানি কর্তৃক বা ফাইন্যান্স কোম্পানি আইন, ২০২৩ এর আওতায় প্রতিষ্ঠিত কোনও আর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ গ্রহীতা হিসেবে তালিকাভুক্ত হলে ওই তালিকা থেকে অব্যাহতি প্রাপ্তির পর ৫ বছর অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত কোনও ব্যাংকের পরিচালক হওয়ার যোগ্য হবেন না।

এবং

>> স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এই শর্তগুলো ছাড়াও স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ সংক্রান্ত নীতিমালা পরিপালনীয় হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদন লাগবে

ব্যাংক-কোম্পানি আইন, ১৯৯১ এর ধারা ১৫ এর উপ-ধারা (৪) অনুযায়ী বিশেষায়িত ব্যাংক ছাড়া অন্য যেকোনো ব্যাংক-কোম্পানির পর্ষদ সভায় মনোনীত এবং বার্ষিক সাধারণ সভায় নির্বাচিত/ পুনঃনির্বাচিত পরিচালক/ পরিচালকদের নিয়োগ/ পুনঃনিয়োগ বা নিযুক্তি/ পুনঃনিযুক্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পূর্বানুমোদন নিতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনের তারিখ থেকে ব্যাংক-কোম্পানির পরিচালক/ পরিচালকদের নিয়োগ/ পুনঃনিয়োগ বা নিযুক্তি/ পুনঃনিযুক্তি কার্যকর হবে।

এই পূর্বানুমোদন গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট পর্ষদ সভা/ বার্ষিক সাধারণ সভা অনুষ্ঠানের ৭ কর্মদিবসের মধ্যে ব্যাংক কর্তৃক প্রধান নির্বাহী/ ব্যবস্থাপনা পরিচালকের স্বাক্ষরে বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করতে হবে এবং আবেদনপত্রের সঙ্গে প্রয়োজনীয় নথি/ কাগজপত্র/ তথ্যাবলী সংযুক্ত করতে হবে।

‘নতুন রোডম্যাপ ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাবে না’ পরবর্তী

‘নতুন রোডম্যাপ ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাবে না’

কমেন্ট