‘এস আলম গ্রুপের অর্থ পাচার নিয়ে তদন্ত চলছে’
দেশের আর্থিক খাতে সন্দেহজনক লেনদেন ও সন্দেহজনক কার্যক্রম গত এক বছরে ‘উল্লেখযোগ্য হারে’ বেড়েছে বলে উঠে এসেছে বিএফআইইউ এর এবারের প্রতিবেদনে।
দেশের আলোচিত শিল্প গ্রুপ এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ সাইফুল আলম ও তার স্ত্রী ফারজানা পারভীনের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগের বিষয়ে উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অনুসন্ধান চলছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান মাসুদ বিশ্বাস।
অর্থপাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সংস্থা বিএফআইইউ এর ২০২২-২৩ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে মঙ্গলবার এক অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।
দেশের আর্থিক খাতে সন্দেহজনক লেনদেন ও সন্দেহজনক কার্যক্রম গত এক বছরে ‘উল্লেখযোগ্য হারে’ বেড়েছে বলে উঠে এসেছে বিএফআইইউ এর এবারের প্রতিবেদনে।
ভোজ্যতেল ও ভোগ্যপণ্য ব্যবসা থেকে জ্বালানি খাতে নাম লেখানো ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের অভিযোগ নিয়ে গতবছর জাতীয় সংবাদ মাধ্যমে খবর প্রচারিত হয়। শেষ পর্যন্ত তা উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়ায়।
মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংকের জাহাঙ্গীর আলম মিলনায়তনে বিএফআইইউ এর প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে ওই অভিযোগ নিয়ে এ সংস্থার সর্বশেষ পদক্ষেপ জানতে চান সাংবাদিকরা।
উত্তরে মাসুদ বিশ্বাস বলেন, “সর্বশেষ আদালত থেকে যে রায় এসেছে, সে অনুযায়ী আমাদের কার্যক্রম চলমান আছে। আমরা সে কাজগুলো করছি।”
২০২৩ সালের ৪ অগাস্ট ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারে ‘এস আলম’স আলাদিন‘স ল্যাম্প’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। দুদিন পর ওই প্রতিবেদন আদালতের নজরে আনেন একজন আইনজীবী।
পত্রিকায় প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, এস আলম গ্রুপের মালিক মোহাম্মদ সাইফুল আলম সিঙ্গাপুরে ‘কমপক্ষে এক বিলিয়ন ডলারের ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য’ গড়ে তুলেছেন। যদিও বিদেশে বিনিয়োগ বা অর্থ স্থানান্তরে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে এ সংক্রান্ত কোনো অনুমতি তিনি নেননি।
ডেইলি স্টার লিখেছে, বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশের বাইরে বিনিয়োগের জন্য এ পর্যন্ত ১৭টি প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি দিলেও চট্টগ্রামভিত্তিক বৃহৎ এই ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নাম সেই তালিকায় নেই। তারপরও, গত এক দশকে সিঙ্গাপুরে এস আলম অন্তত দুটি হোটেল, দুটি বাড়ি, একটি বাণিজ্যিক স্পেস এবং অন্যান্য সম্পদ কিনেছেন। এসব ক্ষেত্রে বিভিন্ন উপায়ে কাগজপত্র থেকে তার নাম বাদ রাখা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নথির বরাতে প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩ সালের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশ থেকে ৪০ দশমিক ১৫ মিলিয়ন ডলার বিদেশে বিনিয়োগের জন্য নেওয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বৈধ উপায়ে সিঙ্গাপুরে এক লাখ ৭ হাজার ডলার পাঠিয়েছে। এর মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠানও এস আলমের মালিকানাধীন নয়।
বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাই কোর্ট বেঞ্চ সে সময় স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুলসহ আদেশ দেয়।
এস আলমের অর্থ পাচারের অভিযোগের অনুসন্ধান করে দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) সংশ্লিষ্টদের দুই মাসের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দিতে বলা হয় সেই আদেশে।
আর এই অর্থ পাচার ঠেকাতে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), দুর্নীতি দমন কমিশন এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘ব্যর্থতা’ কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয় রুলে।
সর্বশেষ গত ৫ ফেব্রুয়ারি হাই কোর্টের ওই রুল খারিজ করে দেয় আপিল বিভাগ। তবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) বা বাংলাদেশ ব্যাংক চাইলে নিজস্ব উদ্যোগে এ বিষয়ে অনুসন্ধান করতে পারবে বলে রায়ে সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়।
আদালতের ওই আদেশের আলোকেই বিএফআইইউ এস আলমের বিষয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানান মাসুদ বিশ্বাস।
সাবেক এক মন্ত্রীর বিদেশে দুই হাজার কোটি টাকার সম্পদের উৎস নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করেন আরেক সাংবাদিক।
এর উত্তরে মাসুদ বিশ্বাস বলেন, “বড় দুটি ঘটনার এটি একটি। এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমেও আমরা যোগাযোগ করছি। আমাদের অনুসন্ধান কার্যক্রম চলমান রয়েছে।”
তবে অর্থ একবার পাচার হয়ে গেলে তা ফেরানো যে কঠিন, সেই বাস্তবতা তুলে ধরে বিএফআইইউ প্রধান বলেন, “আমরা নতুন দশটি রাষ্ট্রের সঙ্গে তথ্য বিনিময় করতে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) করার উদ্যোগ নিয়েছি। অর্থ ফেরত আনার চেষ্টা চলমান রয়েছে। আমরা অর্থপাচার বন্ধে বেশি জোর দিচ্ছি।”
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গত ২৬ ডিসেম্বর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করে, বিদেশে এক মন্ত্রীর দুই হাজার ৩১২ কোটি টাকার ব্যবসা রয়েছে।
ওই সম্পদের তথ্য ওই মন্ত্রী তার নির্বাচনী হলফনামায় দেননি। সংবাদ সম্মেলনে ওই মন্ত্রীর নাম প্রকাশ করেনি টিআইবি।
পরে সংবাদ মাধ্যমে নাম প্রকাশ করে বলা হয়, তিনি সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী। ব্রিটেনে তার ও স্ত্রীর নামে ওই পরিমাণ সম্পদ রয়েছে।
সন্দেহজনক লেনদেন বেড়েছে
আর্থিক খাতে সন্দেহজনক লেনদেন (এসটিআর) ও সন্দেহজনক কার্যক্রম এক বছরে উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ার তথ্য এসেছে বিএফআইইউ এর প্রতিবেদনে।
সেখানে বলা হয়েছে, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে এসটিআর রিপোর্টিং হয়েছে ১৪ হাজার ১০৬টি। আগের অর্থবছরের চেয়ে বেড়েছে ৬৪ দশমিক ৫৭ শতাংশ বা ৫ হাজার ৫৩৫টি। ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ৮ হাজার ৫৭১টি।
সন্দেহজনক লেনদেন (এসটিআর) মানেই যে অপরাধ হয়েছে, তা নাও হতে পারে। এ ধরনের ক্ষেত্রে তথ্য খতিয়ে দেখা হয়।এসটিআর এর বিপরীতে প্রমাণ পেলে বিএফআইইউ তা অপরাধ হিসেবে গণ্য করে।
এক প্রশ্নের উত্তরে বিএফআইইউর প্রধান বলেন, বিএফআইইউর তথ্যে ভিত্তিতে এ পর্যন্ত অর্থ পাচারের ৫৯টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে দুদক করেছে ৪৭টি মামলা। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে সিআইডি ১০টি এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) দুটি মামলা করেছে। সবগুলো মামলাই চলমান।
বিএফআইইউ নির্বাহী পরিচালক রফিকুল ইসলাম, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক এবং সহকারী মুখপাত্র সরোয়ার হোসেন ও সাঈদা খানম সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।
কমেন্ট