এক্সিম-পদ্মা মিলবে যেভাবে
কীভাবে পদ্মা ও এক্সিম একীভূত হবে, দায়-দেনা কীভাবে সমন্বয় হবে তা বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা ও পরামর্শক্রমে দুই ব্যাংকের আইনজীবী মিলে ঠিক করবেন বলে জানিয়েছেন এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার।
দুর্বল ব্যাংক সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার আলোচনার মধ্যেই হঠাৎ করে সংকটে থাকা পদ্মা ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে শরিয়াভিত্তিক এক্সিম ব্যাংক। এই একীভূত হওয়ার বিষয়ে বেসরকারি খাতের এই ব্যাংক দুটির মধ্যে আগামী সোমবার একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর হবে। দুর্বল ব্যাংক একীভূত করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক উদ্যোগের পর দুটি ব্যাংকের একীভূত হওয়ার এটিই প্রথম সিদ্ধান্ত।
জানা গেছে, দুই ব্যাংকের মধ্যে সমঝোতা স্মারকটি স্বাক্ষরিত হবে বাংলাদেশ ব্যাংকে, যেখানে উপস্থিত থাকবেন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। এতে কর্মকর্তাদের পাশাপাশি দুই ব্যাংকের উদ্যোক্তারাও উপস্থিত থাকবেন।
বৃহস্পতিবার এক্সিম ও পদ্মা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের আলাদা আলাদা সভায় এ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়।
এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “পদ্মা ব্যাংকের সঙ্গে আমাদের ব্যাংকের (এক্সিম) একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোকে স্বেচ্ছায় একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।”
কীভাবে এই ব্যাংক দুইটি একীভূত হবে, দায়-দেনা কীভাবে সমন্বয় হবে তা বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা ও পরামর্শক্রমে দুই ব্যাংকের আইনজীবী মিলে ঠিক করবেন বলেও জানান তিনি।
“এ জন্য আগামী সোমবার একটি সমঝোতা চুক্তি হওয়ার কথা রয়েছে। ওই চুক্তির পর একীভূত কার্যক্রমের বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে,” যোগ করেন এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “সরকারের উপরের মহলের নির্দেশেই দুর্বল পদ্মা ব্যাংক সবল এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুই ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। কেননা, এর আগে ডুবতে বসা ফারমার্স ব্যাংককে টেনে তুলতে রাষ্ট্রায়ত্ত তিন ব্যাংক ও আইসিবি যে বিনিয়োগ করেছিল তা সরকারের শীর্ষ মহলের নির্দেশেই করেছিল। নতুন উদ্যোগে চালুর পর ব্যাংকটির নাম পরিবর্তন করে পদ্মা ব্যাংক রাখা হয়।”
এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার ব্যাংক উদ্যোক্তা মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসেরও (বিএবি) চেয়ারম্যান। তার সঙ্গে সরকারের শীর্ষ মহলের খুব ভালো সম্পর্কের কথা ব্যাংকিং খাতের সবাই জানেন। অন্যদিকে কিছুদিন আগে পদত্যাগ করা পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের সঙ্গেও সরকারের উপরের মহলের ভালো সম্পর্কের কথা সবাই জানেন।
নজরুল ইসলাম মজুমদার ও চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের সুসম্পর্কও ব্যবসায়ী মহলে বেশ আলোচিত। দুজনের যৌথ উদ্যোগে বিনিয়োগও আছে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে।
জানা যায়, অন্য দুর্বল ব্যাংকগুলোও যাতে সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে উৎসাহিত হয়, সেজন্য সরকারের নির্দেশানার আলোকে পদ্মা ও এক্মিম ব্যাংক তড়িঘড়ি করে একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বাংলাদেশে এর আগে শুধু দুটি ব্যাংক একীভূত হয়েছিল। সেই দুটি ব্যাংক হচ্ছে—বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক (বিএসবি) ও বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা (বিএসআরএস)। একীভূতকরণে এর নামকরণ করা হয় বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল)। বর্তমানে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক পিএলসি)।
বিএসবি ও বিএসআরএস দুটি ব্যাংকই ছিল সরকারি ব্যাংক। দুটি ব্যাংকের অবস্থা বেশ খারাপ হয়ে গিয়েছিল। এক হয়ে বিডিবিএল হওয়ার পরও ব্যাংকটি ভালো চলছে না।
গত ৪ মার্চ ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার জানান, চলতি বছরের মধ্যে ৭ থেকে ১০টি দুর্বল ব্যাংককে সবল বা ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা হতে পারে। এ সময়ের মধ্যে দুর্বল ব্যাংকগুলো নিজেদের ইচ্ছায় একীভূত না হলে আগামী বছর থেকে তাদের চাপ দিয়ে একীভূত করা হবে।
এর আগে গত ৩১ জানুয়ারি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সঙ্গে এক আলোচনায়ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে দুর্বল ব্যাংককে একীভূত হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। একীভূত হওয়ার লক্ষ্যে ভালো ও দুর্বল ব্যাংকের এমডিদের (ব্যবস্থাপনা পরিচালক) নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরুরও পরামর্শ দেওয়া হয় ওই বৈঠকে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ভালো ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংকের একীভূত কার্যক্রম সম্পন্ন করতে শিগগিরই একটি নীতিমালা প্রণয়ন করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেই নীতিমালার আওতায় একীভূত হওয়ার কার্যক্রম সম্পন্ন হবে।
কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক সেই নীতিমালা করার আগেই এক্সিম ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংক নিজেরাই একীভূত হওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
একটি সূত্র জানায়, সরকারের উচ্চপর্যায়ের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এক্সিম ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংকে একীভূত হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। দুই ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের যৌথ ব্যবসা থাকায় প্রথম এই ব্যাংক দুটিকে বেছে নেওয়া হয়। এই একীভূতকরণের উদ্যোগের ফলে আর্থিক বাজারে কোনো অস্থিরতা তৈরি না হলে আগামী দিনে অন্য দুর্বল ব্যাংকগুলোর বিষয়েও একই ধরনের সিদ্ধান্ত হবে।
এক্সিম ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পদ্মা ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ রয়েছে, যা কিনে নেবে একটি সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি। ফলে যে কারণে ব্যাংকটির সম্পদের (ঋণ ও বিনিয়োগ) মান খারাপ হয়ে পড়েছে, তা আর থাকবে না। এরপর ভালো সম্পদগুলো নিয়ে কার্যক্রম শুরু করবে এক্সিম ব্যাংক। এর ফলে এক্সিম ব্যাংকের সূচক খারাপ হয়ে পড়ার কোনো শঙ্কা নেই।
২০১৩ সালের চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংক হিসেবে অনুমোদন পায় সাবেক ফারমার্স ব্যাংক। চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকগুলোর মধ্যে এই ব্যাংকেই বড় ধরনের আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে এবং তা ঘটে ব্যাংকটি কার্যক্রম শুরু করার কয়েক বছরের মধ্যেই। এরপর ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। ফারমার্স ব্যাংকের নাম বদলে রাখা হয় পদ্মা ব্যাংক। ২০১৭ সালে এ ব্যাংকটির মালিকানার সঙ্গে যুক্ত হয় সরকারি একাধিক ব্যাংক ও সংস্থা। ব্যাংকটির ৬০ শতাংশ ঋণই এখন খেলাপি।
এক্সিম ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৯৯ সালে। বর্তমানে এটি ইসলামি ধারার একটি ব্যাংক। ২০০৪ সালে ব্যাংকটি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। আজ বৃহস্পতিবার শেয়ারবাজারে এক্সিম ব্যাংকের শেয়ারের বাজারমূল্য ছিল ১০ টাকা। এদিন ব্যাংকটির শেয়ারের দাম ১ শতাংশের মতো বেড়েছে।
পদ্মা ব্যাংক এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হবে কিভাবে—এ প্রশ্নের উত্তরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, দুর্বল ব্যাংক সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়া নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক যে নীতিমালা করবে, সেই নীতিমালার আলোকেই ব্যাংক দুটি একীভূত হবে। যেহেতু দুর্বল পদ্মা ব্যাংক সবল এক্মিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হবে, তাই নাম এক্সিম ব্যাংকই হবে।
এতে দুই ব্যাংকের আমানতকারীদের ওপর কোনও প্রভাব পড়বে না। পদ্মা ব্যাংকের আমানতকারীদেরও কেনো সমস্যা হবে না। তারা নীতিমালার আলোকে এক্সিম ব্যাংকের গ্রাহক ও আমানতকারী হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে নতুন করে কি চেক বই নিতে হবে বলে জানান কেন্দ্রীয় ওই কর্মকর্তা।
২০০৯ সালে একীভূত হয়েছিল বিএসবি ও বিএসআরএস
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে খারাপ ব্যাংক ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়া স্বাভাবিক ঘটনা। এ ধরনের একীভূতকরণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলোকে অধিকতর শক্তিশালী করা হয়। ২০২৩ সালে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রে ধসে পড়া কয়েকটি ব্যাংককে কিনে নিয়েছে সবল কয়েকটি ব্যাংক।
তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ব্যাংক একীভূতকরণ খুব একটা স্বাভাবিক বা সাধারণ ঘটনা নয়। নিকট অতীতে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক (বিএসবি) ও বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা (বিএসআরএস) একীভূতকরণ করা হয়েছে। একীভূতকরণে এর নামকরণ করা হয় বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল)। বর্তমানে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক পিএলসি)।
বিএসবি ও বিএসআরএস ছিল সরকারি ব্যাংক। সুশাসনের অভাব, খেলাপি ঋণ ও নানা অনিয়মের কারণে ব্যাংক দুটি ডুবতে বসেছিল। সে সময় সরকারি সিদ্ধান্তের আওতায় বিএসবি ও বিএসআরএসকে একীভূত করে ২০১০ সালের ৩ জানুয়ারি বিডিবিএল-এর কর্মযাত্রা শুরু হয়।
এই ব্যাংক দুটি সরকারি হওয়ায় একীভূত হওয়া যতোটা সহজ হয়েছিল, দুটি বেসরকারি ব্যাংক একীভূত করা ততেটা সহজ হবে না। এক্ষেত্রে দুই ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালকদের সম্মতির প্রয়োজন হবে। কর্মকর্তা-কর্মচারিরা কিভাবে কাজ করবে, আমানতকারীদের স্বার্থ কিভাবে রক্ষা হবে—সে বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতে হবে। একীভূত হলেই যে সেই ব্যাংক ভালো হয়ে যাবে বা ভালোভাবে চলবে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।
কেননা, বিএসবি ও এসআরএস একীভূকরণের পর উভয় প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে সমঝোতামূলক মনোভাব নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে ঘাটতি লক্ষ্য করা গেছে। পরবর্তী সময়ে ব্যাংকে নতুন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
ব্যাংক দুটি একীভূত হয়ে বিডিবিএল-এর কার্যক্রমে আগের তুলনায় গতিশীলতা বেড়েছে তা বলা যাবে না। কারণ আগে দুটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ যেমন ছিল, তা থেকে উত্তরণ ঘটানো সম্ভব হয়নি। এখনো ব্যাংকটি বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণের বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছে। সব ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে এটা নিশ্চিত করে বলা যায় না।
সার্বিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক মোস্তফা কে মুজেরী এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “কয়েকটি ব্যাংকের অবস্থা একেবারেই খালাপ। সেগুলোকে সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা নেই। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”
“তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে, যেসব ব্যাংক একীভূত করা হবে, তারা যেন আগের তুলনায় ভালো চলতে পারে, অধিকতর শক্তিশালী ব্যাংক হিসেবে নিজেদের তুলে ধরতে পারে, তা নিশ্চিতকরণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।”
“দুর্বল ব্যাংকটির ভারে সবল ব্যাংকটিও যেনো দুর্বল হয়ে না পড়ে—সে বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে,” মোস্তফা কে মুজেরী।
কমেন্ট