বিডিবিএল সোনালীতে, রাকাব কৃষিতে, বেসিক মিলবে অগ্রণী ব্যাংকে

বিডিবিএল সোনালীতে, রাকাব কৃষিতে, বেসিক মিলবে অগ্রণী ব্যাংকে

সরকারি ব্যাংকের বাইরে সমস্যাগ্রস্ত পদ্মা ছাড়াও বেসরকারি খাতের আরও ৮টি ব্যাংক একীভূতকরণের আলোচনা রয়েছে। এভাবে ব্যাংকের সংখ্যা বর্তমানের ৬১ থেকে কমিয়ে ৫০ বা তার নিচে নামানো হবে বলে জানা গেছে।

এবার সরকারি খাতের দুটি ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংককে (বিডিবিএল) সরকারি অন্য দুই ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সরকারের এ সিদ্ধান্তের কথা বুধবার সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে জানিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, রাকাবকে কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে এবং বিডিবিএলকে সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ব্যাংক চারটির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) সঙ্গে আলাদা বৈঠক করে এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেওয়া হয়।

আগামী সপ্তাহে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণার কথা বলা হয়েছে বৈঠক থেকে।

এছাড়া রাষ্ট্রীয় মালিকানার বেসিক ব্যাংকও একীভূতকরণের আলোচনায় রয়েছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানার আরেক বড় ব্যাংক অগ্রণীর সঙ্গে বেসিককে এক করে দেওয়া হতে পারে সূত্র জানিয়েছে।

সরকারি ব্যাংকের বাইরে সমস্যাগ্রস্ত পদ্মা ছাড়াও বেসরকারি খাতের আরও ৮টি ব্যাংক একীভূতকরণের আলোচনা রয়েছে। এভাবে ব্যাংকের সংখ্যা বর্তমানের ৬১ থেকে কমিয়ে ৫০ বা তার নিচে নামানো হবে বলে জানা গেছে।

সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, ডেপুটি গভর্নর নুরুন নাহার, উপদেষ্টা আবু ফরাহ মো. নাছের ও নির্বাহী পরিচালক সাইফুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।

সভায় ব্যাংক চারটিকে জানানো হয়, বৃহস্পতিবার ব্যাংক একীভূত বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক নীতিমালা দেবে। এরপরই নীতিমালা মেনে নিজ নিজ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় একীভূত করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এরপর সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে একীভূত করার প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে।

সংশ্লিষ্ট চার ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, বুধবার হঠাৎ চার ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও এমডিকে ডেকে নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ জন্য আগে থেকে কোনো চিঠি দেওয়া হয়নি, এমনকি আলোচনার বিষয়বস্তুও বলা হয়নি। একটি সভায় সোনালী ব্যাংক ও বিডিবিএলের চেয়ারম্যান-এমডিকে জানানো হয়, সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিডিবিএল ব্যাংক সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হয়ে যাবে। আরেকটি সভায় বিকেবি ও রাকাবকে একই ধরনের সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়।

এদিকে বৃহস্পতিবার বিকেলে ব্যাংক একীভূতকরণের নীতিমালা জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই নীতিমালায় স্বতপ্রণোদিত হয়ে ও বাধ্যতামূলক একীভূতকরণে কী কী নির্দেশনা অনুসরণ করা হবে, সে বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রণ সংস্থাটি।

নীতিমালায় বলা হয়েছে, দুর্বল ব্যাংক অধিগ্রহণ করলে খেলাপি ঋণ ও পুঞ্জীভূত লোকসানের পুরোটা বহন করতে হবে গ্রহীতা ব্যাংককে। তবে এ জন্য নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) রাখতে বিশেষ ছাড় পাবে তারা। এর বাইরে সরকারি বিশেষ নীতি সহায়তাও দেওয়া হবে।

এর আগে গত ২৫ মার্চ বেসরকারি খাতের এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে চতুর্থ প্রজন্মের পদ্মা ব্যাংক একীভূত হওয়ার বিষয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়। পদ্মা ব্যাংকের পর সরকারি খাতের দুই ব্যাংককে একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ ক্ষেত্রে সরকারি দুর্বল দুই ব্যাংককে সরকারি মালিকানাধীন অপর দুটি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, যেহেতু সরকারি ব্যাংকের সঙ্গে সরকারি ব্যাংককে একীভূত করা হবে, তাই রাকাব ও বিডিবিএল ব্যাংকের কর্মীদের চাকরি নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই।

জানা যায়, ১৯৭৩ সালে কার্যক্রম শুরু করে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক। আর ১৯৮৬ সালে উত্তরাঞ্চলের কৃষি ব্যাংকের শাখাগুলো নিয়ে গঠন করা হয় রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক। এখন আবার দুটি ব্যাংককে এক করে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

গত ডিসেম্বর শেষে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের বিতরণ করা ৩১ হাজার ৪৮৭ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে ৩ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। ব্যাংকটির খেলাপির হার ১২ দশমিক ৬৪ শতাংশ। আর মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ১৩ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা।

এ ছাড়া গত ডিসেম্বর শেষে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকা, যা ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের ২১ দশমিক ৩৭ শতাংশ। ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ২ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা।

অন্যদিকে ২০১০ সালে বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক (বিএসবি) ও বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা (বিএসআরএস) একীভূত হয়ে বিডিবিএল ব্যাংক নামে যাত্রা শুরু করে। গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের ৪২ শতাংশই ছিল খেলাপি। এ সময় পর্যন্ত বিডিবিএলের ঋণের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৩১৩ কোটি টাকা, যার মধ্যে খেলাপি ৯৮২ কোটি টাকা। আর গত ডিসেম্বর পর্যন্ত সোনালী ব্যাংকের ৯৩ হাজার ৯৬ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপির পরিমাণ ছিল ১৩ হাজার ১৫০ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ১৪ দশমিক ১৩ শতাংশ।

বুধবারের সভায় সোনালী ও কৃষি ব্যাংককে জানানো হয়, যে দুটি ব্যাংককে একীভূত করা হবে, তাদের খারাপ সম্পদ বা মন্দ ঋণ কিনে নেবে সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানি। এরপর শুধু ভালো সম্পদ নিয়ে ব্যাংক দুটিকে একীভূত করা হবে। এতে চাপে পড়বে না ভালো ব্যাংকগুলো।

বিকেবির একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, বেশি সুদে আমানত নিয়ে কৃষকদের কম সুদে ঋণ দেওয়ায় কৃষি ব্যাংক ও রাকাবের আর্থিক পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার অন্যতম কারণ। এখন যদি সরকার কৃষকদের কম সুদে ঋণ না দিয়ে বাণিজ্যিকভাবে ব্যাংক দুটি পরিচালনার উদ্যোগ নেবে কি না, সেটি সরকারের সিদ্ধান্ত। এ ধরনের সিদ্ধান্ত না নিয়ে শুধু একীভূত করা হলে তাতে কিছু পরিচালন খরচ কমা ছাড়া আর খুব বেশি উন্নতি হবে না।

ব্যাংক খাতের সংস্কারে নানা সমস্যার সমাধান করতে গত ফেব্রুয়ারিতে একটি পথনকশা তৈরি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেখানে ব্যাংক একীভূত করার বিষয়টি রয়েছে।

এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিভিন্ন ব্যাংকের এমডিদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, চলতি বছরের মধ্যে ৭ থেকে ১০টি দুর্বল ব্যাংককে ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা হবে। দুর্বল ব্যাংকগুলো নিজেদের ইচ্ছায় একীভূত না হলে আগামী বছর থেকে তাদের চাপ দিয়ে একীভূত করা হবে।

তবে ভালো ব্যাংকের সঙ্গে এসব খারাপ ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে এ খাত-সংশ্লিষ্টদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। এসব নিয়ে আলোচনার মধ্যে গত মঙ্গলবার বিশ্বব্যাংক সংবাদ সম্মেলনে সব ধরনের নিয়ম-নীতি মেনে একীভূতকরণের পরামর্শ দিয়েছে। জোরপূর্বক একীভূতকরণ না করার কথা বলেছে সংস্থাটি।

বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, আগামী বছরের মার্চ থেকে খারাপ ব্যাংক জোরপূর্বক ভালো ব্যাংকের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হবে। একীভূতকরণের আগে দুর্বল ব্যাংক চিহ্নিত করার জন্য চারটি সূচকের ভিত্তিতে একটি পিসিএ ফ্রেমওয়ার্ক ঘোষণা করা হয়েছে। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে কোনো ব্যাংক নিজ থেকে এক হলে বাংলাদেশ ব্যাংক তাতে সমর্থন দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। একীভূতকরণের মাধ্যমে খারাপ ব্যাংকের সংখ্যা কমিয়ে পুরো খাতের চিত্র ভালো দেখানোর চেষ্টা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

ব্যাংক খাতের উচ্চ খেলাপি ঋণ কমানো, মূলধন পরিস্থিতির উন্নতি এবং ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা আনার ক্ষেত্রে আইএমএফের চাপ রয়েছে। আবার বর্তমানের আস্থাহীনতা কাটিয়ে তারল্য পরিস্থিতির উন্নতির জন্য একীভূতকরণকে ভালো বিকল্প মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, আগামী সপ্তাহে সরকারি চার ব্যাংকের একীভূতকরণ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসতে পারে। পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছে গোপনে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর এবং পলিসি অ্যাডভাইজর ছাড়া বিভাগীয় পর্যায়ে কাউকে এসব আলোচনায় রাখা হচ্ছে না।

একইসঙ্গে নানা সমস্যায় জর্জরিত রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক বেসিকও একীভূতকরণের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। রাষ্ট্রীয় মালিকানার আরেক বড় ব্যাংক অগ্রণীর সঙ্গে বেসিককে এক করে দেওয়া হবে। খুব শিগগিরই এ দুই ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও এমডিদের সঙ্গে গভর্নর বৈঠক করবেন বলে জানা গেছে।

ব্যাংক একীভূতকরণ: খেলাপি ঋণ ও পুঞ্জীভূত লোকসান বহন করবে গ্রহীতা ব্যাংক পরবর্তী

ব্যাংক একীভূতকরণ: খেলাপি ঋণ ও পুঞ্জীভূত লোকসান বহন করবে গ্রহীতা ব্যাংক

কমেন্ট