এনবিএলের পর্ষদ ফের পুনর্গঠন, নতুন চেয়ারম্যান কেডিএস গ্রুপের খলিলুর রহমান
একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত নিয়ে টানাপোড়েনের মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যানসহ বেশির ভাগ পরিচালক পদত্যাগ করেছেন। বৃহস্পতিবার তারা পদত্যাগের পর রবিবার নতুন পর্ষদ গঠন করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সংকটে থাকা বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ গঠন করে দেওয়ার সাড়ে চার মাসের মাথায় আবার পুনর্গঠন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকটির নতুন চেয়ারম্যান হয়েছেন উদ্যোক্তা পরিচালক ও চট্টগ্রামের কেডিএস গ্রুপের চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান।
একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত নিয়ে টানাপোড়েনের মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যানসহ বেশির ভাগ পরিচালক পদত্যাগ করেছেন। বৃহস্পতিবার তারা পদত্যাগের পর রবিবার নতুন পর্ষদ গঠন করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এর আগে গত ডিসেম্বরে সিকদার পরিবারের কর্তৃত্ব কেড়ে নতুন পর্ষদ গঠন করা হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক রবিবার এক চিঠিতে এই সিদ্ধান্ত ন্যাশনাল ব্যাংককে জানিয়েছে। ৭ সদস্যের পর্ষদ পুনর্গঠন করে ১০ সদস্যের করা হয়েছে। আগের পর্ষদের তিনজনকে রেখে বাকিদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের (আইবিএ) সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ ফারহাত আনোয়ার চেয়ারম্যানের পাশাপাশি পরিচালক পদ থেকে বাদ পড়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেসরকারি খাতের ইউসিবি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে বাংলাদেশ ব্যাংক যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তাতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন কয়েকজন পরিচালক। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশে পদত্যাগ করেন তিনজন পরিচালক। এর বাইরে সিকদার পরিবারের সদস্য পারভীন হক সিকদারকে নতুন করে পরিচালক করেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। এর পরিবর্তে ব্যাংকটিতে নতুন পর্ষদ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংক আনুষ্ঠানিকভাবে এটা স্বীকার করেনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, ব্যাংকটির পরিচালকদের ছয়জন পদত্যগ করায় নতুন পর্ষদ দেওয়া হয়েছে এর সঙ্গে একীভূত হওয়া বা না হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন পর্ষদ গঠন করে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি) চিঠি দিয়েছে। চিঠিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, আমানতকারী ও ব্যাংকের স্বার্থ রক্ষা এবং ব্যাংকিং সুশাসন নিশ্চিতে ন্যাশনাল ব্যাংকের পর্ষদ নতুন পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হলো।
ন্যাশনাল ব্যাংকের নতুন পর্ষদে সাতজন পরিচালকের পাশাপাশি দুজন উদ্যোক্তা পরিচালক ও একজন উদ্যেক্তা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি রাখা হয়েছে।
নতুন করে যাদের পরিচালক করা হয়েছে তারা হলেন—প্রিমিয়ার ব্যাংকের সাবেক এমডি মোহাম্মদ রিয়াজুল করিম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ কে এম তফাজ্জল হক, ব্যবসায়ী এরশাদ মাহমুদ, আইনজীবী এহসানুল করিম। শেয়ারধারী তিন উদ্যোক্তা পরিচালক খলিলুর রহমান, সিকদার ইনস্যুরেন্স কোম্পানির পক্ষে প্রতিনিধি পরিচালক সফিকুর রহমান ও উদ্যোক্তা শেয়ারধারী পরিচালক মোয়াজ্জেম হোসেন।
এ ছাড়া স্বতন্ত্র পরিচালক করা হয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির সাবেক কমিশনার হেলাল উদ্দিন নিজামী, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক জহুরুল হুদা ও হিসাববিদ রত্না দত্তকে।
পর্ষদ পুনর্গঠনের কারণে ব্যাংক থেকে বাদ পড়েছেন অধ্যাপক সৈয়দ ফারহাত আনোয়ার, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম, সাউথইস্ট ব্যাংকের সাবেক এমডি এম কামাল হোসেন ও পারভীন হক সিকদার।
ন্যাশনাল ব্যাংকের মালিকানায় থাকা সিকদার গ্রুপের বিরুদ্ধেই এত দিন অনিয়মের নানা অভিযোগ ছিল। শেষ পর্যন্ত সিকদার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হওয়ার পর গত ২১ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সুপারিশে ন্যাশনাল ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ন্যাশনাল ব্যাংকের বিদ্যমান পর্ষদ ভেঙে দিয়ে নতুন পর্ষদও গঠন করে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে সিকদার পরিবারের অন্য সদস্যদের সরিয়ে দিয়ে শুধু পারভীন হক সিকদারকে রাখা হয়। এবার তাকেও সরিয়ে দেওয়া হলো। তবে সিকদার গ্রুপের প্রতিনিধি পর্ষদে আছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক প্রথমে বেসরকারি খাতের এক্সিম ব্যাংককে ডেকে সমস্যায় জর্জরিত ন্যাশনাল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার পরামর্শ দেয়। তবে এক্সিম ব্যাংক দুর্বল হিসেবে পরিচিত পদ্মা ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার আগ্রহ দেখালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাতে রাজি হয়।
এরপর গত ১৪ মার্চ ইসলামি ধারার এক্সিম ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ আলাদা বৈঠক করে একে অপরের সঙ্গে একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানায়। পরে গভর্নরের উপস্থিতিতে দুই ব্যাংকের মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়।
এরপর ৩ এপ্রিল বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) এবং সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল) একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়। ৮ এপ্রিল বেসরকারি সিটি ব্যাংকের সঙ্গে সরকারি খাতের সমস্যাগ্রস্ত বেসিক ব্যাংক এবং সর্বশেষ ৯ এপ্রিল ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) সঙ্গে ন্যাশনাল ব্যাংককে একীভূত করার সিদ্ধান্ত আসে।
জানা যায়, গত ২৭ এপ্রিল ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় সিদ্ধান্ত হয়, কোনো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে চায় না বেসরকারি খাতের এই ব্যাংকটি। এর পরিবর্তে খেলাপি ঋণ ও সাধারণ ঋণ আদায় জোরদারসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে নিজেদের অবস্থার উন্নতি করতে চায় ব্যাংকটি।
পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে ন্যাশনাল ব্যাংকের সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান অধ্যাপক সৈয়দ ফারহাত আনোয়ার এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “আমি দেশের বাইরে একটি সেমিনারে আছি, খুব বেশি কথা বলতে পারব না। আমরা পদত্যাগ করেছি ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে।”
দায়িত্ব নেওয়ার সাড়ে চার মাসের মধ্যে কোন কারণে পদত্যাগ করলেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘“এর উত্তর বাংলাদেশ ব্যাংক দিবে। আপনি বাংলাদেশ ব্যাংককে জিজ্ঞাসা করতে পারেন।”
১৯৮৩ সালে প্রায় একই সময়ে গঠিত ইউসিবিএলের সঙ্গে একীভূত হওয়া নিয়ে আলোচনা এবং এনবিএলের পর্ষদে এর বিরোধিতা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের মধ্যে পর্ষদ ভেঙে দেওয়া ও পুর্নগঠনের খবর এল।
এর আগে আগের পর্ষদ ভেঙে দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক গত ২১ ডিসেম্বর অনিয়ম ও দুনীর্তির অভিযোগে ধুঁকতে থাকা এনবিএলের চেয়ারম্যান করেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ ফারহাত আনোয়ারকে, যিনি তখন মেঘনা ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক ছিলেন।
নিয়ম ও বিধি ভাঙাসহ বিভিন্ন কারণ তুলে ধরে নানা অনিয়মে ধুঁকতে থাকা বেসরকারি ন্যাশনাল ব্যাংক গত ২০২৩ সালেও প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। আগের বছরে লোকসান দিয়েছিল তিন হাজার ২০০ কোটি টাকা।
গত ২১ ডিসেম্বর এনবিএল এর পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছিল, ঋণ বিতরণে নিয়ম না মানা, বিধি-বিধান ভেঙে ঋণ অনুমোদন, ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় পর্ষদের অনাকঙ্খিত হস্তক্ষেপ করা এবং পর্ষদের ক্ষমতার অপব্যবহার করার বিষয়গুলো।
কমেন্ট