ব্যাংক ঋণের সুদহার বাজারভিত্তিক হবে: গভর্নর
রবিবার এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার এ তথ্য বলেন, “নতুন নিয়মটি বাস্তবায়নের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।”
ব্যাংক ঋণের সুদহারের বর্তমান নিয়ম থেকে সরে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক; সুদহার হবে বাজারভিত্তিক। ব্যাংকই ঠিক করবে সুদের হার কত হবে।
রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে রবিবার এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার এ কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, নতুন নিয়মটি বাস্তবায়নের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত বছরের ১ জুলাই থেকে সুদহার নির্ধারণে নতুন নিয়ম চালু করে। এই নিয়মে সুদহার নির্ধারণ হচ্ছে ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের গড় সুদের ওপর। যার নাম ‘সিক্স মান্থ মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল’ (ট্রেজারি বিলের ছয় মাসের চলমান গড়) বা স্মার্ট রেফারেন্স রেট। ৯ মাস না যেতেই ‘স্মার্ট রেট’ থেকে সরে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
‘ফার্স্ট ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স ঢাকা’ শীর্ষক দুই দিনের এই সম্মেলন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ ও বণিক বার্তা যৌথভাবে আয়োজন করেছে।
সম্মেলনে ‘ফিসক্যাল অ্যান্ড মনিটরি পলিসিস ইন দ্যা ইভলভিং ইকোনোমিক অর্ডার’ শীর্ষক অধিবেশনে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক তিন গভর্নর, সাবেক সচিব ও অর্থনীতিবিদরা অংশ নেন। এতে মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতির মধ্যে সমন্বয় না হওয়ার দুর্বলতা এবং সেগুলোর সমাধানের বিষয়ে উঠে আসা বিভিন্ন প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়।
এ অধিবেশনে গভর্নর রউফ তালুকদার কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রবর্তিত ‘স্মার্ট’ সুদহার পদ্ধতি থেকে সরে আসার ইঙ্গিত দিলেন। চলতি মাস থেকেই তা কার্যকর হওয়ার আভাসও মিলল।
তিনি বলেন, ‘‘সুদহার সীমা তুলে নেওয়া হবে। ব্যাংকগুলো চাহিদা ও যোগানের ভিত্তিতে ব্যাংক ঋণের সুদহার ঠিক করবে। ঋণের সুদে কোনো বিধি নিষেধ থাকবে না।”
২০২০ সালের এপ্রিলের আগে ব্যাংক খাতে উচ্চ হারে সুদহার নেওয়া হত। এতে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি ব্যবসায় খরচ বাড়ছে; এমন যুক্তি দেখিয়ে ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ এবং আমানতের সুদহার ৬ শতাংশ বেঁধে দেয় সরকার। ওই বছরের এপ্রিল থেকে শুরু হয় আলোচিন ‘নয়-ছয়’ সুদহার।
পরে মূল্যস্ফীতির উচ্চ হার সামাল দেওয়া এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ নেওয়ার সময় সংস্থাটির শর্তে ঋণের সুদহারের ৯ শতাংশের সীমা তুলে নেওয়া হয় গত বছরের জুলাইতে।
তখন থেকে প্রতিমাসে ‘স্মার্ট’ রেট প্রকাশ করে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত বছরের জুন ও জুলাইয়ে মাসে যা ছিল ৭ দশমিক ১০ শতাংশ এবং সবশেষ এপ্রিলে ছিল ১০ দশমিক ৫৫ শতাংশ।
‘স্মার্ট’ প্রকাশের পর থেকে এ পর্যন্ত ৯ মাসে বেড়েছে ৩ দশমিক ৪৫ বেসিস পয়েন্ট বা ৪৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ। এতে সর্বোচ্চ ১৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ সুদহার নেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
বর্তমানে ‘স্মার্ট (সিক্স মান্থস মুভিং এভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিলস- স্মার্ট)’ এর সঙ্গে সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ মার্জিন যোগ করে ঋণ সুদ ঠিক করতে পারে ব্যাংক।
আইএমএফের শর্ত বাস্তবায়নে বাজারভিত্তিক সুদহার ব্যবস্থা ফের চালু করার ইঙ্গিত দিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর।
অধিবেশনে বিনিময় হার প্রসঙ্গে গভর্নর আব্দুর রউফ বলেন, ক্রলিং পেগ পদ্ধতিতে বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্গে স্থানীয় মুদ্রা টাকার বিনিময় হার নির্ধারণ করা হবে। এরপরই বাজারভিত্তিক বিনিময় হার ব্যবস্থায় যাবে বাংলাদেশ।
সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতির চেয়ে সরকারের ব্যর্থতা বেশি। মন্ত্রণালয়গুলো একেক রকম ঘোষণায় বাজারের সরবরাহ ব্যবস্থা প্রভাবিত হয়েছে।
মুদ্রানীতির কার্যকর ফল পেতে বাংলাদেশকে নীতিগত বিষয়ে শক্ত অবস্থানে থাকার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্বশাসন তো দেওয়া আছে। সবকিছু পুরোটা দিয়ে দেওয়া হয় না, অর্জন করতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংককে তা এখন অর্জন করতে হবে।”
সালেহউদ্দিন আরও বলেন, “আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ফাঁদ থেকে সরকার বেরিয়ে আসতে পারেনি। সংস্থাটি সার ও জ্বালানিতে ভর্তুকি কমাতে সুপারিশ করেছে। ডিজেলের দাম বাড়াতে বলেছে। তাদের সব পরামর্শ শোনা যাবে না।
বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) প্রসঙ্গে সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, একজন বিদেশি বিনিয়োগকারীকে নিবন্ধনের জন্য ১২ জায়গায় যেতে হয়। এখানকার চেয়ার, টেবিল, দরজা সবাই টাকা চায়। দেশের মানুষ নিজ দেশে বিনিয়োগ করে না, বাইরের মানুষ কীভাবে বিনিয়োগ করবে। দেশে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির মারাত্মক অভাব।
“বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর রাজনৈতিক ও বিশেষ গোষ্ঠীর প্রভাব রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে মাঝেমধ্যে সাহস দেখাতে হবে।”
মূল্যস্ফীতের তাপ মানুষের গায়ে লাগছে মন্তব্য করে আরেক সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান বলেন, “বাজারে গেলে তাপ লাগে। একজন গৃহবধূ যখন বাজারে যান, নিত্যপণ্যের মূল্যের ঊর্ধ্বগতির আঁচ ওই গৃহবধূর গায়ে লাগে।”
মূল্যস্ফীতি কমাতে পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দেন তিনি।
তার কথার সমর্থনে আব্দুর রউফের আগে সবশেষ গভর্নরের দায়িত্ব পালন করা ফজলে কবির বলেন, “মূল্যস্ফীতির আঘাত সবচেয়ে বেশি লাগে দরিদ্র ও নির্ধারিত আয়ের মানুষের। মূল্যস্ফীতি কারও জন্যই ভালো না। এটি ব্যবসায়ীদের জন্য ভালো না।”
মূল্যস্ফীতি উসকে দিতে সরকারের নেওয়া কিছু পদক্ষেপের কথাও উঠে আসে আলোচনায়।
জ্বালানি ও কৃষি খাতে সার বাবদ ভর্তুকি দিতে ব্যাংকগুলোকে তাদের পাওনার বিপরীতে সরকার ২০ হাজার কোটি টাকার বন্ড ইস্যু করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ বন্ড বাজারে ছাড়ে।
সাবেক অর্থ সচিব ও মহা-হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী বলেন, ‘‘এভাবে ২০ হাজার কোটি টাকার সরকারের বন্ড বাজারে এক লাখ কোটি টাকার কাজ করছে। এটিও টাকা ছাপানোর মতো। এভাবে টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দিলে মূল্যস্ফীতি কীভাবে কমবে।”
এর উত্তরে গভর্নর আব্দুর রউফ বলেন, গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দিচ্ছে না। বাণিজ্যিক ব্যাংক ঋণ দিচ্ছে। আর বন্ড ছাড়া মানে টাকা ছাপানো কি না তা গবেষণার দাবি রাখে।
সাবেক অর্থ সচিব মোহাম্মদ তারেক বলেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সক্ষমতা বাড়াতে হবে। নইলে আগামী বাজেটেও সরকারকে বেশির ভাগ অর্থ ধার করতে হবে।
অনুষ্ঠানের দর্শক সারিতে ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউর রহমান। প্রশ্নোত্তরপর্বে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা নিয়ে নানারকম তথ্য আসছে বলে উল্লেখ করেন।
তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য একটি কার্যকর পদ্ধতি বের করতে গভর্নরকে পরামর্শ দেন।
জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী দুদিনব্যাপী এই সম্মেলনের উদ্বোধন করেন।
তিনি বলেন, “বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সংগ্রাম করতে হচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশকেও একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক রাজনীতিসহ নানা সমস্যার মধ্যেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।”
“বড় বড় মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশ। অর্থনীতি, সামাজিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সব সূচকে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। এখন বাংলাদেশের উন্নয়ন অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের জন্য রোল মডেল।”
কমেন্ট