‘ন্যাশনাল ব্যাংক দখল হয়নি, একীভূতও হবে না’
‘হঠাৎ করে কি হলো? এক পর্ষদ ভেঙে আরেক পর্ষদ গঠন! ব্যাংকটি কি আপনারা দখল করেছেন?—এক সাংবাকিদের এই প্রশ্নের উত্তরে নতুন চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান বলেন, “ন্যাশনাল ব্যাংক দখল হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাংকে পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।”
সংকটে থাকা বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ গঠন করে দেওয়ার সাড়ে চার মাসের মাথায় আবার পুনর্গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকটির নতুন চেয়ারম্যান হয়েছেন উদ্যোক্তা পরিচালক ও চট্টগ্রামের কেডিএস গ্রুপের চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান।
একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত নিয়ে টানাপোড়েনের মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যানসহ বেশির ভাগ পরিচালক পদত্যাগ করেছেন। বৃহস্পতিবার তারা পদত্যাগের পর রবিবার নতুন পর্ষদ গঠন করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
চার মাসের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়োগ দেওয়া পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে আরেকটি গঠন নিয়ে ব্যাপক আলোচনার মধ্যে নতুন চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান বলেছেন, ন্যাশনাল ব্যাংক দখল হয়নি এবং কোনো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূতও হবে না।
সোমবার রাজধানীর বাংলামোটরে ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।
‘হঠাৎ করে কি হলো? এক পর্ষদ ভেঙে আরেক পর্ষদ গঠন! ব্যাংকটি কি আপনারা দখল করেছেন?—এক সাংবাকিদের এই প্রশ্নের উত্তরে নতুন চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান বলেন, “ন্যাশনাল ব্যাংক দখল হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাংকে পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।”
তিনি বলেন, “ন্যাশনাল ব্যাংক অন্য কোনো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হবে না। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। এর আগে যা হওয়ার হয়েছে, আর কোনো লুটপাট হবে না। ব্যাংক থেকে যারা টাকা নিয়েছেন, তাদের টাকা ফেরত দিতে হবে। এক বছরের মধ্যে আমরা ব্যাংকটিকে আগের অবস্থায় নিতে পারব।”
খলিলুর রহমান বলেন, “আমরা আল্লাহর ওপর ভরসা করে চলেছি। অতীতে এ ব্যাংকে লুটপাট হলেও এখন থেকে আর এক পয়সাও লুটপাট হবে না।”
এর আগে সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে, বেসরকারি ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) সঙ্গে ন্যাশনাল ব্যাংককে একীভূত করা হবে।
এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে খলিলুর রহমান বলেন, “আমরা একীভূত হতে রাজি নই। বাংলাদেশ ব্যাংককেও এ কথা জানিয়েছি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাতে রাজি হয়েছে। তবে শর্ত দিয়েছে যে, এক বছরের মধ্যে ব্যাংককে দুর্বল অবস্থা থেকে ভালো করতে হবে। ফলে এখন আমরা একীভূত করার অবস্থা থেকে মুক্ত।”
তিনি বলেন, “আমরা প্রাথমিকভাবে শেয়ারধারী ব্যক্তিদের মাধ্যমে ব্যাংকে এক হাজার কোটি টাকা মূলধন সরবরাহ করব। এ ছাড়া পরবর্তী সময় বিভিন্নভাবে আমরা আরও তিন হাজার কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করব। এই আমানত সংগ্রহ করা হবে প্রচারণা ও প্রকল্পের মাধ্যমে। এতে ন্যাশনাল ব্যাংকের চলমান তারল্য–সংকট নিরসন হবে বলে আশা করা হচ্ছে।”
খারাপ হয়ে যাওয়া ঋণ পুনঃরুদ্ধারকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হবে জানিয়ে খলিলুর রহমান বলেন, “খারাপ ঋণ পুনরুদ্ধারে কাউকেই কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।”
সংবাদ সম্মেলনের শুরুতেই ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তৌহিদুল আলম খান সাংবাদিকদের জানান, চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নরের সঙ্গে মিটিংয়ের জন্য বের হবেন। এ কারণে তিনি বেশি সময় দিতে পারবেন না। এরপর একে একে নতুন পর্ষদের সব সদস্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন এমডি তৌহিদুল আলম খান।
পরিচয় পর্ব শেষে ব্যাংকের চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান বক্তব্য দেন। এক বছরের মধ্যে ব্যাংকটিকে আগের মতো ভালো অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার আশাও ব্যক্ত করেন ন্যাশনাল ব্যাংকের নতুন চেয়ারম্যান। এসময় তিনি জোর দিয়ে বলেন, নতুন করে এক টাকাও খেলাপি হবে না। খেলাপি ঋণ আদায়েও প্রত্যয় ব্যক্ত করেন নতুন চেয়ারম্যান।
তবে সাংবাদিকদের প্রশ্নের এক পর্যায়ে ‘ভড়কে যান’ পর্ষদ সদস্যরা। সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে চেয়ারম্যানের কাছে জানতে চাওয়া হয় ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রতিনিধি পরিচালকরা কোন কোন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি হয়ে এসেছেন। ওই সব প্রতিষ্ঠানের হাতে ন্যাশনাল ব্যাংকের কত শতাংশ শেয়ার রয়েছে।
তবে এই প্রশ্নের উত্তর তাৎক্ষণিকভাবে দিতে ব্যর্থ হন চেয়ারম্যান। এসময় এমডি তৌহিদুল আলম খান বলেন, এই বিষয়ক তথ্য তাদের কোম্পানি সচিব দিতে পারবেন।
তবে সাংবাদিকরা কোম্পানি সচিবের পরিবর্তে ব্যাংকের চেয়ারম্যানের কাছ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে ওই প্রশ্নের জবাব চান।
এ পর্যায়ে সংবাদ সম্মেলন থেকে উঠে যান চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান। এসময় তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে বৈঠক আছে বলে দাবি করেন।
ব্যাংকটির নতুন পরিচালক আহসানুল করিম বলেন, “আগামী এক বছরের মধ্যে আমরা ন্যাশনাল ব্যাংকে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন দেখতে চাই। অতীতে যারা পরিচালনা পর্ষদে ছিলেন, তাদের নিজেদের স্বার্থ ছিল। এ কারণে তারা নিজেদের স্বার্থে কাজ করে ব্যাংককে দুর্বল করেছেন। আর আমরা দেশের স্বার্থে কাজ করতে পরিচালনা পর্ষদে দায়িত্ব নিচ্ছি।”
১৯৮৩ সালে প্রথম দেশীয় মালিকানায় বেসরকারি ব্যাংক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড। বর্তমানে ব্যাংকটির ২২১টি শাখা ও ৬৫টি উপশাখা রয়েছে। এ ছাড়া দেশের মধ্যে দুটি ও দেশের বাইরে চারটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান, জিসিসি (উপসাগরীয় দেশগুলোর সহযোগিতা সংস্থা) অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্রে দুটি অর্থ স্থানান্তর প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ, ব্যবস্থাপনা চুক্তিসহ দেশের অভ্যন্তরে নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) এবং রেটিং প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের মাধ্যমে ব্যাংকটি ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে।
বর্তমানে ব্যাংকটিতে ২০ লাখ আমানতকারী ও ১ লাখ ঋণগ্রহীতা আছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেসরকারি খাতের ইউসিবি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে বাংলাদেশ ব্যাংক যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তাতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন কয়েকজন পরিচালক। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশে পদত্যাগ করেন তিনজন পরিচালক। এর বাইরে সিকদার পরিবারের সদস্য পারভীন হক সিকদারকে নতুন করে পরিচালক করেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। এর পরিবর্তে ব্যাংকটিতে নতুন পর্ষদ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ন্যাশনাল ব্যাংকের মালিকানায় থাকা সিকদার গ্রুপের বিরুদ্ধেই এত দিন অনিয়মের নানা অভিযোগ ছিল। শেষ পর্যন্ত সিকদার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হওয়ার পর গত ২১ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সুপারিশে ন্যাশনাল ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ন্যাশনাল ব্যাংকের বিদ্যমান পর্ষদ ভেঙে দিয়ে নতুন পর্ষদও গঠন করে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে সিকদার পরিবারের অন্য সদস্যদের সরিয়ে দিয়ে শুধু পারভীন হক সিকদারকে রাখা হয়। এবার তাকেও সরিয়ে দেওয়া হলো। তবে সিকদার গ্রুপের প্রতিনিধি পর্ষদে আছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক প্রথমে বেসরকারি খাতের এক্সিম ব্যাংককে ডেকে সমস্যায় জর্জরিত ন্যাশনাল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার পরামর্শ দেয়। তবে এক্সিম ব্যাংক দুর্বল হিসেবে পরিচিত পদ্মা ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার আগ্রহ দেখালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাতে রাজি হয়।
এরপর গত ১৪ মার্চ ইসলামি ধারার এক্সিম ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ আলাদা বৈঠক করে একে অপরের সঙ্গে একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানায়। পরে গভর্নরের উপস্থিতিতে দুই ব্যাংকের মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়।
এরপর ৩ এপ্রিল বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) এবং সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল) একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়। ৮ এপ্রিল বেসরকারি সিটি ব্যাংকের সঙ্গে সরকারি খাতের সমস্যাগ্রস্ত বেসিক ব্যাংক এবং সর্বশেষ ৯ এপ্রিল ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) সঙ্গে ন্যাশনাল ব্যাংককে একীভূত করার সিদ্ধান্ত আসে।
জানা যায়, গত ২৭ এপ্রিল ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় সিদ্ধান্ত হয়, কোনো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে চায় না বেসরকারি খাতের এই ব্যাংকটি। এর পরিবর্তে খেলাপি ঋণ ও সাধারণ ঋণ আদায় জোরদারসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে নিজেদের অবস্থার উন্নতি করতে চায় ব্যাংকটি।
এক সপ্তাহ পর রবিবার আগের পর্ষদ ভেঙে দিয়ে নতুন পর্ষদ গঠন করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
কমেন্ট