বাড়তি সুদ গুনেও কেন বেসরকারি ঋণে প্রবৃদ্ধি হলো
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের নবম মাস মার্চে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ। গত নয় মাসের মধ্যে অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের মধ্যে এই হার এটাই সবচেয়ে বেশি।
ব্যাংক ঋণের সুদের হার বৃদ্ধি এবং অর্থনীতির চলমান সংকটের মধ্যে দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি খানিকটা বেড়েছে; দুই মাস পর তা উঠেছে দুই অঙ্কের (ডাবল ডিজিট) ঘরে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সোমবার বেসরকারি খাতে ঋণের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের নবম মাস মার্চে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ।
গত নয় মাসের মধ্যে অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের মধ্যে এই হার এটাই সবচেয়ে বেশি। আগের মাস ফেব্রুয়ারিতে এই হার ছিল ৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ; জানুয়ারিতে ছিল ৯ দশমিক ৯৫ শতাংশ।
১০ দশমিক ৫৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে গত ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষ হয়েছিল। চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৯ দশমিক ৮২ শতাংশ।
রোজা ও ঈদকে সামনে রেখে আমদানি ও ব্যবসায়িক লেনদেন বেড়ে যাওয়ায় বেসরকারি ঋণ বেড়েছে বলে মনে করছেন ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদরা। তবে দেশের বর্তমান অবস্থায় আগামী মাসগুলোতে ঋণ বাড়ার সম্ভাবনা দেখছেন না তারা।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ব্যাংকের নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক সভাপতি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের গত দুই বারের মুদ্রানীতি ছিল সঙ্কোচনমুখী। ফলে সকল ধরনের ঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধিও কম ছিল।
তাহলে মার্চে বাড়ল কেন- তার ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “মার্চে রমজানের কারণে খাদ্য পণ্য আমদানি বেড়েছে। এছাড়া রমজানের ঈদকে সামনে রেখে গ্রাহক পর্যায়ে কনজ্যুমার লোনের পরিমাণও বেড়েছে। এসব কারণে বেসরকারি খাতের ঋণের গ্রোথ কিছুটা বেড়েছে।”
নিজের বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে মাহবুবুর বলেন, “রোজা ও ঈদকেন্দ্রিক ঋণের গ্রোথ বাড়লেও পরের মাস এপ্রিলে কিন্তু কমেছে। এপ্রিলের তথ্য প্রকাশ হলে সেটা দেখতে পাওয়া যাবে। কারণ এখন দেশের অর্থনীতি ও বৈশ্বিক বাজারে মন্থর গতি চলছে, এ কারণে ব্যবসায়ীরা নতুন করে ব্যবসা সম্প্রসারণ কম করছেন।”
ব্যাংক ঋণে সুদ হার বৃদ্ধির চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, সুদহার গত বছরের জুলাইয়ে ৯ টাকা ছিল। প্রতি মাসে প্রায় এক টাকা করে বেড়ে এখন প্রায় ১৪ টাকা হয়েছে।
২১ মাস পর ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি এক অঙ্কের (সিঙ্গেল ডিজিট) ঘরে (৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ) নেমে আসে। আগস্টে তা আরও কমে নামে ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশে। সেপ্টেম্বরে আরও খানিকটা কমে ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশে নামে।
পরের মাস অক্টোবরে এই সূচক বেড়ে দুই অঙ্কের (ডাবল ডিজিট) ঘরে (১০ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ) উঠেছিল। নভেম্বরে তা ফের এক অঙ্কের ঘরে (৯ দশমিক ৯০ শতাংশ) নেমে আসে। ডিসেম্বরে ফের দুই অঙ্কের ঘরে (১০ দশমিক ১৩ শতাংশ) ওঠে।
২০২২-২৩ অর্থবছরের শেষার্ধের (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরেছিল ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ।
লক্ষ্যের অনেক পেছনে থাকায় গত বছরের ১৮ জুন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছিল, তাতে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য কমিয়ে ১১ দশমিক ১০ শতাংশে নামিয়ে আনে।
তবে মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে গত ১৭ জানুয়ারি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) জন্য সঙ্কোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই মুদ্রানীতিতে আগামী জুন পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশে আটকে রাখার লক্ষ্য ধরা হয়।
তবে, প্রথম দুই মাস লক্ষ্যের মধ্যে থাকলেও মার্চে ঋণের প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়েছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “মার্চে ঋণ যেটা বেড়েছে, সেটা রোজা ও ঈদের কারণে। এটাকে আমলে নিলে চলবে না। এপ্রিলে ঠিকই কমে আসবে এবং আগামী দিনগুলোতে কমবে।”
বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার জন্য দুটি কারণ চিহ্নিত করেন তিনি।
“একটি হচ্ছে, ব্যাংকগুলোতে আমানতের প্রবৃদ্ধি ক্রমান্বয়ে কমছে এবং এর ফলে ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে ভুগছে। আর আরেকটি কারণ হলো, বেসরকারি ব্যাংক থেকে সরকারি ঋণ নেওয়া, যা বেসরকারি খাতে সরাসরি প্রভাব ফেলেছে।”
ব্যাংক ঋণের সুদের হার বেড়ে যাওয়া বেসরকারি ঋণগ্রহণ নিরুৎসাহিত করছে বলেও মনে করেন আহসান মনসুর।
বেশ কয়েক মাস ধরে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহে মন্থরগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দুই বছরের কোভিড মহামারীর ধকল কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিল বাংলাদেশের অর্থনীতি। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেশ ভালোই বাড়ছিল বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি।
আহসান মনসুর বলেন, “করোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকার যে প্রণোদনা ঘোষণা করেছিল, তাতে এর অবদান ছিল। এছাড়া করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় দেশে বিনিয়োগের একটি অনুকূল পরিবেশও দেখা দিয়েছিল।
“পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু কর্ণফুলী টানেলসহ কয়েকটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলকে ঘিরে উদ্যোক্তারা নতুন পরিকল্পনা সাজিয়ে বিনিয়োগে নেমেছিলেন। ব্যাংকগুলোও তাতে বিনিয়োগ করছিল। সব মিলিয়ে বেসরকারি খাতের ঋণের একটি গতি এসেছিল।”
২০২২ সালের আগস্টে প্রবৃদ্ধি ১৪ দশমিক শূন্য সাত শতাংশে উঠেছিল। এরপর থেকে কমছেই।
২০২৩ সালের মে মাসে এই প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১১ দশমিক ১০ শতাংশ। তার আগের মাস এপ্রিলে ছিল ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ। মার্চে ছিল ১২ দশমিক শূন্য তিন শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ দশমিক ১৪ শতাংশ। জানুয়ারিতে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১২ দশমিক ৬২ শতাংশ।
২০২২ সালের ডিসেম্বরে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ দশমিক ৮৯ শতাংশ। নভেম্বরে ছিল ১৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ। অক্টোবর, সেপ্টেম্বর ও আগস্টে ছিল যথাক্রমে ১৩ দশমিক ৯১ শতাংশ, ১৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ ও ১৪ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, ২০২১ সালের শেষ মাস ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ৬৮ শতাংশ। তার আগের মাস নভেম্বরে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ১১ শতাংশ; অক্টোবরে ৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ আর সেপ্টেম্বরে হয়েছিল ৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ। আগস্ট ও জুলাইয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল যথাক্রমে ৮ দশমিক ৪২ শতাংশ ও ৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ।
মহামারীর ধাক্কায় কমতে কমতে ওই বছরের মে মাসে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি একেবারে তলানিতে, ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশে নেমে এসেছিল।
আহসান মনসুর বলেন, “ডলার সংকটের কারণে উদ্যোক্তারা মূলধনী যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারি), শিল্পের কাঁচামালসহ প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করতে পারছেন না। অন্যদিকে ডলারের দর অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় আমদানিকারকদের এলসি খুলতে বেশি টাকা লাগছে। তাতে ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেছে।
“বিশ্ববাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম এবং ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধিতে বেসরকারি খাতের ঋণের বড় অংশ চলে যাচ্ছে আমদানি খাতে। এতে করে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি যেটা হচ্ছে, সেটা মূলত অর্থনীতির বহিঃস্থ খাতের অস্থিরতার কারণে হচ্ছে।”
তিনি বলেন, “বিশাল অঙ্কের খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোকে নিরাপত্তা সঞ্চিতি বেশি রাখতে হচ্ছে। আশানুরূপ আমানত পাচ্ছে না। অনেক ব্যাংক তারল্য সংকটে রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন সংকটে দেশে উৎপাদন কমেছে।
“সব মিলিয়ে যারা ঋণ নিতে চান, তাদের অনেককে ব্যাংক ঋণ দিতে আগ্রহী নয়। আবার যাদের ঋণ দিতে আগ্রহী ব্যাংক, তারা আপাতত ঋণ নিতে চাচ্ছে না। এসব কারণে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ভাটা পড়েছে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ১০ মাসে (২০২৩ সালে ১ জুলাই থেকে চলতি বছরের ৩০ এপ্রিল) বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সরকারের নেওয়া মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা।
এই সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কোনও ঋণ নেয়নি সরকার। উল্টো আগের ঋণের ২০ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। ফলে সরকারের নিট ব্যাংক ঋণ দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা।
অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস (জুলাই-ডিসেম্বর) পর্যন্ত সরকারের নিট ব্যাংক ঋণ ছিল সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা ঋণাত্মক (-)।
বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ কমে যাওয়ার প্রভাব আগামী দিনে উৎপাদন এবং কর্মসংস্থানে পড়বে বলে সরকারকে সতর্ক করেছেন আহসান মনসুর।
“সে ক্ষেত্রে সরকার চলতি অর্থবছরেও ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের যে লক্ষ্য ধরেছে, সেটা অর্জন কোনোভাবেই সম্ভব হবে না,” বলেন তিনি।
কমেন্ট