নীতি সুদহার বেড়ে ৮.৫০ শতাংশ, ‘স্মার্ট’ বাতিল
আরেক সার্কুলারে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণের সুদহার নির্ধারণের পদ্ধতি স্মার্ট (সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল) প্রত্যাহার করেছে।
মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে নীতি সুদহার বা রেপো আরও বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মুদ্রানীতি কমিটির সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নীতি সুদহার বিদ্যমান শতকরা ৮ শতাংশ থেকে ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৮ দশমিক ৫০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।
বুধবার সুদহার বাজারভিত্তিক করার দিনই এক সার্কুলার জারি করে এ সিদ্ধান্ত জানাল বাংলাদেশ ব্যাংক।
আরেক সার্কুলারে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণের সুদহার নির্ধারণের পদ্ধতি স্মার্ট (সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল) প্রত্যাহার করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, ব্যাংকঋণের সুদহার সম্পূর্ণ বাজারভিত্তিক করার লক্ষ্যে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
নীতি সুদহার বাড়ানোর ঘোষণা দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, নীতি সুদের করিডরের ঊর্ধ্বসীমা এবং নিম্নসীমাও বাড়ানো হয়েছে। পরিপত্রে বলা হয়েছে, নীতি সুদহারের ঊর্ধ্বসীমা স্ট্যান্ডিং ল্যান্ডিং ফ্যাসিলিটির (এসএলএফ) ক্ষেত্রে সুদহার ৯ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে ৫০ ভিত্তি পয়েন্ট বৃদ্ধি করে ১০ শতাংশ এবং নীতি সুদহার করিডরের নিম্নসীমা স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি (এসডিএফ) ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে ৫০ ভিত্তি পয়েন্ট বৃদ্ধি করে ৭ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই সিদ্ধান্ত বৃহস্পতিবার থেকে কার্যকর হবে।
পাঁচ মাসের ব্যবধানে আবারও নীতি সুদহার হিসেবে পরিচিত রেপো বাড়িয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সার্কুলার দিয়ে বলেছে, ‘‘মনিটারি পলিসি কমিটির তৃতীয় সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক ওভারনাইট রেপো নীতি সুদহার বিদ্যমান শতকরা ৮ শতাংশ থেকে ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৮.৫০ শতাংশ নির্ধারণ করা হল।’’
এর ফলে তারল্যে সংকটে পড়া কোনো বাণিজ্যিক ব্যাংক প্রয়োজনে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যে টাকা ধার করবে, সেটির সুদহার বাড়বে। অর্থাৎ সংকোচনমূলক মুদ্রা সরবরাহে আরও চাপ বাড়ালো বাংলাদেশ ব্যাংক।
এদিনই সুদহার বাজারভিত্তিক করার অংশ হিসেবে ব্যাংক ঋণের সুদহার সীমা ‘স্মার্ট (সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল-স্মার্ট) তুলে নেওয়া হয়। এতে এক দিনেই ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে ৭ টাকা। প্রধান বিদেশি মুদ্রা প্রতি ডলারের দাম ধরা হয় ১১৭ টাকা।
মূল্যস্ফীতির চাপ সামাল দেওয়ার চলমান উদ্যোগের মধ্যে বাজারে অর্থের যোগান কমাতে সর্বশেষ গত জানুয়ারিতে মুদ্রানীতি ঘোষণায় নীতি সুদহার বাড়িয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তখন সুদহার ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে ২৫ বেসিস পয়েন্ট বেড়ে ৮ শতাংশ করা হয়েছিল।
এক দিন মেয়াদী রেপোর পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিশেষ রেপো সুদহারের (স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি-এসএলএফ) করিডোরের ঊর্ধ্বসীমা ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে; এখন যা ৯ দশমিক ৫০ শতাংশ।
এর আগে গত ১৭ জানুয়ারি এই সুদহার ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে ২৫ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে ৯ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছিল।
আর সুদহার করিডোরের নিম্নসীমা রিভার্স রোপো সুদহার (স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি-এসডিএফ) বিদ্যমান ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে। এতদিন যা ছিল সাড়ে ৬ শতাংশ।
বাজারে উদ্বৃত্ত টাকা থাকলে বাংলাদেশ ব্যাংক রিভার্স রেপোর মাধ্যমে টাকা তুলে নেয়।
গত ১৭ জানুয়ারি এসডিএফ সুদহার ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে ৭৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে সাড়ে ৬ শতাংশ করা হয়েছিল।
নীতি সুদহারের ঊর্ধ্বসীমা ও নিম্ন সীমার মধ্যে ব্যবধান ১৫০ শতাংশ পয়েন্ট অপরির্তীত রেখেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
অর্থাৎ নীতি সুদহার সাড়ে ৮ শতাংশের সঙ্গে সর্বোচ্চ ১৫০ বেসিস পয়েন্ট যোগ করে এসএলএফ সুদহার ও নিচে ১৫০ বেসিস পয়েন্ট বিয়োগ করে এসডিএফ সুদহার নির্ধারণ করা হবে।
তারল্যের প্রয়োজনে বাণিজ্যিক ব্যাংক যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার করে, তখন তার সুদহার ঠিক হয় রেপোর মাধ্যমে। আর রিভার্স রেপোর মাধ্যমে বাংকগুলো তাদের উদ্বৃত্ত অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখে বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাইলে বাজার থেকে অতিরিক্ত তারল্য তুলে নিতে পারে।
এসময় রিভার্স রোপো সুদহার প্রযোজ্য হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে যে সুদহারে দীর্ঘমেয়াদী ঋণ দেয়, তাকে বলে ব্যাংক রেট। এবার ৪ শতাংশের ব্যাংক রেটে পরিবর্তন আনা হয়নি।
মূলত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদহার বাড়ানো হয়। বিষয়টি হলো—কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি মনে করে, সমাজে অর্থের সরবরাহ বেশি এবং সে কারণে মূল্যস্ফীতির পারদ চড়ছে, তাহলে অর্থপ্রবাহ কমাতে নীতি সুদহার বৃদ্ধি করে তারা।
নীতি সুদহার বৃদ্ধির অর্থ হলো—ব্যাংকগুলোকে অতিরিক্ত সুদ দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ করতে হবে। ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের যে ঋণ দেয়, তার সুদহার বাড়ে। নীতি সুদহার বেশি থাকলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার করতে নিরুৎসাহিত হয়। এই নীতি সুদহার হলো রেপো।
এর সঙ্গে রিভার্স রেপো রেটের আলোচনাও প্রাসঙ্গিকভাবে চলে আসে। যেমন—কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি মনে করে বাজারে অতিরিক্ত তারল্য আছে, তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ওই তারল্য তুলে নিতে পারে। এই তুলে নেওয়ার জন্য সুদের নির্দিষ্ট হার থাকে। অর্থ তুলে নেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে যে হারে সুদ দেয়, তাকে বলা হয় রিভার্স রেপো। সাধারণত নীতি সুদহার বা রেপো রেটের তুলনায় রিভার্স রেপোর সুদহার কম থাকে।
অন্যদিকে অপর সার্কুলারে ‘স্মার্ট’ পদ্ধতি বাতিলের কথা জানিয়েছে বলা হয়েছে, ব্যাংক খাতে ঋণের চাহিদা ও ঋণযোগ্য তহবিলের জোগান সাপেক্ষে ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে ঋণের সুদহার নির্ধারিত হবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চ মাসে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসভিত্তিক বা মাসওয়ারি) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ।
ঋণের বাজারভিত্তিক সুদহার নির্ধারণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক পাঁচটি নির্দেশনা পরিপালন করতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে—
>> ব্যাংকগুলো ঋণের খাতভিত্তিক সুদের হার ঘোষণা করবে এবং তুলনামূলক ঝুঁকি বিবেচনায় গ্রাহকভেদে ঘোষিত হার অপেক্ষা ১ শতাংশ কম বা বেশী হারে ঋণ প্রদান করতে পারবে।
>> ঋণের মঞ্জুরীপত্রে উক্ত ঋণের সুদহার অপরিবর্তনশীল (ফিক্সড রেট) বা পরিবর্তনশীল (ভেরিয়েবল রেট) তা উল্লেখ থাকতে হবে। কোনো ঋণের সুদহার পরিবর্তনশীল হলে তা বছরে সর্বোচ্চ কত বার বৃদ্ধি করা হবে এবং উক্ত বৃদ্ধি কত শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে তা আবশ্যিকভাবে মঞ্জুরীপত্রে উল্লেখ থাকতে হবে।
>> কোনো ঋণ অথবা ঋণের কিস্তি সম্পূর্ণ বা আংশিক মেয়াদোত্তীর্ণ (ওভারডিউ) হিসেবে চিহ্নিত হলে যে সময়ের জন্য মেয়াদোত্তীর্ণ হবে, উক্ত সময়ে চলমান ঋণ/তলবী ঋণের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ঋণস্থিতির উপর এবং মেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে মেয়াদোত্তীর্ণ কিস্তির উপর সর্বোচ্চ ১.৫ শতাংশ দন্ড সুদ আরোপ করা যাবে।
>> ব্যাংক কর্তৃক ঘোষিত সুদহারের অতিরিক্ত কোনো সার্ভিস চার্জ আরোপ/আদায় করা যাবে না।
এবং
>> বাংলাদেশ ব্যাংক বা সরকার কর্তৃক গঠিত প্রণোদনা প্যাকেজ/বিশেষ তহবিল/পুনঃঅর্থায়ন/প্রাক-অর্থায়ন তহবিলের আওতায় প্রদত্ত ঋণের সুদহার নির্ধারণে সংশ্লিষ্ট তহবিলের জন্য প্রণীত নীতিমালা প্রযোজ্য হবে।
কমেন্ট