তৃতীয় কিস্তিতে ১১৫ কোটি ডলার দেবে আইএমএফ
একই সাথে সংস্থাটি ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকি কমাতে অগ্রাধিকার দেয়া এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মধ্যে বাস্তব সম্মত কর নীতি প্রণয়নের রাজস্ব বাড়িয়ে কর-জিডিপির অনুপাত দশমিক ৫ শতাংশ বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছে।
বেশ কয়েকটি নতুন শর্তে বাংলাদেশকে ১১৫ কোটি (১.১৫ বিলিয়ন) ডলার ঋণ দিতে রাজি হয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। এই অঙ্ক আগে দেওয়া দুই কিস্তির প্রায় সমান।
বুধবার রাতে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আইএমএফ জানিয়েছে, ৪৭০ কোটি (৪.৭ বিলিয়ন) ডলার ঋণের তৃতীয় কিস্তির বিষয়ে সংস্থাটির কর্মকর্তারা বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের সাথে সমঝোতায় পৌঁছেছে। ঢাকায় সফররত আইএমএফের কর্মকর্তারা যে পর্যালোচনা করেছেন, সেটি সংস্থাটির নির্বাহী বোর্ডে অনুমোদন পেতে হবে।
একই সাথে সংস্থাটি ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকি কমাতে অগ্রাধিকার দেয়া এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মধ্যে বাস্তব সম্মত কর নীতি প্রণয়নের রাজস্ব বাড়িয়ে কর-জিডিপির অনুপাত দশমিক ৫ শতাংশ বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছে।
আইএমএফ'র নির্বাহী বোর্ড অনুমোদন করলে চলতি মাসের শেষ নাগাদ বাংলাদেশ ঋণের পরবর্তী কিস্তিতে ১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার পাওয়ার আশা করছে। এর আগে ৪৭০ কোটি ডলারের মোট ঋণ চুক্তির অংশ হিসেবে দুই কিস্তিতে ১১৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার ঋণ ছাড় করেছে সংস্থাটি।
ঋণ চুক্তি অনুমোদনের পর গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ডলার হাতে পায় বাংলাদেশ। আর গত ১২ ডিসেম্বর দ্বিতীয় কিস্তিতে বাংলাদেশ পায় ৬৮ কোটি ৯৮ লাখ ডলার।
আইএমএফের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার ডলারের দর নির্ধারণের নতুন পদ্ধতি ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি, বিনিময় হার নির্ধারণসহ কিছু সংস্কার এবং সুদহার পূর্ণ উদারীকরণের মতো কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনে আইএমএফ সমর্থিত সংস্কার কর্মসূচি অব্যাহত রাখবে বলে জানিয়েছে সরকার।
গত ২৪ এপ্রিল ঢাকা সফরে আসা আইএমএফের ডেভেলপমেন্ট মাইক্রো ইকোনমিক্স ডিভিশনের প্রধান ক্রিস পাপাগেওর্জিউর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করে।
এসব বৈঠক সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে পর্যালোচনা শেষে মঙ্গলবার অর্থ বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সার্বিকভাবে তৃতীয় কিস্তি ছাড়ের আশ্বাসের পাশাপাশি সংশোধিত কিছু শর্তসহ সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেন তারা।
বুধবার রাত ৯টার দিকে ওয়েবসাইটে বিজ্ঞপ্তি আকারে তাদের বক্তব্য প্রকাশ করেছে আইএমএফ।
সংস্থাটি বলছে যেসব নীতিগত বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া সম্পন্ন করতে হবে সেগুলোর বিষয়ে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের সাথে তাদের কর্মকর্তা পর্যায়ে একটি সমঝোতা হয়েছে।
আইএমএফ সমর্থিত কর্মসূচির আওতায় কাঠামোগত সংস্কারের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি অর্জন করেছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। এর মধ্যে আছে জ্বালানি খাতে মূল্য সমন্বয় ব্যবস্থা।
তবে এ সত্ত্বেও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা, পণ্য ও খাদ্যের আন্তর্জাতিক দাম বৃদ্ধি, কিছু অভ্যন্তরীণ ঝুঁকির কারণে উচ্চ মূল্যস্ফীতি অব্যাহত আছে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে, যা অর্থনীতিতে চাপ তৈরি করছে।
এ অবস্থায় অন্তর্বর্তী পদক্ষেপ হিসেবে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিনিময় হারের বিষয়ে শক্ত পদক্ষেপ এবং একই সাথে ক্রলিং পেগ সিস্টেম চালুর কথা উল্লেখ করেছে সংস্থাটি। বাইরের বা মুদ্রাস্ফীতিজনিত চাপ বাড়লে কর্তৃপক্ষকে আরও শক্ত নীতি নেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছে তারা।
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রকৃত জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৪ শতাংশ হতে পারে বলে উল্লেখ করে আইএমএফ বলেছে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এটি ৬ দশমিক ৬ শতাংশ হতে পারে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
চলতি বছরে মূল্যস্ফীতি প্রায় ৯ দশমিক ৪ শতাংশ থাকবে তবে আগামী অর্থবছরে এটি কমে ৭ দশমিক ২ শতাংশ হতে পারে বলে সংস্থাটি তাদের বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করেছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকি কমানো একটি অগ্রাধিকার। নন পারফর্মিং লোন কমিয়ে আনার কৌশল আর্থিক অগ্রগতিকে সহায়তা করবে যা দেশের অর্থনীতির জন্য দরকার। একই সাথে বাংলাদেশ ব্যাংককে আর্থিক খাতের সক্ষমতা বাড়াতে নজরদারি অব্যাহত রাখতে হবে।
একই সাথে সংস্থাটি বলেছে, বাংলাদেশে কর ও জিডিপির অনুপাত খুবই কম এবং এটি বিবেচনায় নিয়ে সামাজিক কল্যাণ ও উন্নয়ন কার্যক্রমে বিনিয়োগ বাড়াতে টেকসই রাজস্ব প্রবৃদ্ধিতেও অগ্রাধিকার দেয়ার দরকার। এজন্য আগামী বাজেটে বাস্তব কর নীতি ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেয়ার ওপর জোর দিয়েছে তারা।
সংস্থাটি মনে করে, ২০৩১ সাল নাগাদ বাংলাদেশের মধ্যম আয়ের দেশে উন্নতি হওয়ার ক্ষেত্রে সংস্কার অব্যাহত রাখতে হবে। পাশাপাশি বাণিজ্য বৈচিত্র্যকরণ, বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা, বিনিয়োগের পরিবেশ ও সুশাসনের মতো বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দিতে হবে।
একই সাথে তারা মনে করে প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করার চেষ্টার পাশাপাশি সরকারের উচিত জলবায়ু প্রতিক্রিয়া ভিত্তিক আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও গ্রিন অবকাঠামো বিনিয়োগে জোর দেয়া।
আইএমএফ যখনই বাংলাদেশকে কোনো ঋণ দিয়েছে তখনই তারা কিছু শর্ত বা পরামর্শ দিয়েছে। এসব শর্তের কিছু বাংলাদেশে মেনে নিয়েছে আবার কিছু মেনে নেয়নি।
ঋণের ক্ষেত্রে ১৯৯০ সালে আইএমএফ এর বেশ কয়েকটি শর্ত ছিল। সেসব শর্তের আলোকে বাংলাদেশে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) চালু করা হয়।
এছাড়া বাণিজ্য উদারীকরণ, ব্যাংকিং খাতে সংস্কারের শর্তও এসেছিল। এসব প্রক্রিয়ার সাথে বিশ্বব্যাংকও জড়িত ছিল।
১৯৯১ সাল থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ আইএমএফ এর কাছ থেকে কোনো ঋণ নেয়নি।
এরপর বাংলাদেশ আবার আইএমএফ'র কাছে থেকে ঋণ নেয় ২০০৩ সালে।
সেবার বড় শর্ত ছিল, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর লোকসান কমিয়ে আনতে হবে। তখন আইএমএফ এর শর্ত মেনে আদমজী পাটকল বন্ধ করে দিয়েছিল সরকার।
এরপর ২০১২ সালে ঋণ নেয় বাংলাদেশ, যার পরিমাণ ছিল প্রায় এক বিলিয়ন ডলার।
সর্বশেষ ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণের অনুমোদন দেয় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ।
মোট সাত কিস্তিতে এই ঋণ পাবে বাংলাদেশ। ঋণের গড় সুদ হবে ২ দশমিক ২ শতাংশ।
এই ঋণের দুই কিস্তি উতোমধ্যে পেয়েছে বাংলাদেশ।
তবে ঋণ পেতে বরাবরের মতোই বেশ কিছু সংস্কারের শর্ত আছে আইএমএফ'র।
যার মধ্যে রয়েছে জ্বালানিসহ বিভিন্ন খাতের ভর্তুকি কমানো, টাকার বিনিময় ব্যবস্থা বাজারের উপর ছেড়ে দেয়া, রাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কার, কর আদায়ে সক্ষমতা বৃদ্ধি, ব্যাংকিং খাতের সংস্কার, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, আধুনিক মুদ্রানীতি তৈরি করা, আর্থিক খাতের দুর্বলতা দূর করা এবং নজরদারি বাড়ানো ইত্যাদি।
এসব বিষয়ে বেশ কিছু পদক্ষেপ ইতোমধ্যেই নিয়েছে সরকার।
রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা ১৪.৭৬ বিলিয়নে নামিয়ে এনেছে আইএমএফ
আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য আইএমএফের দেওয়া নিট বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২০ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলার। এ লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে আইএমএফ ১৪ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলারে নামিয়েছে। সে হিসাবে লক্ষ্যমাত্রা কমল ৫ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলার।
রিজার্ভ সংরক্ষণে ১৬ মাসে কয়েক দফা ব্যর্থ হওয়ার পর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয় লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে আনার জন্য। এরপরই আইএমএফ তা কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
দুই সপ্তাহের জন্য ঢাকায় এসে আইএমএফের প্রতিনিধি দল ঋণ কর্মসূচির দ্বিতীয় পর্যালোচনা বৈঠক শুরু করে গত ২৪ এপ্রিল। অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খানের সঙ্গে বৈঠকের মাধ্যমে বুধবার তা শেষ করে আইএমএফ।
এরপর সন্ধ্যায় সংবাদ সম্মেলন করে আইএমএফ। এতে মূল বক্তা ছিলেন দলনেতা ও সংস্থাটির গবেষণা বিভাগের উন্নয়ন সামষ্টিক অর্থনীতি শাখার প্রধান ক্রিস পাপাজর্জিও।
সংবাদ সম্মেলনে দুর্বল অবস্থা থেকে ব্যাংক খাতকে তুলে আনার ব্যাপারে অগ্রাধিকার দিতে বলেছে আইএমএফ। সংস্থাটি বলেছে, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আরও অর্থের চাহিদা রয়েছে এবং সরকারের উচিত হবে, খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার যথাযথ কৌশল তৈরি করে তা বাস্তবায়ন করা। এ ছাড়া টেকসই আর্থিক খাত তৈরিকে এগিয়ে নিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত হবে চলমান ঝুঁকিভিত্তিক তদারকব্যবস্থার কাজটিকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া।
অনেক শর্ত পূরণ করার পথে থাকলেও ঋণ কর্মসূচি শুরুর পর থেকে রিজার্ভের ত্রৈমাসিক কোনো লক্ষ্যমাত্রাই পূরণ করতে পারেনি বাংলাদেশ। সরকারের অনুরোধে আইএমএফ পরে সংশোধন করে সব লক্ষ্যমাত্রাই কমিয়ে দেয়।
সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৭. দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার এবং এ বছরের মার্চ পর্যন্ত ১৯. দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ থাকার কথা।
গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে গত মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত বৈঠকে রিজার্ভের নতুন লক্ষ্যমাত্রা চূড়ান্ত হয় বলে জানা যায়।
আইএমএফের ব্যালান্স অব পেমেন্টস ও ইনভেস্টমেন্ট পজিশন ম্যানুয়াল (বিপিএম৬) পদ্ধতি অনুযায়ী মার্চ শেষে দেশের গ্রস বৈদেশিক রিজার্ভ (জিআইআর) ছিল ১৯ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার। বিপিএম ৬ পদ্ধতিতে নিট রিজার্ভ নির্ধারণে জিআইআর থেকে রিজার্ভ সম্পর্কিত দায়গুলো বাদ হওয়ার কথা। এ দায়ের পরিমাণ সাধারণত ৪ থেকে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার হয়। সে হিসাবে নিট রিজার্ভ দাঁড়ায় ১৫ বিলিয়ন কোটি ডলারের কাছাকাছি।
বুধবার সন্ধ্যায় সংবাদ সম্মেলনে আইএমএফের গবেষণা বিভাগের উন্নয়ন সামষ্টিক অর্থনীতি শাখার প্রধান ক্রিস পাপাজর্জিও বলেন, ৪ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলারের ঋণ কর্মসূচির আওতায় তৃতীয় কিস্তিতে বাংলাদেশকে ১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার দিতে রাজি হয়েছে আইএমএফ।
সংবাদ সম্মেলনের পর পরই সংস্থাটির ওয়েবসাইটে তৃতীয় কিস্তির ঋণ নিয়ে বিস্তারিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়।
কমেন্ট